গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে মনস্তাত্তি্বক দ্বন্দ্ব চলছে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের। প্রথম দিকে গণজাগরণের প্রায় প্রতিটি কর্মসূচির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করলেও কিছু দিন ধরে ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতা-কর্মীদের পাশে দেখা যাচ্ছে না। সম্প্রতি দুই পক্ষ পাল্টাপাল্টি অভিযোগ তুলেছে একে-অন্যের বিরুদ্ধে। তাদের বিরোধটাও প্রকাশ্যে এসেছে। ছাত্রলীগ-যুবলীগ নেতা-কর্মীদের বক্তব্যে প্রকাশ পাচ্ছে গণজাগরণ মঞ্চ এখন 'অপ্রয়োজনীয়'।
অন্যদিকে মঞ্চের কর্মীদের ওপর সাম্প্রতিক হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগ-যুবলীগকে দায়ী করেছেন গণজাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ডা. ইমরান এইচ সরকার। অবশ্য এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ছাত্রলীগ-যুবলীগের নেতারা। এ বিষয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়ে ছাত্রলীগ সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ বলেছেন, হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা প্রমাণিত হলে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে তারা পুরো জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন। বরং তিনি পাল্টা অভিযোগ করেছেন, ডা. ইমরান আন্দোলনে প্রাণ ফিরে পাওয়ার জন্যই ছাত্রলীগের কর্মীদের জড়িয়ে মিথ্যা অপপ্রচার চালাচ্ছেন। গণজাগরণ মঞ্চ তাদের কর্মসূচি থেকে সরে এসেছে বলে দাবি করে ছাত্রলীগ সভাপতি বলেন, গণজাগরণ মঞ্চ বর্তমান সরকারের বিরুদ্ধে একটি নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরির মাধ্যমে সুশীল সমাজের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করছে।
আর সে কারণেই ছাত্রলীগ ও যুবলীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন ডা. ইমরান ও তার সংগঠন।
অন্যদিকে ডা. ইমরান দাবি করেছেন, গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো বিরোধ নেই। মঞ্চ কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দলের আশীর্বাদপুষ্টও নয়। মূলত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল বিষয়ে তাদের সাম্প্রতিক মন্তব্য ও জামায়াতের সমর্থনপুষ্ট ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে সরকারের অর্থ গ্রহণের প্রতিবাদ জানানোসহ কয়েকটি ইস্যুতে নৈতিক অবস্থানের কারণেই সরকার বর্তমানে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। ইমরানের মতে, সরকারের মধ্যেই একটি দল আছে যারা দীর্ঘদিন ধরে জামায়াতের সঙ্গে আপস করতে আগ্রহী।
তারাই মঞ্চের কর্মীদের ওপর হামলা করেছেন। এ ছাড়া ছাত্রলীগ-যুবলীগের মধ্যে যারা অবাঞ্ছিত তারাই নতুন সংগঠন তৈরি করে গণজাগরণ মঞ্চের বিরুদ্ধে বর্তমানে কাউন্টার অ্যাটাক করছেন।
রবিবার আলাপকালে ডা. ইমরান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, শুরু থেকে সম্পর্ক রাখলেও গত বছরের মার্চের পর থেকে ছাত্রলীগ ও যুবলীগ গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেনি। এ দুই সংগঠনের সঙ্গে সম্পৃক্ত কেউ কেউ নিজেদের আলাদা পরিচয় তৈরির জন্য 'চেতনা ৭১', 'মুক্তিযুদ্ধ সংসদ সন্তান কমান্ড', 'গৌরব ৭১' প্রভৃতি নামে সংগঠন গড়ে তোলেন। গত বছরের ২৬ মার্চ পর্যন্ত জামায়াত নিষিদ্ধসহ কিছু ইস্যুতে দাবি পূরণের জন্য সরকারের কাছে গণজাগরণ মঞ্চ আলটিমেটাম দেয়।
