২০১২ সাল । ইন্টার্র্নি চলছে । হাসপাতালে সহকর্মিদের বি সি এস পড়া শুনাতে অন্ত নেই । আমিও যে পড়ছি না ব্যাপারটা এরকম নয় । তবে খুব বেশি চিন্তা অনুভব করছিলাম না ।
কারন ছোট বেলা থেকেই আমি মোটামুটি অংকে ভাল । তাই অংকের ২০ মার্ক আমি পাব এতটুকু আত্মবিশ্বাস ছিল । (নিজের ঢোল একটু পিটিয়ে নিলাম আর কি , কাহিনি শেষে আবার বইলেন না যে এই রকম গাধা ক্যামনে চান্স পাইল ) বরাবরের মতই পরীক্ষার আগে মনে হল , পরীক্ষা যদি ১ সপ্তাহ পিছিয়ে যেত তবে সেইরাম প্রস্তুতি থাকত । এইবারের মত যাক , ৩৪ তম থেকে দেখাই দিব , আমি কি জিনিস ?
এরই মধ্যে কি সব রিট হল পরীক্ষা ১ সপ্তাহ পিছিয়ে গেল । পরীক্ষা উপলক্ষে অভিজ্ঞতা এইটুকু হল এই দেশে যদি মনের মত কিছু না হয় তাহলে একটা রিট করাও ।
এই রিটের উছিলায় প্রস্তুতি কিছুটা গুছিয়ে নাও ।
।
পরীক্ষার সিট পড়েছে ইডেন কলেজে । আহারে আবেগে কাইন্দা ফেলাইলাম । আমার জীবনের সব গুরুত্তপুর্ন পরীক্ষার সিট গার্লস স্কুল আর মহিলা কলেজে হয় ক্যারে ? আহারে ছোট বেলাই (?) কত কসরত করছি গার্লস স্কুল এ ঢোকার জন্য ।
আর এখন দেখি না চাইতেই শিলা বৃষ্টি ।
।
পরীক্ষার দিন সকালে রউনা হলাম । ও আল্লাহ কোন রিকশা দেখি যাইতে চাই না । রিকশাওয়ালা দের দেখি কোন আবেগ নাই ।
ইডেন কলেজ এর কথা বললে তো বিনা ভাড়ায় নিয়ে যাবার কথা , সেখানে টাকা দিয়েউ যাইতে পারতেছি না । এরপর আইলো বৃষ্টি । বন্ধু মেহেদি কে বললাম , দোস্ত ইডেনে যাউয়ার চেয়ে চল হাইকোর্ট যাই । একটা রিট করি যদি পরীক্ষা পিছায় আর কি! অবশেষে দিগুন ভাড়াতে বৃষ্টির মাঝে ইডেন কলেজে পৌছুলাম ।
।
পরীক্ষার হলে সিট দেখে ত অবস্থা খারাপ । একেবারে টিচার দের টেবিলের সামনে । বুঝলাম ৩৪ ই ভরসা । এই যাত্রায় শুধু অভিজ্ঞতার ঝুলি সমৃদ্ধ করতে হবে । আমার পাশের সিট তখনও খালি ।
ঢাকা কলেজের একজন আসল ।
প্রস্তুতির যে অবস্থা তাতে পরিচয় দিতে ভয় হল । হাজার হলেউ মেডিকেল কলেজের ত মান সম্মান ডুবান যায় না ।
-কেমন আছেন ? আমি রাশেদ রাব্বি (হাত টা এগিয়ে দিলাম )
বুঝলাম না লোকটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল...।
_ হ্যাঁ ।
আমি ...............।
- কোথায় পড়েন ?
- ঢাকা কলেজ ।
- কোন সাবজেক্ট?
- ইকোনমিক্স । আপনি?
- এই স্থানিয় একটা কলেজে পড়ি আর কি ।
- কোন সাবজেক্ট?
- এই বায়োলজি রিলেটেড ।
- তাহলে বিজ্ঞান ত ভালই পারবেন ।
- না আসলে ইন্টারের পর তো আর পড়া হই নি । আপনার কি প্রথমবার?
- না । ৩য় । আপনার ?
- এইবার প্রথম আর কি ? দেখতে এলাম বিসি এস পরীক্ষা কেমন হই ।
ভুল টা এখানেই করলাম । প্রথমবার শুনে লোকটি আমার প্রতি তার সমস্ত আগ্রহ হারিয়ে ফেলল । আমি পুরাই হতাশ । এটা কি করলাম । একজন অভিজ্ঞ লোক কে হারালাম ।
।
এরপর পরিক্ষক রা ঢুকলেন । ও মোর খোদা । স্লিভলেস ব্লাউজ , লাল রঙের শাড়ি , ফর্সা অল্প বয়স্কা এই মাডাম সামনে থাকলে আমি ক্যামনে পরীক্ষা দিব ?
