আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মুহূর্তের ঝড় (১)

সূর্যদেব বেশ ক্ষ্যাপাটে হয়ে উঠেছেন কয়েকদিন। সারাটা সকাল, সারাটা দুপুর ধরে নিজের প্রতাপ দেখাচ্ছেন; যেন ধরিত্রীদেবীকে বোঝাতে চাইছেন – দেখ আমি কত বড় বীর! কিন্তু আজকের দিনটা আর সব দিনের চেয়ে একটু ভিন্ন। সকাল থেকেই আকাশের এক কোণে একখণ্ড কাল মেঘ জমেছে। ধীরে ধীরে সেই মেঘখণ্ড বিরাট আকার ধারণ করে পুরো আকাশটা ঢেকে দিল। সূর্যদেব তাঁর প্রতাপের শেষাংশটুকু অবলম্বন করে মেঘের আড়ালে লুকিয়ে পড়লেন।

বিকেল হতে না হতেই ঘনিয়ে এল সান্ধ্য প্রকৃতি। বাতাস বইতে শুরু করল। সেই বাতাস ক্রমশ রুদ্রমূর্তি ধারণ করে তাণ্ডব নৃত্যের জন্য প্রস্তুত হল। শুরু হল চৈত্রমাসের বৈশাখী আমেজপূর্ণ ঝড়। এই ‘ঝড়’ জিনিসটাকে প্রচণ্ড ভয় পায় খোকন।

তার কেবল মনে হয়, এই ঝড় তাকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে বহু দূরে, যেখানে সে তার প্রাণাধিক প্রিয় দিদিটাকে খুঁজে পাবে না, তাকে কারণে অকারণে ক্ষ্যাপাতে পারবে না। দিদির কোলে মাথা রেখে গুটিসুটি হয়ে সেই অজানা জগতের সন্ধান করছিল দশ বছরের খোকন। এমন সময় মায়ের ডাকে তার চিন্তাজাল ছিন্ন হল। রান্নাঘর থেকে মা চিৎকার করছেন, “এই জয়া, খোকন কে নিয়ে শিগগির খেতে আয়। ওরে, দুধটা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল।

আমার হয়েছে যত জ্বালা, আর পারি না। ” ভাইয়ের চুলে হাত বোলাতে বোলাতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়ল- তা জয়া নিজেও জানে না। মায়ের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে হতচকিত হয়ে উঠে দাঁড়াল। কপালে যে দুর্ভোগ আছে তা আগেই আন্দাজ করতে পেরেছিল সে। তার মানসচক্ষে একটা দৃশ্য ভেসে উঠল- ওঘরে ঢুকেই একজোড়া বিষবাষ্পপূর্ণ চোখ তার দিকে কটমট করে তাকাবে।

যেন মুহূর্তেই ভস্ম করে ফেলবে তাকে। সঙ্গে থাকবে মুখ ঝামটাসহ একগাদা অভিশাপ। এসবের জন্য অবশ্য মাকে দোষ দিতেও পারে না সে। বাবার মৃত্যুর পর থেকেই একখানি সামান্য চাকরি সম্বল করে এই সংসার টিকিয়ে রেখেছে তার মা। ক্লিনিকের আয়ার কাজটা তখন না পেলে হয়তো ছেলে-মেয়েদের নিয়ে তাকে পথে বসতে হত।

এই তিনখানা মুখের আহার্য, দু’ভাইবোনের জামাকাপড়, লেখাপড়ার খরচ, বাড়িভাড়া ও আরও নানারকম সাংসারিক চাহিদা সম্পূর্ণরূপে মেটানো সম্ভব হয় না তার পক্ষে। সারাদিন হাড়ভাঙা খাটুনির পর বাড়ি ফিরেই ছোট ছেলের হাজার রকমের বায়নাক্কা, দু’ভাইবোনের লড়াই, বাকযুদ্ধ, বাড়িওয়ালার বাড়িভাড়ার তাগিদ সবকিছু যেন তার অন্তরের প্রশান্তিটুকু, ছেলে-মেয়ের প্রতি স্নেহাবশেষটুকুকে পুড়িয়ে ছাই করে দেয়। ভাইটিকে নিয়ে রান্নাঘরে ঢুকল জয়া। প্রতিদিনের মতো আজও বকাঝকা, শাপশাপান্ত আর রেষারেষির মধ্য দিয়েই খাওয়ার পর্ব প্রায় শেষ পর্যায়ে উপনীত হল। খোকন গ্লাসের দুধটুকু অর্ধেক খেয়ে তীব্র বিতৃষ্ণার সাথে গ্লাসটা নামিয়ে রেখে হাতমুখ ধুতে চলে গেল।

ভাবখানা এরকম যেন ও বস্তু তার জন্মজন্মান্তরের শত্রু! এ ভাবটি ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই অভিনয় করে ফেলল সে। এই ছলনাপূর্ণ অপটু অভিনয় প্রতিদিনই বিচলিত করে জয়াকে। দুধপ্রিয় বেড়ালের দুধ ছেড়ে উঠে যাবার ঘটনা বড়ই বিচিত্র! খোকনের এ আচরণের অর্থ হল বাকি দুধটুকু জয়াকে খেতে হবে। দিন দশেক পরের ঘটনা। প্রচণ্ড জ্বরে জর্জরিত খোকন বিছানায় শুয়ে আছে।

স্নেহকোমল দুটি হাত যত্নের সাথে তার কপালে জলপট্টি দিয়ে চলেছে। গতকাল সারা রাত ধরে জয়া জেগে থেকেছে, ভাইয়ের সেবায় নিজেকে সর্বক্ষণ মগ্ন রেখেছে। জ্বরে ঢুলুঢুলু লাল চোখ মেলে দিদির উদ্বিগ্ন মুখটা আবছা আবছা পর্যবেক্ষণ করছে খোকন। দিদিকে এতটা উতলা হতে কখনো দেখে নি সে। রাতে ডাক্তার এসে দেখে গিয়েছিল তাকে।

বেশ কয়েকটা জম্পেশ তেতো ওষুধও দিয়ে গেছে। সকালে দিদি দুটো ট্যাবলেট খাইয়ে দিয়েছিল। তেতো ওষুধের প্রভাবে প্রায় বমি করতে উদ্যত হয়েছিল খোকন। দিদিটা কি এক অদ্ভুত সুকৌশলে তার পিঠে দুটো চাপড় দিল, বমি বমি ভাবটা যেন কোথায় উবে গেল! স্নেহসিক্ত জলপট্টির শীতল স্পর্শে এসব কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়ল সে। ........(চলবে)...... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।