দৈনিক প্রথম আলোর বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগের শুনানি শেষ হয়েছে। গতকাল বিচারপতি নাঈমা হায়দার এবং বিচারপতি জাফর আহমেদের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ চতুর্থ দিনের মতো শুনানি গ্রহণ করেন। হাইকোর্টের নির্দেশে হাজির হয়ে প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান বলেন, বিচার বিভাগের মর্যাদা হানি হয় এমন কোনো কাজ আমরা করি না। বিচার বিভাগকে খাটো করব না, ভবিষ্যতেও খাটো করার লক্ষ্য থাকবে না। পত্রিকাটির যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খান বলেন, আমি কাউকে আহত করার চেষ্টা করিনি। তারপরও নিবন্ধের কোনো অংশে বা শব্দচয়নের কারণে যদি আদালতকে আহত করার মতো কোনো বিষয় থাকে, তাহলে আমি অ্যাপোলজি চাচ্ছি। আগামীকাল এ বিষয়ে রায় দেবেন আদালত।
হাইকোর্টের জারি করা রুলের পক্ষে এবং প্রথম আলোর বিরুদ্ধে আদালতে ছিলেন ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম, অ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদীন ও অ্যাডভোকেট সালাউদ্দিন দোলন। প্রথম আলোর পক্ষে ছিলেন ড. শাহদীন মালিক। তাকে সহযোগিতা করেন অ্যাডভোকেট মঞ্জুর আহমেদ। হলফনামা সম্পর্কে ব্যাখ্যা দিতে গতকাল সকালে হাইকোর্টে হাজির হন প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমান।
বেলা ১১টা ৩৯ মিনিটে আদালতের আদেশে মতিউর রহমান বিচার কক্ষের ডায়াসের সামনে যান। আদালতের প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, আলোচ্য লেখাটি প্রকাশের আগে ও পরে তিনি পড়েছেন। তিনি বলেন, প্রতিদিন ২৪ থেকে ৩২ পৃষ্ঠা নিয়ে প্রথম আলো প্রকাশিত হচ্ছে। পত্রিকাটি অনেক লোকের হাত হয়ে ছাপা হচ্ছে। এর প্রতিটি বাক্য ধরে আগানো একজন সম্পাদকের পক্ষে সম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রেও হয়তো তাই হয়েছে। কিন্তু তার মানে এই নয় যে, আমরা কাউকে পারসনালি আক্রমণ করি বা ইচ্ছাকৃতভাবে কোনো ভুল করি। এ সময় আদালত জানতে চান, পেশাগত নিয়ন্ত্রণে কোনো ব্যবস্থা আছে কিনা? জবাবে সম্পাদক বলেন, জি। প্রেস কাউন্সিল আছে। প্রেস অ্যাক্ট আছে। সর্বোপরি প্রথম আলোর নিজস্ব আচরণ বিধি আছে। আমাদের (প্রথম আলো) বিরুদ্ধে কেউ লিখলেও আমরা প্রেস কাউন্সিলে যাই। আমরা কাউন্সিলকে আরও শক্তিশালী করার কথা বলি। আদালত বলেন, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে দেখা যায়, ভিউজ লিখলে দায় লেখকের। এটা সংবাদপত্রে বলাই থাকে। আমাদের দেশে সংবাদপত্রে প্রকাশিত লেখার দায় কার, লেখকের না সম্পাদকের? জবাবে মতিউর রহমান বলেন, দায়দায়িত্ব সম্পাদকের। মতিউর রহমানের কাছে আদালত জানতে চান যে, তিনি সোমবারের হলফনামা নিজে পড়েছেন কিনা? মতিউর রহমান বলেন, জি। আদালত বলেন, ওই আর্টিকেলটি পড়লে মনে হয়, বিশেষ একটি কোর্টকে লক্ষ্য করে নিবন্ধটি লেখা হয়েছে। অর্থাৎ যে কোর্টে আপনি এখন দাঁড়িয়ে আছেন। তবে একটি দিক থেকে ভালোই হয়েছে যে, আপনি এই কোর্টকে সারাবিশ্বে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন। এ জন্য ধন্যবাদ। আদালত বলেন, এই কোর্টকে লক্ষ্য করে নিবন্ধটি লেখা হলো কী এই কারণে যে, এই কোর্টের একজন বিচারপতি নারী? এখানেও জেন্ডার বিবেচনা করা হলো? সম্পাদক বলেন, আমি লজ্জিত। আমরা সবসময় নারীর প্রতি শ্রদ্ধাশীল। পত্রিকার মাধ্যমেও তা প্রকাশ করি।
আদালত বলেন, পার্টিকুলার এই বেঞ্চ নিয়ে লেখার ফলে টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত মানুষ জেনে গেছে যে, এই বেঞ্চ জামিন দেওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে বসে আছেন। হয়তো টেকনাফ থেকে অনেক ইয়াবা ব্যবসায়ীও জামিনের জন্য চলে আসবেন। এই লেখায় আমাদের নাম ছড়িয়ে গেছে। থ্যাংক ইউ ফর দ্যাট। পাঁচ বছর পরে একজন ফোন করে বলছেন, তুমি জাজ হয়ে গেছ, এটা জানি না। আরেকজন জানতে চেয়েছেন, তুমি ক্রিমিনাল ম্যাটার শুনানি কর। আমি যদি আত্দজীবনী লিখি তাহলে এসব লিখব। মতিউর রহমান বলেন, আমাদের একটা ভালো প্রকাশনা সংস্থা আছে, প্রথমা। আমরা ভালো ভালো লেখকের লেখা ছাপাই। আপনি লেখেন। আপনারটাও ছাপাব। এ সময় আদালত কক্ষে উপস্থিত অনেকে হাসতে শুরু করেন। কাঠগড়ায় বসা মিজানুর রহমান খানও হাসছিলেন। তখন আদালত বলেন, অবশেষে আজ তিনি (মিজান) হাসছেন। তখন আবারও হাসতে থাকেন মিজানুর রহমান খান।
