রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশে। ৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদের 'বিতর্কিত' নির্বাচনের পর থেকে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে এ হত্যাকাণ্ড। এতে সারা দেশে তৃণমূল পর্যায়ে নেতা-কর্মীরা তাদের জীবন নিয়ে আতঙ্কিত। আলজাজিরার অনলাইনে প্রকাশিত 'পলিটিক্যাল কিলিংস সেপ্রড ফিয়ার ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবাধিকারবিষয়ক গ্রুপগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছে যে সরকার যদি ঘাতকদের বিচারে দ্রুত পদক্ষেপ না নেয় তাহলে আগামী মাসগুলোয় এ সংকট আরও খারাপ হতে পারে। ঢাকাভিত্তিক মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তদন্ত পরিচালক নূর খান বলেছেন, যে হারে এসব হত্যাকাণ্ড ঘটছে তা উদ্বেগজনক। জানুয়ারিতেই ৩৩টি বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে বলে জানিয়েছে সংস্থাটি। তাদের হিসাবে গত বছর বাংলাদেশে দুই শতাধিক বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। নূর খান বলেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রে টার্গেট করা হয় বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের। বিরোধীরা যদি তাদের প্রতিবাদ করার গণতান্ত্রিক অধিকার চর্চা করতে না পারে তাহলে তারা বিকল্প পন্থা বেছে নিতে পারে। যদি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড অব্যাহত থাকে তাহলে বাংলাদেশে সশস্ত্র ধর্মীয় রাজনৈতিক দলের উত্থান ঘটা অপরিহার্য হয়ে উঠতে পারে।
এরই মধ্যে এসব হত্যা বন্ধের জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। এ সংস্থার এশিয়াবিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, বারবার একই কথা বলা হচ্ছে যে অপরাধ সংঘটনের স্থানে আটক ব্যক্তিকে নিয়ে যাওয়া হলে কোনোভাবে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। এটা একটি ঠাট্টার বিষয় হয়ে গেছে। তিনি বলেন, ঘটনার শিকার যখন রাজনৈতিক একজন অজনপ্রিয় ব্যক্তি হন তখন এই কাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতা কমে যায়।
ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন, কর্তৃপক্ষ যখন এমন দাবি করে তখন তাদের বিশ্বাসযোগ্যতা থাকে না। তিনি আলজাজিরাকে বলেন, বাংলাদেশে পর্যায়ক্রমিক সরকারগুলোর দীর্ঘ দিনের ও তথ্যসংবলিত রেকর্ড আছে বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ডের; যাকে তারা 'ক্রসফায়ার' বলে। বিএনপি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও আওয়ামী লীগ সবাই নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের ব্যবহার করেছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে।
ব্র্যাড অ্যাডামস হতাশা প্রকাশ করে বলেন, রাজনৈতিক চাপের ঊধের্্ব থেকে পেশাগত মনোভাব নিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা উচিত। বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ডের এ ধারা যদি অব্যাহত থাকে তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওপর খুব কমই আস্থা থাকবে বাংলাদেশিদের।
ওদিকে গ্রেফতারের পরে নেতা-কর্মীদের বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ডে সরকারকে দায়ী করেছেন বিএনপির নেতারা। তারা বলছেন, সরকার বিরোধী নেতা-কর্মীদের টার্গেট করেছে।
গত দুই মাসে ক্ষমতাসীন দলেরও বেশ কয়েকজন নেতা-কর্মী নিহত হয়েছেন। ওই প্রতিবেদনে নিরাপত্তা হেফাজতে মারা যাওয়ার কয়েকটি ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে।
তাদের একজন রবিউল ইসলাম। তাকে গ্রেফতার করা হয় ২৭ জানুয়ারি। যশোরের এক সাংবাদিক সাইফুর রহমান বলেছেন, পুলিশ পরে জানিয়েছে, বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের হাতে আক্রান্ত হওয়ার পর দুই পক্ষে গুলিবিনিময় হয়। এ সময় রবিউল গুলিবিদ্ধ হন। বিএনপির এই কর্মী অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই মারা যান নিকটস্থ একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে।
পুলিশ অভিযোগ করে, রবিউল ইসলাম স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা চৈতন্যকুমার মণ্ডল হত্যায় জড়িত। এক দিন আগে ঘটে এ হত্যাকাণ্ড।
