নড়াইলের পাইকমারিয়া এলাকায় গত ২১ মার্চ পরকীয়া ও পারিবারিক কলহের কারণে রিক্তা বেগম তার দুই বছর বয়সী ছেলে আবদুল্লাহকে পুকুরে চুবিয়ে হত্যা করেন। ৮ এপ্রিল খুলনার পাইকগাছায় দীপঙ্কর দাস নিজ স্ত্রী অনিমা দাস (৪০) ও ছেলে সজীব দাসকে (৭) গলা কেটে হত্যা করে নিজেও বিষপানে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। বগুড়া শহরের মানসিক ভারসাম্যহীন সালমা ইসলাম ২ মার্চ নিজের দুই সন্তান ফাহিম (৫) ও উপমাকে (৭) শ্বাসরোধে হত্যা করে নিজে বাসের নিচে পড়ে আত্মহত্যার চেষ্টা চালান। সম্প্রতি ভোলার দক্ষিণ আইচায় দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে সৃষ্ট পারিবারিক কলহে নিজের চার মাস বয়সী সন্তানকে আবদুস শহিদ শিকদার পানিতে ফেলে হত্যা করেন। ওপরের ঘটনাগুলো থেকে এটি স্পষ্ট- পরকীয়া, পারিবারিক কলহ, মানসিক অশান্তি ক্রমেই মানুষকে সহিংস আচরণের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
এমনকি নৈতিকতাবিবর্জিত কিছু মানুষ এখন নিজের সন্তানকে হত্যা করতে দ্বিধাবোধ করছেন না। ফলে মা-বাবার হাতে খুন হচ্ছে সন্তান। স্বামী হত্যা করছেন স্ত্রীকে, স্ত্রী স্বামীকে। আর ছেলের হাতে খুন হচ্ছেন মা-বাবা। সম্প্রতি ভয়াবহ মাত্রায় এ ধরনের ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড তথা সামাজিক অপরাধ বৃদ্ধি পাওয়ায় উদ্বেগ প্রকাশ করছেন সমাজ ও মনো বিজ্ঞানীরা।
তারা জানান, দেশে ভয়াবহ ব্যাধির মতো দানা বাঁধছে সামাজিক ও নৈতিক অবক্ষয়। এ ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারক মহলের অবহেলাই উদ্বেগজনক। বিশেষজ্ঞরা পরকীয়া, পারিবারিক কলহ, মানসিক অশান্তি ছাড়াও এসব সামাজিক অবক্ষয়ের জন্য বেশ কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে অর্থের প্রতি সব শ্রেণীর মানুষের অসম প্রতিযোগিতা; নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয়; সামাজিক, রাজনৈতিক, ব্যবসায়িক ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতা; দাম্পত্য কলহ, দ্রুত ধনী হওয়ার আকাক্সক্ষা ও মাদকাসক্তি। অন্যদিকে, একের পর এক পরিবারের এক সদস্যের মাধ্যমে আরেক সদস্যের প্রাণহানির ঘটনা বৃদ্ধি পেলেও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত এর কারণ অনুসন্ধানে তৈরি হয়নি নির্দিষ্ট গবেষণা কার্যক্রম। ফলে কার্যকর বিচারব্যবস্থার অভাবে অপরাধীরা অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছেন।
সমাজবিজ্ঞানীরা বলছেন, গত দু-তিন বছরে দেশে এ ধরনের সামাজিক অপরাধের ঘটনা আশঙ্কাজনকহারে বেড়েছে। তাদের মতে, আগামী ১০ বছরে এটি মহামারী আকার ধারণ করবে। তবে মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অধিকাংশ সামাজিক অপরাধের পেছনে বিষণ্নতা দায়ী। দেশে বর্তমানে ৬৫ থেকে ৮৫ লাখ মানুষ অতিমাত্রায় বিষণ্নতায় আক্রান্ত। আর এ কারণে সামাজিক অপরাধ আগামীতে ভয়াবহ রূপ নেবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন।
অন্যদিকে মানবাধিকার কর্মীরা মনে করেন এ অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রে রয়েছে অর্থ। মানুষ অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ক্রমেই হারাচ্ছে। এ কারণে তারা নিজেরা আত্মহত্যা করছে এবং পরিবারের সুরক্ষার কথা ভেবে নিজ স্ত্রী ও সন্তানদেরও হত্যা করছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক অপরাধ প্রতিকারে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সচেতনতা বাড়ানো প্রয়োজন। একই সঙ্গে জেলা পর্যায়ে স্থানীয় প্রশাসনকে এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বাংলাদেশের যুবসমাজের ওপর আচরণগত বেইজ লাইন সার্ভে’ শীর্ষক গবেষণায়ও বেরিয়ে এসছে চমকপ্রদ তথ্য। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের শহর ও গ্রামাঞ্চলে ষাটের দশকের তুলনায় বর্তমানে বিবাহবহির্ভূত ও বিবাহপূর্ব অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার পরিমাণ তিন গুণ বেশি। বর্তমানে প্রতি ১০ জনের মধ্যে তিনজনই অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ছেন। এতে পারিবারিক বিশ্বাসে ফাটল ধরছে। মানুষ তার কাছের মানুষটিকেও হত্যা করছে।
মনোচিকিৎসক ডা. মোহিত কামাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো বিপজ্জনক রোগের লক্ষণ। কোনো ব্যক্তি মানসিক অশান্তিতে থাকলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য সেই ব্যক্তির পরিবারের সদস্যদের উচিত তার চিকিৎসার ব্যবস্থা করানো। না হলে কিছু ক্ষেত্রে রোগী তাৎক্ষণিক তাড়না থেকেও তার পরিবারের সদস্যদের ক্ষতি করতে পারে। সাধারণত ত্র“টিপূর্ণ ব্যক্তিত্বের অধিকারী ও মাদকাসক্ত ব্যক্তিরা এ ধরনের ঘটনা ঘটান। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. এ এস এম আমানউল্লাহ এ সম্পর্কে বলেন, এখন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিরাজ করছে অসম প্রতিযোগিতা।
ধনী হওয়ার স্বপ্নে বিভোর একটি শ্রেণী তাদের মূল্যবোধ হারাচ্ছে। এতে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা তৈরি হচ্ছে। সব মিলিয়ে সামাজিক, রাজনৈতিক, মিডিয়া, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ব্যবসা ও সাংস্কৃতিক অস্থিরতায় মানুষ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। দেশে সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বা উন্নতিতে কোনো পূর্বপরিকল্পনা নেই। সামাজিক অপরাধ ধীরে ধীরে সমাজকে কাবু করে ফেলছে।
এখনই যদি এ বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি করা না যায় তবে আগামী ১০ বছরে তা ভয়াবহ সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হবে। বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস অ্যাসোসিয়েশনের নির্বাহী, মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খান এ বিষয়ে বলেন, যে মানুষ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী নন তারাই সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন। যখন একজন মানুষের অর্থনৈতিক চাপ সহ্য করার ক্ষমতা ভেঙে পড়ে তখনই তিনি নিজে আত্মহত্যা করেন এবং পরিবারের ক্ষতি করতে চান। সমাজে পরকীয়ার ঘটনাগুলোর পেছনেও অর্থনৈতিক কারণ জড়িত। গ্রামের সভা বা মিটিংয়ে কাউন্সিলর (মেম্বার) যে কোনো পরিবারের সমস্যা নিয়ে আলাপ করতে পারেন।
এ ছাড়া প্রতি জেলায় ডিসির কল্যাণ ফান্ড থেকেও প্রয়োজনে সাহায্য নেওয়া যেতে পারে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।