ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে মানুষে মানুষে হানাহানি সভ্যতার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় কলঙ্ক!
ইংরেজি সাহিত্যে যখন অগাস্টান এইজ চলছে সেই সময়টায় ইংল্যান্ডের একেবারে বুকের মধ্যিখানে , লন্ডন শহরে সার জোসেফ এডিসন(১৬৭২-১৭১৯) নামে খুব শক্তিশালী এক সাংবাদিক-প্রাবন্ধিক ছিলেন। তিনি ও তার বন্ধু স্যার রিচারড স্টেল ( ১৬৭২-১৭২৯ ) মিলে The Spectator নামে তুমুল জনপ্রিয় একটা পত্রিকা বের করেছেন টানা প্রায় ২ বছর। সেই পত্রিকার একটা ইস্যুতে জোসেফ এডিসনের একটা লাইন আমার খুব জোর ধাক্কা দেয়-
“It was said of Socrates that he brought philosophy down from heaven, to inhibit among men; and I shall be ambitious to have it said of me that I have brought philosophy out of closets and libraries, schools and colleges, to dwell in clubs and assemblies, at tea tables and coffeehouses.”
জোসেফ এডিসনের এই পত্রিকাখানার সোশ্যাল এচিভমেন্ট নানামুখী, কিন্তু দর্শনকে স্কুল কলেজের লাইব্রেরীকক্ষ থেকে লন্ডনের রাস্তা- কফি হাউজ- গন জমায়েতের মাঝে এনে অবমুক্ত করাটাকে তিনি তার পত্রিকার সবচেয়ে বড় অর্জনগুলির একটি মনে করতেন।
পাঠক, আমার এই প্রবন্ধের শিরোনাম দেখেই হয়তো বুঝে গেছেন যে পাশ্চাত্য দর্শন সংক্রান্ত বিষয় নিয়েই এখানে নাড়াচাড়া হবে। আপনার মনে প্রশ্ন জাগতেই পারে যে জোসেফ এডিশন না হয় রেস্টোরেশান ইংল্যান্ডের লোক ছিলেন, যাদের কাজই ছিল কথায় কথায় নিজের জ্ঞান জাহির করা ( নেতিবাচক অর্থে নয়, সে সময়ের পণ্ডিত ব্যাক্তিরা আক্ষরিক অর্থেই পণ্ডিত ছিলেন)- একবিংশ শতাব্দীতে প্রযুক্তির এই স্বর্ণযুগে এসে আমি কেন পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস নিয়ে লিখতে আগ্রহী হলাম? দু আঙুলের টোকায়-ই তো এখন গুগল বাবাজীর পেট থেকে সব তথ্য বের করে আনা যায়!
এরকম প্রশ্ন আমার মনে এসেও যে গুঁতোগুঁতি করে নি , তা কিন্তু নয়।
আমার মন থেকে এ বেয়াড়া প্রশ্নের যে প্রতিউত্তর এসেছে তা হল- এ রকমই যদি হয়, তাহলে তো গল্প – কবিতা- উপন্যাস, কোন লিখালিখিরই দরকার নেই। পৃথিবীতে কতশত ডিসিপ্লিনে কত কত মাষ্টারপিস পড়ে আছে, তাই না ? আমি , বা পাঠক, আপনি – নতুন কিই বা সংযোজন করতে পারব এখানে? তারপরও আমি আপনি দু জনেই ব্লগে লিখি বা পড়ি। কেন ? উত্তর সহজ- মনের টানে।
তাই তথ্য উপাত্তের এ সহজলভ্যতার যুগে এসেও কেন আমি আদ্যোপান্ত পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসের মত খটমট একটা বিষয় নিয়ে ব্লগ লেখা শুরু করলাম- তার কারন সাহিত্য এবং সাহিত্যের সাথে সম্পর্কিত সকল রকম ক্রিটিকাল থিওরি এবং ফিলসফিকাল ব্যাকগ্রাউনডের প্রতি আমার দূর্বার আকর্ষণ। ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে প্রথম যেদিন ক্লাস করা শুরু করলাম, সেই দিন থেকেই এই আকর্ষণের জন্ম।
আজ ফাইনাল ইয়ারে এসে আমি অত্যন্ত গর্বিত যে এতদিন আমি যা কিছু শিখেছি ক্লাসরুমে বা পাঠ্যবই থেকে, তা সবার সাথে ভাগ করে নেয়ার জন্য এ নিয়ে লেখালিখি শুরু করতে পেরেছি।
কেন লিখছি, এ প্রশ্নের মোটামুটি একটা উত্তর দাঁড় করানোর পর পরের প্রশ্নের মুখোমুখি হই- কাদের জন্যে লিখছি?
