আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুহূর্তের ঝড় (২)

মুহূর্তের ঝড় (১) আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। দিদির সঙ্গে ঘুরতে বেরিয়েছে খোকন। গন্তব্য হাইস্কুলের মাঠ। সেই জ্বরের পর থেকে খোকনকে সর্বক্ষণ আগলে আগলে রাখছে তার দিদি।

বাব্বাহ! সে কি জ্বর। টানা পাঁচদিন ভুগিয়েছে খোকনকে। একেবারে বিছানার সাথে মিশে গিয়েছিল। ডাক্তার একবার বলেওছিল, ক্লিনিকে ভর্তি করতে পারলে ভাল হত। কিন্তু খরচের ব্যাপারটা তার মাকে চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল।

ভাগ্য ভাল, বিপদ আর বেশি বাড়ে নি। বাড়িতেই জয়ার অক্লান্ত সেবা-শুশ্রূষায় এ ধাক্কাটা সামলে নিয়ে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠে খোকন। জ্বরটা যেন ভাইবোনের মধুর সম্পর্কটিকে আরও একটু মজবুত সুতোয় গেঁথে দিয়ে গেল। দিদির হাত ধরে স্কুলমাঠে উপস্থিত হল খোকন। মাঠে এসেই অদৃশ্য একটা লেজ আর দুটি ডানা গজিয়ে উঠল তার।

দিদির হাতের বন্ধন থেকে দ্রুত নিজেকে ছাড়িয়ে নিল। খেলার সাথীদের আহবানে সাড়া দিয়ে সেদিকে দৌড় লাগাল সে। খোকনের ছটফটানি দেখে কি এক অজানা আশঙ্কায় জয়ার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল। মাথা থেকে দুশ্চিন্তাটা দূর দূর করে তাড়িয়ে দিল সে। এতদিন পর ফিরে পাওয়া স্বাধীনতা উপভোগ করছে খোকন।

এটাই তো স্বাভাবিক। খোকনকে ডাক দিল জয়া। “এই খোকন, শুনে যা। ” খোকন দৌড়ে চলে আসল দিদির কাছে। “কি বল্।

” চোখে মুখে বিরক্তির ভাব স্পষ্ট। “কিছু না। ” খোকনের কপালে একটা চুমু খেল জয়া। “বেশি দৌড়ঝাঁপ করিস না যেন। ” ঠোঁট উল্টে এই স্নেহার্দ্র হুঁশিয়ারি বাণীর তোয়াক্কা না করে আবার বন্ধুদের দিকে ছুটল খোকন।

দিদিটা যে কি! দৌড়ঝাঁপ না করলে আবার ক্রিকেট খেলা যায় নাকি! বেশ কিছুক্ষণ ধরে খোকনদের খেলা দেখছিল আর ওরই সমবয়সী কয়েকটা মেয়ের সাথে গল্প করছিল জয়া। হঠাৎ খোকন সামনে এসে হাজির। “চল্ দিদি” “কেন? আজ আর খেলবি না?” “ঐ দারোয়ানটা আর খেলতে দিল না। ”- ক্ষোভের সুরে বলল খোকন। কেন? প্রশ্ন করতে গিয়ে থেমে গেল জয়া।

কারণটা তার অজানা নয়। আর কিছুক্ষণ পরেই এখানে পার্টি মিটিং হবে। দু একটা গাড়িতে করে বেশ কয়েকজন হোমরা চোমড়া ইতিমধ্যে হাজির হয়ে গেছে। আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে আজকাল বেশ ব্যস্ত হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক দলগুলো। বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খোকনের হাত ধরে হাঁটা শুরু করল জয়া।

কিছুক্ষণ হাঁটার পর খোকন ফিসফিসিয়ে বলল, “জানিস দিদি, আজ না ঐ বড় গাড়িটার নিচে বল চলে গেছিল। বল আনতে গিয়ে দ্যাখ কি সুন্দর একটা ঘড়ি পেয়েছি। ” পকেট থেকে কালো গোলাকার বস্তুটা বের করে দিদির হাতে দিল খোকন। জিনিসটা হাতে নিয়েই জয়ার মুখটা ভয়ে রক্তশূন্য হয়ে গেল। ছোট গোলাকার বস্তুটার এক পাশে চ্যাপ্টা ঘড়ির মতো ডায়াল রয়েছে।