তার পর থেকে সরকার সমর্থক এ সংগঠনগুলো নিজেদের রাজনৈতিক এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে না পেরে ও সরকারকে সমালোচনা করার অভিযোগ তুলে গণজাগরণ মঞ্চ ছেড়ে যায়। ইমরান বলেন, বিশেষ করে এ বছর স্বাধীনতা দিবসে ইসলামী ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা গ্রহণের ব্যাপারে আমরা শুরু থেকেই বিরোধিতা করে আসছিলাম। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতারা বিভিন্ন মাধ্যমে এ টাকা গ্রহণের বিরোধিতা না করার জন্য গণজাগরণ মঞ্চকে বলতে থাকেন। তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে প্রচুর লেখালেখিও করেন। তাদের কর্মীরা ৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় শাহবাগে আমাদের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ও চেয়ার-টেবিল সরিয়ে ফেলেন।
অন্যদিকে হামলার ঘটনায় সম্পৃক্ততার প্রমাণ সম্পর্কিত ছাত্রলীগ সভাপতির বক্তব্য প্রসঙ্গে ডা. ইমরান বলেন, তিনি বা তার সংগঠন কীসের ভিত্তিতে প্রমাণ করবেন যে সেখানে তাদের কর্মীরা ছিলেন না। আর ঘটনার সময় কোনো সিসিটিভি ক্যামেরা সেখানে ছিল না। ইমরান বলেন, আপসহীনতার কারণে গণজাগরণ মঞ্চ যে জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে তা অনেকের কাছে মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে। তবে সম্প্রতি কর্মীদের ওপর হামলার পরও সাধারণ মানুষের নীরবতা ও গুটিকয় সংগঠনের প্রতিবাদ জানানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সাধারণের নীরব থাকার অর্থ এ নয় যে তারা আমাদের সমর্থন দিচ্ছেন না। ডা. ইমরানের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলের অভিযোগ মঞ্চের নামে চাঁদা তোলার।
এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এ অভিযোগ ভিত্তিহীন ও বায়বীয়। মঞ্চ কারও কাছ থেকে কখনো টাকা নেয় না। আমরা শুরু থেকেই ব্যক্তি-উদ্যোগে মঞ্চের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের ব্যয়ভার বহন করি। আর আমি মঞ্চের খাতিরে আমার সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়েছি। নিজের গাড়ি বিক্রি করেছি।
আমার কোনো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নেই।
জানতে চাইলে ৩ এপ্রিলের ঘটনা প্রসঙ্গে যুবলীগের উপ-দফতর সম্পাদক নাসিম আল মোমিন রূপক বলেন, ডা. ইমরান ও তার সংগঠনের এক কর্মী জয় আমার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ করেছেন। কিন্তু আমি ঘটনাস্থলে ছিলাম না। এমনকি ছাত্রলীগের পদধারী কেউই ছিলেন না। সেদিন সেখানে কারা গিয়েছিলেন তাও বলতে পারব না।
তিনি বলেন, আমাদের গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে কোনো বিরোধ নেই। কিন্তু আমাদের দলের বিরুদ্ধে যখন কেউ অপপ্রচার চালায় তখন সামাজিক মাধ্যমে আমরা তার জবাব দিই। তেমনি সরকারের বিরুদ্ধে গণজাগরণ মঞ্চ কিছু বিষয়ে কথা বলেছিল। তাদের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ার কারণে হয়তো ডা. ইমরান ও তার 'সন্ত্রাসী বাহিনী' আমার বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। যদি ওই ঘটনায় আমার সম্পৃক্ততা ডা. ইমরান প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন তবে তাকে পুরো জাতির কাছে কানে ধরে ক্ষমা চাইতে হবে।