মতিউর রহমান বলেন, ১৫ বছর ধরে আমরা বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে লিখে যাচ্ছি। আমরা সব সময় বিচার বিভাগের স্বাধীনতার পক্ষে। বিচার বিভাগের মর্যাদা হানি হয় এমন কোনো কাজ আমরা করি না। আমাদের লেখায় ভুলত্রুটি থাকতে পারে। তবে আদালতকে হেয় করার কোনো উদ্দেশ্য আমাদের নেই। মতিউর রহমান আরও বলেন, একটি কথা বলতে চাই, আপনাদের (আদালত) কাছে সরি বলতে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। বিচার বিভাগকে হেয় করা, অসম্মান করার কোনো ইচ্ছা আমাদের নেই। বিচার বিভাগকে খাটো করব না, অসম্মান করব না। ভবিষ্যতেও (বিচার বিভাগকে) খাটো করার লক্ষ্য থাকবে না। এরপর আদালত মতিউর রহমানকে ধন্যবাদ জানান। নিজের বক্তব্য পেশ করে আদালতের অনুমতিক্রমে বেলা ১১টা ৫৭ মিনিটে মতিউর রহমান ডায়াস ছেড়ে বিচার কক্ষের বেঞ্চে গিয়ে বসেন। এরপর হলফনামায় দেওয়া জবাবে নিজের বক্তব্য ও অবস্থান (ক্ষমা চাওয়া না চাওয়া) নিয়ে অস্পষ্টতা দেখা দেওয়ায় বিষয়টি স্পষ্ট করতে আদালতের অনুমতিক্রমে বক্তব্য দেন মিজানুর রহমান খান। তিনি বলেন, আমাকে কথা বলতে সুযোগ দেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। আমি নিজের উপলব্ধি থেকে লিখি। ১৯৮৯ সাল থেকে আইন ও আদালতের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে লিখছি। এখানে যেসব আইনজীবী আমার বিরুদ্ধে শুনানি করেছেন, তাদের সবাইকে আমি শ্রদ্ধা করি। অনেক আইনজীবী আমাকে বলেছেন, তারা আমার অনেক লেখা সমর্থন করেন। আবার এ লেখাটি নিয়ে তাদের আপত্তি রয়েছে। আমার সম্পাদক মহোদয় বলে গেছেন। তার আলোকে বলব, ভুল হতেই পারে। তবে আমি সব সময়ই এ প্রতিষ্ঠানের সংস্কার চেয়ে এসেছি। আমি কাউকে আহত করার চেষ্টা করিনি। আমার উদ্দেশ্য এই মহান প্রতিষ্ঠানকে কোনোভাবেই খাটো করা নয়। তবে শব্দচয়ন বা বাক্যের ব্যবহার হয়তো যথাযথ ছিল না। ছোট করার উদ্দেশ্য ছিল না। এ জন্য লিখিনি। তারপরও আমার এ নিবন্ধের কোনো অংশে, শব্দচয়নের কারণে যদি আদালতকে আহত করার মতো কোনো বিষয় থাকে, তাহলে আমি অ্যাপোলজি চাচ্ছি। পরে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ বলেন, মতিউর রহমান সাহেব এখানে এসে যা বলে গেছেন, তার এই উদ্যোগ প্রশংসনীয়। এরপর এ নিয়ে আর এগোনো ঠিক হবে না। আমাদের এ নিয়ে কোনো বক্তব্য নেই। আদালত তার বিবেচনায় একটি রায় দেবেন। তবে কোর্ট রিপোর্টিং নিয়ে আদালত একটি গাইড লাইন দেবেন বলে আমরা আশা করি। শুনানিতে ড. শাহদীন মালিক বলেন, গত একশ বছরের মধ্যে এখন একটি অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে, যখন দেশে কোনো আদালত অবমাননা আইন নেই। সংবিধানের ৩৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আইনের বাইরে গিয়ে কাউকে কোনো ধরনের সাজা দেওয়া যাবে না। তিনি বলেন, ২০১৩ সালে নতুন আইনের মাধ্যমে ১৯২৬ সালের আদালত অবমাননা আইন বাতিল হয়ে গেছে। নতুন আদালত অবমাননা আইনটি হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছেন। জেনারেল ক্লোজেস অ্যাক্ট অনুযায়ী সংসদ সুস্পষ্টভাবে না বলে দিলে বাতিল হয়ে যাওয়া আইনের পুনরুজ্জীবন হবে না। এক প্রশ্নের জবাবে শাহদীন মালিক বলেন, সংবাদপত্র রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ। সাংবাদিকরা কোথাও সূত্র প্রকাশ করেন না। সূত্র প্রকাশ করতে হলে সাংবাদিকদের পক্ষে আর সাংবাদিকতা করা সম্ভব হবে না। এর আগে সকালে শুনানির শুরুতে আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, মঙ্গলবার রাতে একটি টিভি চ্যানেলের টকশোতে সাংবাদিক আমানুল্লাহ কবির বলেছেন, 'উকিল আর বেশ্যা এক। টাকা দিলে বেশ্যা শুয়ে পড়ে আর উকিল দাঁড়িয়ে