ঘড়ির কাঁটা দুটো নির্দেশ করছে এখন সময় ৫ টা বেজে ৫৯ মিনিট। নিচে ছোট করে লেখা “set time 06:00:00 pm” সর্বনাশা জিনিসটাকে চিনতে একটুও ভুল হল না জয়ার। শরীরের সর্বশক্তি দিয়ে যথাসম্ভব দূরে ছুঁড়ে ফেলল। “আহ্! ঘড়িটা ফেলে দিলি কেন?” বিরক্তিভরা কণ্ঠে বলে উঠল খোকন। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে দ্রুতগতিতে খোকনের হাত ধরে ছুটতে শুরু করল জয়া।

কিন্তু পারল না। দিদির হাতের দৃঢ় বন্ধন থেকে নিজেকে মুক্ত করে ঘড়িটা কুড়িয়ে আনতে ছুটে গেল খোকন। “ফিরে আয়, খোকন, ফিরে আয়। ” গলার সমস্ত জোর দিয়ে ভাইকে ডাকতে লাগল জয়া। খোকন কি এ ডাক শুনতে পেয়েছিল? লোভনীয় বস্তুটার কাছে গিয়েই বিদ্যুতের মত আলোর ঝলকানি দেখল খোকন।

সঙ্গে বজ্রপাতের মত প্রচণ্ড শব্দ। কালো মেঘ ঘিরে ধরেছিল খোকনকে। পরমুহূর্তেই এক প্রবল ঝড়ো হাওয়া তাকে উড়িয়ে নিয়ে গেল। তারপর............? খোকনের দেহচ্ছিন্ন মুণ্ডুটা হয়তো গড়াতে গড়াতে জয়ার পায়ে এসে ঠেকল। জয়ার অবচেতন মস্তিষ্ক সে স্পর্শ অনুভব করতে পারল কি?............ ধীরে ধীরে বিছানায় উঠে বসল জয়া।

মাথায় একটা চিনচিনে ব্যথা অনুভব করল সে। ঝাপসা দৃষ্টি আস্তে আস্তে পরিষ্কার হতে থাকল। চারপাশে সারি সারি বেড, অনেক মানুষ। তার পাশে বসে একজন মহিলা কাঁদছে। ক্রন্দনরত মহিলার দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল জয়া; নির্জীব, নিথর, অভিব্যক্তিহীন সে দৃষ্টি।

মহিলাটি কি যেন বলছে, কিন্তু জয়া সে কথা শুনতে পাচ্ছে না। তার কানে তখনও ভেসে চলছে একটি বিস্ফোরণের শব্দ আর একটি আর্তনাদ, “দিদি!......” হঠাৎ উন্মাদের মত চিৎকার করতে করতে বাইরে বেরিয়ে আসল জয়া। হা হা অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল। একটু পরেই হাসি থামিয়ে শুরু করল চাপা গোঙরানি। আবার চিৎকার, আবার হাসি, কান্না, নিরবতা।

আকস্মিক বিস্ময়ে সবার কিংকর্তব্যবিমূঢ় দৃষ্টি আটকে আছে বারান্দায়। জয়ার অপলক চোখ দুটি তাকিয়ে আছে ঊর্ধ্বাকাশের দিকে। কালো মেঘে সারা আকাশ ঢেকে গেছে। আলোছায়ার খেলাকে উৎসাহ দিচ্ছে মেঘের গর্জন। বজ্রপাতের ধ্বনিকে দূরদূরান্তে ছড়িয়ে দিচ্ছে বাতাসের ঘূর্ণিপাক।

শোঁ শোঁ শব্দে সেই ঝড় যেন আপন অস্তিত্ব সদম্ভে ঘোষণা করছে- “হে মানব সমাজ, তোমরা কি আমাকে চিনতে পেরেছ? আমি ঝড়! তোমাদেরই হিংসার প্রতিচ্ছবি। তোমাদের ধ্বংস করাই আমার ধর্ম। আমি অপরাজেয়, প্রবল পরাক্রমী! আমাকে প্রতিরোধ করার শক্তি তোমরা অনেক আগেই হারিয়েছ। তাই আমার আঘাত তোমাদের সহ্য করতেই হবে। ...... হে খোকনেরা, হে নতুন প্রজন্ম, সাবধান! মুহূর্তের ঝড় আবার হবে।

হয়তো এখন থেকে প্রতি মুহূর্তেই তোমাদের সাথে আমার সাক্ষাত হবে......। প্রস্তুত হও। আমি আসছি......” ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।