রূপক আরও বলেন, সুশীল সমাজের কাছে গিয়ে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধির জন্যই সরকারবিরোধী অপপ্রচার চালাচ্ছে মঞ্চ। আর সে কারণেই ছাত্র ও যুবলীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছেন ইমরান ও তার সংগঠন। এ বিষয়ে ছাত্রলীগ সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম বলেন, দেশের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সংগঠনের সমন্বয়ে গণজাগরণ মঞ্চ ছিল একটি অরাজনৈতিক মুভমেন্ট। এটি গঠনের সময় আমাদের একজন মুখপাত্র প্রয়োজন ছিল। আর সে কারণে ডা. ইমরানকে মঞ্চের মুখপাত্রের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
তবে ডা. ইমরান সাম্প্রতিক ঘটনায় ছাত্রলীগের জড়িত থাকার বিষয়ে যা বলছেন তা তার ব্যক্তিগত অভিমত। এমনকি তিনি এ ঘটনায় ছাত্রলীগের জড়িত থাকার বিষয়টিও প্রমাণ করতে পারেননি। নাজমুল বলেন, ডা. ইমরান নিজের ফেসবুক অ্যাকাউন্টে এ বিষয়ে নানা মন্তব্য করলেও সে ঘটনার দিন কোনো ছাত্রলীগ কর্মীর হামলার ছবি পোস্ট করেননি। বর্তমানে গণজাগরণ মঞ্চের প্রয়োজনীয়তা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, মঞ্চ সৃষ্টি হয়েছিল একটি নির্দিষ্ট ইস্যু কেন্দ্র করে। ইতোমধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তির ব্যাপারে জাতীয় সংসদে আইনের সংশোধনী পাস হয়েছে।
ফলে এ ব্যাপারে সরকারকে চাপে রাখার আর কোনো অর্থ নেই। অর্থাৎ গণজাগরণ মঞ্চের আর কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। দেশে যখন যা-ই ঘটুক না কেন গণজাগরণ মঞ্চ তা নিয়ে মাতামাতি করে। তবে গণজাগরণ মঞ্চের সঙ্গে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কোনো বিরোধ নেই। ছাত্রলীগ সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ এ প্রতিবেদককে বলেন, বর্তমানে ছাত্রলীগের বিরুদ্ধে নেতিবাচক কথা বলা ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে।
ডা. ইমরান তার বক্তব্যে ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান দুই নেতার জড়িত থাকার কথা বলেছেন। কিন্তু আমি এ দুজনের ব্যাপারে তাকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছি। তিনি যদি প্রমাণ করেন মঞ্চের কর্মীদের হামলার ঘটনায় ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততা আছে তবে ছাত্রলীগের কর্মীরা জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে দাঁড়িয়ে পুরো জাতির কাছে ক্ষমা চাইবেন।
তিনি বলেন, গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন যখন শুরু হয় সে সময় এর সঙ্গে অর্ধশতাধিকের বেশি সংগঠন জড়িত ছিল। কিন্তু এখন তারা কোথায়? সে সময় সব সংগঠনের সম্মিলিত সিদ্ধান্তে ডা. ইমরান মঞ্চের কর্মসূচি ঘোষণা করতেন।
আমরাও তখন মঞ্চের সঙ্গে ছিলাম। কিন্তু এটি একটি অরাজনৈতিক প্লাটফর্ম। তাদের ৬ দফা দাবির ৬০ শতাংশ ইতোমধ্যে পূরণ হয়েছে। এখন শুধু জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা বাকি আছে। কিন্তু মঞ্চ তাদের কর্মসূচি থেকে সরে এখন নারী দিবসসহ অন্য দিবসগুলোয়ও কর্মসূচি পালন করছে।
অর্থাৎ তারা তাদের ৬ দফা দাবি আদায়ের কর্মসূচি থেকে সরে এসেছে। তারা লাখ লাখ টাকা খরচ করে নিজেদের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন করে। এতে স্পষ্ট হয়, যে উদ্দেশ্য নিয়ে মঞ্চ হয়েছিল তা থেকে সরে এসেছেন ইমরানেরা। তাই আমরাও মঞ্চ থেকে সরে এসেছি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।