যায়।' এ বিষয়ে আদালতের দৃষ্টি আকর্ষণ করে ওই অনুষ্ঠান সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানান এ আইনজীবী। ১০টা ৪০ মিনিটে আদালত বসেন। মিজানুর রহমান খান কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান। তবে কিছু সময় পরে তাকে বসতে কাঠগড়ায় চেয়ার দেওয়া হয়। বেলা ১টার দিকে শুনানি শেষ হয়। উচ্চ আদালত থেকে হওয়া জামিন আদেশ নিয়ে ২৮ ফেব্রুয়ারি 'এক মিনিটে একটি আগাম জামিন কীভাবে' ও ১ মার্চ 'ছয় থেকে আট সপ্তাহের স্বাধীনতা' শিরোনামে মিজানুর রহমান খানের দুটি নিবন্ধ প্রথম আলোতে প্রকাশিত হয়। ২ মার্চ ব্যারিস্টার রফিক-উল হক এবং ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ ওই দুটি নিবন্ধ আদালতের নজরে আনেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদালত স্বপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করেন। পরে আরেকটি আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে রুল জারির পাশাপাশি মিজানুর রহমান খানকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এ মামলার শুনানিতে সাংবাদিকদের সততা নিয়ে ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদের অসত্য বক্তব্যের প্রতিবাদ ও প্রকাশকে কেন্দ্র করে দৈনিক সমকাল সম্পাদক, প্রকাশক, নয়া দিগন্ত সম্পাদক, প্রকাশক, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি, সম্পাদক, ঢাকার বরিশাল বিভাগীয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, সম্পাদক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, সম্পাদক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতির সভাপতি, সম্পাদকের বিরুদ্ধে রুল জারি করেন হাইকোর্ট। সাংবাদিক সমিতির নেতাদের তলবও করা হয়। আজ তাদের হাইকোর্টে হাজির হওয়ার দিন ধার্য রয়েছে। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধান বিচারপতির হস্তক্ষেপ চেয়ে সোমবার ১৬ জন সম্পাদক বিবৃতি দেন।
বিচারপতি ফয়েজীর এলএলবি সনদ : হাইকোর্টের সাবেক বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজীর এলএলবি সনদ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করায় দৈনিক প্রথম আলো ও ভোরের কাগজের সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রতিবেদককে দেওয়া দণ্ডের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি শেষ হয়েছে। গতকাল বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের দ্বিতীয় বেঞ্চে এ বিষয়ে শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। আগামীকাল বৃহস্পতিবার এ বিষয়ে রায় ঘোষণার দিন ধার্য করেছেন আদালত। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আপিল বিভাগে এ শুনানি শুরু হয়। আদালতে আপিলের পক্ষে শুনানি করেন ড. কামাল হোসেন। বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজীর এলএলবি সনদ নিয়ে ২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর দৈনিক ভোরের কাগজ এবং প্রথম আলোতে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ফয়েজীর নম্বরপত্রে এলএলবি বিষয়ে নম্বর ঘষামাজা। পরে ফয়েজীর বাবা হাইকোর্টে আদালত অবমাননার মামলা করেন। এ মামলায় ২০০৫ সালের ২১ মার্চ এক রায়ে হাইকোর্ট প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমান, প্রকাশক মাহফুজ আনাম, প্রতিবেদক একরামুল হক বুলবুল ও মাসুদ মিলাদকে এক হাজার টাকা করে জরিমানা করেন। এছাড়া ভোরের কাগজের প্রতিবেদক সমরেশ বৈদ্যকে দুই মাসের কারাদণ্ড ও এক হাজার টাকা জরিমানা এবং ওই সময়কার সম্পাদক আবেদ খান ও প্রকাশক সাবের হোসেন চৌধুরীকে এক হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টরা আপিল বিভাগে আবেদন করেন। পরবর্তীতে বিচারপতি ফয়েজীর বিরুদ্ধে ২০০৭ সালে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠিত হয়। এরপর ফয়েজী ওই বছরের ১২ জুলাই পদত্যাগ করেন।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।