উত্তরটা অনেকটাই স্বার্থপর, প্রথমত, নিজের জন্য। দর্শনের জগতটা আশ্চর্য রকমের সুন্দর এবং মাথা খারাপ করে দেবার মত একের পর এক চমকে ভরা। আজ যেই জিনিসটা আপনি একভাবে বিচার করছেন, দৃষ্টিভঙ্গীতে সামান্য একটু পরিবর্তন আনলেই পুরো ব্যাপারটা “আপসাইড ডাউন”- এর মত কিভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়- তা আবিষ্কার করার এ অনাবিল আনন্দ আমি সবার সাথে ভাগ করে নিতে চাই।
দ্বিতীয়ত, দর্শনের প্রায় সব অথেন্টিক বইপত্র একেকটা দুর্ভেদ্য দুর্গের মত।
তাই, নিজের কোর্সের পড়ার খাতিরে যখন আমি এই কুলকিনারাহীন কোর্স ম্যাটেরিয়ালের সাগরে বোয়ালমাছের মত ( অথবা করাল মাছের মত, সাগরে বোয়াল মাছ থাকে না!) খাবি খাচ্ছি, তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম- সুযোগ পেলে পাশ্চাত্য দর্শনের ওপর আমাদের টঙ দোকানে চায়ের দোকানের আড্ডার ভাষায় কিছু লেখালিখি করবো। আমার ডিপার্টমেন্টের, অথবা ফিলসফি ডিপার্টমেন্টের আমার জুনিয়রদের কোর্স ম্যাটেরিয়াল হিসেবে আমার ব্লগ কাজে আসবে।
তৃতীয়ত, এই লেখা তাদের জন্যেও , যারা দর্শন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী। এছাড়া যারা কঠিন কঠিন বিষয় নিয়ে নাড়াচাড়া করে নিজের মস্তিষ্ককে প্রতিনিয়ত চাপে রাখতে পছন্দ করেন- তাদের জন্যে এই সিরিজ হবে আশা করি নির্মল আনন্দের খনি!
এই পর্যায়ে এসে আমি অত্যন্ত বিনীতভাবে কিছু কথা বলতে চাই। মূলত নিজের জ্ঞানের ভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করার জন্যই আমার পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাস নিয়ে ক্রোনলজিকাল সিরিজ লেখার মত দুঃসাহস দেখাচ্ছি।
এই সিরিজে কোন আস্তিক-নাস্তিক বা ধ্বংসাত্মক থিওলজিকাল বিতর্কের সুত্রপাত হোক, এটা আমি একেবারেই চাই না।
প্রতিটি ব্লগের শেষে আমি আমার সংগৃহীত তথ্যের একটা সংক্ষিপ্ত রেফারেন্স দিয়ে দেব। পাঠক, যদি আপনার ব্লগে কোন তথ্য নিয়ে কনফিউশান তৈরি হয়, তাহলে আমি যে বই থেকে তথ্য নিয়েছি- সেই বইয়ের অনুচ্ছেদ নং উল্লেখ করে দেব। আপনার একটু কষ্ট করে মিলিয়ে নিতে হবে।
যদি দেখা যায় আমার প্রদত্ত তথ্যে ভুল আছে (যেটা মোটেই অস্বাভাবিক কিছু নয়, কারন দিনের শেষে আমি – আপনি সবাই মানুষ), তাহলে আপনার কাছে অনুরোধ থাকবে রেফারেন্সসহ ত্রুটিটা সংশোধন করে দেবার।
আমি কৃতজ্ঞতার সাথে সে সংশোধন গ্রহন করব।
পাশ্চাত্য দর্শনের ইতিহাসকে সাধারণত চারটি ভাগে ভাগ করা হয়- প্রাচীন(ancient) দর্শন, মধ্যযুগীয়(Medieval) দর্শন, আধুনিক(modern) দর্শন, সমসাময়িক(contemporary) দর্শন। আমিও মূলত এই চারটি ভাগ ধরেই ক্রমাগত এগোব।
প্রাচীন দর্শনের আওতায় পড়বে- সক্রেটিস পূর্ব দর্শন, সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল এবং এরিস্টটল পরবর্তি ক্লাসিক ফিলসফি।
মধ্যযুগীয় দর্শনের আওতায় পড়বে- সেন্ট অগাস্টাইনের ক্রিশ্চিয়ান ফিলসফি, ডার্ক এজ বা অন্ধকার যুগের ফিলসফি ( বোথিয়াস, সিউডো ডায়োনিসাস ও এরিজিনা) এবং সেন্ট অ্যাকুইনাস ও তার স্কলাস্টিক সিস্টেম।
আধুনিক দর্শনের আওতায় পড়বে- রেনেসার সময়কাল; বেকন এবং হবস-এর বিজ্ঞানভিত্তিক দর্শন; ডেকার্ট, স্পইঞ্জা ও লাইবনিজের রেশনালিজম; লক, বার্কলে এবং হিউমের এম্পেরিসিজম বা অভিজ্ঞতাবাদ; রুসোর রোম্যান্টিক এভালিউশন; কান্টের ক্রিটিকাল ফিলসফি; হেগেলের এবসলিউট আইডিয়ালিজম; শোপেনহাওয়ারের পেসিমিস্টিক বা নেতিবাচক চিন্তার বিকাশ, কমেট এবং ফরাসী দর্শনে ইতিবাচক ভাবধারার উন্মেষ; বেনথাম ও স্টুয়ার্ট মিলের ইউটিলিটারিয়ানিজম ইত্যাদি।
আর সমসাময়িক বা কন্টেম্পোরারি ফিলসফির মধ্যে পড়বে প্রাগমেটিজম; কার্ল মার্ক্সের ডায়ালেকটিক ম্যাটেরিয়ালিজম; ফ্রেডরিখ নীডসে; বিংশশতাব্দীর মেটাফিজিক্যাল দার্শনিক- বার্গসন এবং হোয়াইটহেড, বারট্রাণ্ড রাসেলের অ্যানালাইটিক ফিলসফি, একজিস্টেনশিয়ালিজম বা অস্তিত্তবাদ এবং অ্যাবজার্ডিজম।
আমি সাহায্য নিচ্ছি মূলত ডেভ রবিনসন- জুডি গ্রুভস-এর ইনট্রোডিউসিং ফিলসফি, অ্যান্থনি কেনি-র ফিলসফি ( ভলিউম ১,২,৩,৪) এবং স্যামুয়েল স্টাম্ফের সক্রেটিস টু সারত্রে- মূলত এই তিনটি বইয়ের।
পাঠক, দর্শনের রোমাঞ্চকর জগতে আপনাকে স্বাগতম!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।