সারা দেশের চিত্র একই। শুধু নাম আর স্থানের পরিবর্তন ঘটে। পুলিশ ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর দাবি, গত মাসে যারা নিরাপত্তা হেফাজতে গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন তারা নিজেরা হত্যাকাণ্ডে জড়িত। ৩০ জানুয়ারি সোনাইমুড়ীতে একই রকম 'বন্দুকযুদ্ধে' নিহত হন বিএনপির জেলা নেতা তৌহিদুল ইসলাম। এর আগে তাকে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
মানবাধিকারবিষয়ক সংগঠন 'অধিকার' তার জানুয়ারির হিসাবে দেখিয়েছে জানুয়ারিতেই ৩০টির বেশি বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এর জন্য দায়ী করা হয়েছে র্যাব, পুলিশ, বিজিবিকে। এ ঘটনা মাত্র এক মাসের। ওই রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, যারা নিহত হয়েছেন তারা হয়তো বিএনপি বা জামায়াতে ইসলামীর নেতা না হয় কর্মী ছিলেন।
গত মাসে যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন আতিকুর রহমান। তিনি জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের জয়েন্ট সেক্রেটারি। সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের গাড়িবহরে হামলা হয় গত ডিসেম্বরে। এ ঘটনায় অভিযুক্ত করা হয় আতিকুর রহমানকে। ফলে তিনি পালিয়ে থাকেন টাঙ্গাইলে। সেখানে বকুল নামে এক আত্দীয় তাকে আশ্রয় দিচ্ছিলেন। বকুল বলেন, '১৩ জানুয়ারি রাতে কমপক্ষে ছয়জন মানুষ যারা নিজেদের পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সদস্য দাবি করেন, তারা আমার বাড়িতে ঝড়ো গতিতে প্রবেশ করেন এবং আতিক ও মহিদুল ইসলাম নামে একজনকে তুলে নিয়ে যান।'
সৈয়দপুর বাইপাস সড়কের কাছে ২০ জানুয়ারি পুলিশ উদ্ধার করে আতিকুর রহমানের মৃতদেহ। এখনো মহিদুল নিখোঁজ। এদিকে ৪ ফেব্রুয়ারি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বলেছেন, ২৬ ডিসেম্বর থেকে ২৭ জানুয়ারির মধ্যে বিএনপি ও ১৮-দলীয় জোটের ৩০২ জন নেতা-কর্মীকে হত্যা, না হয় গুম করা হয়েছে। বিএনপির যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, স্বাভাবিকভাবেই তৃণমূল পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। ওই প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের ব্যাপক সমালোচিত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দিন ৬ জানুয়ারি থেকে ক্ষমতাসীন দলের কমপক্ষে নয় কর্মকর্তাকে হত্যা করা হয়েছে। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড হয়েছে বিরোধীদলীয় সমর্থকদের হামলায়। এমন সর্বশেষ হত্যাকাণ্ডের শিকার ৩০ বছর বয়সী মাহবুবুর রহমান রানা। ঢাকার মগবাজারে ২৩ জানুয়ারি তার ওপর হামলা চালান চার থেকে পাঁচ ব্যক্তি। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, হামলাকারীরা ছিলেন হেলমেট পরা। তারা অকস্মাৎ রানার ওপর হামলা চালান। ১৭ জানুয়ারি নাটোর জেলা আওয়ামী লীগের নির্বাহী সদস্য, ইউপি চেয়ারম্যান ফজলুর রহমানকে জেলার সিংড়া এলাকায় হামলা চালিয়ে হত্যা করা হয়। নিহতের আত্দীয়রা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছেন, তাদের নিকটজনকে হত্যার জন্য যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তারা নিরপরাধ। সাতক্ষীরার বাসিন্দা শামসুন নাহারের স্বামী ক্ষমতাসীন দলের কর্মী আবু রায়হানকে হত্যা করা হয়েছে। তিনি বলেছেন, 'সম্প্রতি পুলিশ আমাকে জানিয়েছে, আমার স্বামীকে যারা হত্যা করেছে তাদের কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তবে যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে আমার মনে হয় তারা এ হত্যায় জড়িত নন।' স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, অপরাধীদের বিচার করা হবে। আওয়ামী লীগের নয় নেতা-কর্মীকে হত্যায় জড়িতদের গ্রেফতারে পুলিশ সব চেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে। তার কাছে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীদের মৃত্যু সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'বাংলাদেশে কোনো বিচারবহিভর্ূত হত্যাকাণ্ড নেই। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন ও অপরাধীদের মধ্যে গুলিবিনিময়কালে তারা মারা গেছেন। তারা সশস্ত্র অপরাধী। পুলিশ তাদের গ্রেফতার করতে গেলে বা তাদের আস্তানা ঘেরাও করলে তারা পুলিশের দিকে প্রকাশ্যে গুলি ছোড়ে। জবাবে পুলিশও গুলি ছোড়ে। এভাবেই অপরাধীদের মৃত্যু হয়। আমার জানা মতে তারা সবাই অপরাধী, অনেক মামলায় অভিযুক্ত।'
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।