চোখ বন্ধ করে আল্লাহ কে ডাকলাম , “আল্লাহ , হযরত ইউসুফ (আ) এর মত পরীক্ষা আমারে নিয় না । প্রশ্ন সহজ কর , যাতে আমি এই মাডামের রূপে বিমহিত না হয়ে প্রশ্নের জাদুতে বিভোর থাকি ।
এই ধরনের লেডি টিচার দের পরীক্ষার হলে না পাঠানই পরিক্ষার্থিদের জন্য মঙ্গল । আশা করি কর্তৃপক্ষ এই বিষয়টা খেয়াল রাখবে ।
।
এরপর পরীক্ষা শুরু । পরিক্ষক তার হাতের সমস্ত প্রশ্ন আমার হাতে দিয়ে বললেন , একটা নিয়ে পিছনে দিয়ে দাও ।
পিছন থেকে এক মেয়ে বলে উঠল, ভাইয়া কোন সেট রাখলেন ? আমি খ সেট শুনে সে বলল , আমি ও খ সেট রাখলাম ।
বায়ে তাকিয়ে দেখি , এক ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আছে । মাথা নাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম , কি?
সে দুটো আঙুল তুলে v সাইন দেখাল । আমিও পালটা জবাব দিলাম । এরপর সে ok sign দেখাল ।
আমিও তাকে আশ্বস্ত করলাম । শেষে এমন অবস্থা হল যে আমি সহ আমার আশে পাশে সবার সেট একই । শুধু ঢাকা কলেজের অই ভাই ছাড়া । কারন সে আমার প্রতি হতাশ ছিল । যাই হোক ।
পিছনের মেয়েটা আর আমি “ দশে মিলে করি কাজ , হারি জিতি নাহি লাজ” ছোট বেলার এই ভাবসম্প্রসারনের পরিপুর্ন ব্যবহার আমাদের বাস্তব জিবনে করলাম ।
পরীক্ষার সময় ক্যামনে শেষ হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না । পরীক্ষা শেষ হতেই বুঝলাম চান্স হয়ে যাবে। এখন আর কেউ আটকাতে পারবে না ।
হল থেকে বের হয়ে মিস্টি না পেয়ে ঝাল মুড়ি খাইতে খাইতে মেসে চলে এলাম ।
..............................................................................................................................
লিখিত পরীক্ষা । হলে পৌছুলাম । প্রথমে অই মেয়েটার সাথে কথা বললাম । অর বাচ্চা আর সংসারের খোজ খবর নেবার পরে বললাম , পরীক্ষার প্রস্তুতির খবর কি? বলল , ভাইয়া অংক তেমন পারি না । একটু হেল্প করেন ।
ঠিক আছে , দেখা যাক । আমার পাশে তখন ঢাকা ভার্সিটির applied physics এর এক ভাই বসেছে । খুব মিশুক ধরনের । ছাত্রলীগের হল কমিটিতে আছে । যাই হোক ।
পরীক্ষা শুরু হল । আলহামদুলিল্লাহ ৫৫ মিনিটে পরীক্ষা শেষ । এই বার অন্যদের সাহায্য করার দরকার । আশে পাশের সবাই মিলে সেইরকম পরীক্ষা দিলাম । সবারই মানসিক দক্ষতা দেখি একই রকম ।
আন্তর্জাতিক যা লিখলাম । নিজেকে ত জাতিসংঘের মহাসচিব মনে হচ্ছিল । ইরান , কোরিয়া , থাইল্যান্ডের বিপ্লব সম্পর্কে অগাধ জ্ঞান !!
সবচেয়ে মজা হল এক পরিক্ষায় TT এর elaboration লিখতে যেয়ে । আমি লিখলাম tetanus toxoid . পাশের ভাইয়া লিখল table tennis আর মেয়েটার মাধ্যমে পিছন থেকে খবর এল taka transfer .একটু পর T-twenty . কোনটা কি? মাথা তো আউলায় যাবে । যিনি প্রশ্ন করেছেন সেউ এত গুলা জানে কিনা সন্দেহ।
১০ টা দর্শনিয় স্থানের নাম । ৮ টা এক নিঃশ্বাসে লিখলাম । বাকি দুইটা । কি করি ? এবার শুরু হল , কার বাড়ি কোথাই । সামনের বেঞ্চের ভাইয়ার বাড়ি গোপালগঞ্জ ।
তার কাছ থেকে জেনে লিখলাম টুঙ্গিপাড়া । পিছনের মেয়েটার বাড়ি নাটোর । লিখলাম চলন বিল ।
ইংরেজি পরীক্ষাই খুব কড়া গার্ড দিল । মাথা একটু ঘুরাতে দেয় নাই ।
এর ফলে লাভ হল আমাদের । ইচ্ছা মত লিখলাম । কি লিখলাম জানি না । তবে অই পরীক্ষায় আমরা ৩ জনই ২ টা করে অতিরিক্ত কাগজ নিছি । হাজার হলেউ স্টুডেন্ট তো খারাপ না !
তবে খুব আশ্চার্য হয়েছি , applied physics এর ভাইয়া যখন আমার কাছে 3G এর অর্থ জিজ্ঞাসা করল ।
আমি কনফিউজ হয়ে গিয়েছিলাম । কিছুতেই মিলাতে পারি নি , dhaka university , applied physics ,facebook এর সাথে 3G !!!
আর মেডিকেল এর পরীক্ষা ত আরও মজা করে দিলাম । আমরা আমরাই ত ।
যাই হোক লিখিত পরীক্ষা উপলক্ষে medical , non medical এবং বিভিন্ন মেডিকেলের বন্ধুদের সাথে দেখা হল । বলতে গেলে get together এর অনুভুতি ।
..............................................................................................................................
ভাইভার দিন পি এস সি র ভাব সাব দেখেই ত ভই পেয়ে গেলাম । কঠিন প্রস্তুতি । দুই তিন বার রিহার্সেল করে গেলাম । কোন প্রশ্নের উত্তর কেমন দিব? যাই হোক ভাইভার জন্য রুমের বাইরে যখন দাঁড়িয়ে রইলাম তখন একেকজন বের হচ্ছে আর তাদের হাসিমুখ দেখে কেন যেন ভয় বেশি হচ্ছিল । আজকে এইখানে আমিই কি সেই ব্যাক্তি যে খালি হাতে ফিরবে ।
তবে বের হয়ে আসা দের মুখ থেকে ই এন টি র প্রশ্ন শুনে ভাল লাগল যে যাক আমার বিষয়ের কেউ আছে হইত ।
অবশেষে ঢুকলাম।
আমি বসার সাথে সাথে ডান পাশের স্যার বলে উঠলেন
- এই ছেলে তুমি এইভাবে চুল কেটেছ কেন?
(বলে রাখা ভাল আমি ১ দিন আগে মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে বলে হাল্কার
উপর ঝাপসা কাট দিইয়ে ছিলাম )
-স্যার আসলে মাথার চুল পড়ে যাচ্ছে ত । তাই............
-এইভাবে চুল কাটলে চুল পড়া কমে , এটা শিখেছ? বইতে এটা পড়েছ ?
-ঠিক টা নই স্যার । আসলে এটা আমার বাবার বিশ্বাস ।
সে চুল বড় রাখত ত সেই জন্য তার মাথাই নাকি চুল নেই , তাই আমি সবসময় এই ভাবে কাটাই যাতে আমার মাথাই কিছু টিকে থাকে । তবে mechanical effect এর বিষয় ত কিছু আছে স্যার ।
(বুঝলাম না । আমার এই উত্তর শুনে সে খুব খুশি হল । )
এই স্যার ছিলেন cardiologist .
মোটামুটি প্রায় সব প্রশ্ন পারলাম ।
এরপর বামে তাকিয়ে দেখি আব্দুল্লাহ স্যার । আমার ই এন টি র স্যার । এখন দাড়ি রেখেছে । স্যার এর প্রশ্ন ছিল খুব মজার
- কোন মেডিকেল?
- স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ
- প্রিন্সিপ্যাল স্যার এর নাম কি ?
- স্যার এখন আছেন দিলিপ কুমার ধর । তবে আমাদের সময় আমরা দুইজন স্যার কে পেয়েছিলাম আজহার স্যার আর আপনাকে স্যার ।
উত্তর শুনে স্যার পি এস সি র সদস্যের দিকে তাকিয়ে একটা লাজুক হাসি দিলেন ।
-ক্যারিয়ার কিসে করবা ?
- স্যার ই এন টি তে ইচ্ছা আছে ।
এরপর স্যার আর আমি , আমি আর স্যার । কিছু একাডেমিক , কিছু কলেজের গল্প আবার কিছু প্রশ্ন।
উঠে আসার সময় দেখলাম স্যার লিখলেন ১৪০ ।
সালাম দিয়ে বের হয়ে এলাম ।
এই প্রথম সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ কে নিয়ে মন থেকে গর্ব হল । এখান থেকে অনেক না পাউয়ার বেদনা ছিল । ছিল অনেক হতাশা । ছিল কত রকমের অভিমান ।
অভিযোগের অন্ত ছিল না । সব অভিযোগ যেন এক নিমেষেই শেষ হয়ে গেল ।
আমার জিবনের অনেক বড় বড় প্রাপ্তির নিয়ামক হয়ে থাকল যে এটি ।
LOVE YOU... SIR SALIMULLAH MEDICAL COLLEGE…..
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।