লিখতে ভাল লাগে, লিখে আনন্দ পাই, তাই লিখি। নতুন কিছু তৈরির আনন্দ পাই। কল্পনার আনন্দ। বন্ধুকে চেনা
মোহাম্মদ ইসহাক খান
জামান গ্রুপ অফ ইন্ডাস্ট্রিজের স্বত্বাধিকারী আশিকুজ্জামান, যার ডাকনাম আশিক, সে আরামদায়ক চেয়ারটিতে বসে ল্যাপটপে নিজের কাজ করছিলো। সুপরিসর সাজানো-গোছানো অফিসরুম, ঝকঝকে তকতকে, কোথাও একরত্তি ধুলো নেই।
বেল টিপলেই হাজির হবে কফি কিংবা চা। একটু পর পর টেবিলে রাখা তিনটে টেলিফোনের একটা না একটা বেজে উঠছে, আশিকের দম ফেলবার ফুরসৎ নেই। কখনো দুই কানে দুটো টেলিফোন নিয়েও তাকে কথা বলতে হয়, দুটো ভিন্ন ভিন্ন পার্টির সাথে।
দরজাটা একটু ফাঁক হয়ে গেলো। একটা মুখ উঁকি দিলো ভেতরে।
আসবো?
মাথা তুলে দেখল আশিক। মুখে হাসি ফুটল সাথে সাথে। আরে, ফয়সাল যে। আয় আয়, ভেতরে আয়।
নিজের সবচেয়ে অন্তরঙ্গ বন্ধুটিকে বরণ করে নিতে আশিক চেয়ার ছেড়ে উঠে যায়।
জড়িয়ে ধরে ফয়সালকে।
কোলাকুলি শেষ হলে ফয়সাল বন্ধুর সাথে হ্যান্ডশেক করলো। বোস্ এখানে, বলে সাথে সাথে কফি আনতে বলে দেয় আশিক।
তারপর, কী খবর বন্ধু? কেমন চলছে তোর? বাবার বিশাল কোম্পানি তো দুই হাতে ভালোই টেনে নিচ্ছিস। তোর লোকেরা তো আমাকে উপরে আসতেই দিতে চাইছিল না, বলল ফয়সাল।
আর বলিস না, উটকো লোকজন এসে সময়ে-অসময়ে বিরক্ত করে, তাই এই ব্যবস্থা। আমার খবর? কাজের চাপ অসম্ভব। আর এদিকে আমার বয়স কম, কাজেই সবাই ভাবে আমি বাচ্চা ছেলে, সবাই উপদেশ গছাতে চেষ্টা করে। গলার স্বর নিচু করে ষড়যন্ত্রীদের মতো কণ্ঠে বলে সে, বাবা মারা যাওয়ার পরপরই আমি যদি হাল না ধরতাম, তাহলে এতদিনে লালবাতি জ্বলে যেত, বুঝলি?
দরজায় নক হয়। কফি এসে গেছে।
ফিটফাট পোশাক পরা সুদর্শন এক যুবক এসে ট্রে-সহ কফি নামিয়ে রেখে যায়।
বাহ্, তোর কোম্পানিতে তো দেখি এলাহি কারবার। ফয়সাল মুগ্ধ হয়ে দেখছে সবকিছু।
একটা কোম্পানি চালানোর অনেক ঝক্কি, বুঝলি? উপর থেকে দেখেই যা ফিটফাট বলে মনে হয়, ভেতরে সদরঘাট। হতাশ গলায় বলে আশিক।
আমার কথা বাদ দে, তোর কথা বল্। ভাবী কেমন আছে?
ভালোই। শুধু বড় মুখরা। এটা-সেটা নিয়ে খিটিমিটি লেগেই আছে।
আশিক উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।
আরে, বিয়ে করেছিস, বউয়ের ধমক খাবি না, তা কী করে হয়? আমারও তো একই অবস্থা দোস্ত। এখানে আমি যত বড় পোস্ট নিয়েই বসে থাকি না কেন, বাড়িতে ভেজাবেড়াল, একটা কথা মাটিতে পড়ার উপায় নেই, একেবারে তুলোধুনো করে দেয়। ধোঁয়া ওঠা গরম কফিতে চুমুক দিলো আশিক।
এখন বল্, তোর তো দরকার ছাড়া টিকিটাও দেখা যায় না। নিশ্চয়ই কোন দরকারে এসেছিস? বন্ধুকে খোঁচা মারল সে।
ফয়সালকে একটু লজ্জিত দেখায়। তুই খুব বিরক্ত হোস, তাই না?
আশিক বলে, ধানাইপানাই বাদ দিয়ে আসল কথা বল্, নইলে নাক বরাবর মারবো একটা ঘুষি।
ফয়সাল বলে, লোনের একটা ব্যাপার।
কীসের লোন?
একটা কোম্পানি খুলেছি, শুনিস নি বোধহয়। এখন ব্যবসার লেজে-গোবরে দশা।
ইমিডিয়েট একটা বড় অ্যামাউন্ট না পেলে পথে বসতে হবে, বুঝলি? আমি ব্যাঙ্কে অ্যাপ্লাই করেছি, কিন্তু কিছুতেই স্যাংশান করছে না ব্যাটারা।
কত টাকার অ্যাপ্লাই করেছিস?
এক কোটি।
বলিস কী? দু-চোখ আলুর মতো গোল হয়ে কপালে উঠে যায় আশিকের, এক কোটি?
হ্যাঁ। তাতেই তো এত ভেজাল। এখন তুই ভরসা।
ওপর মহলে তোর যোগাযোগের খবর আমি জানি। তুই একটু বলে দিলেই বাপ বাপ করে ম্যানেজার লোন স্যাংশান করে দেবে। তোর বাবার নামে এখনো অনেকে ভিরমি খায়।
আশিককে চিন্তিত দেখায়। খানিকক্ষণ ভাবে সে।
হঠাৎ আশিকের হাত জড়িয়ে ধরে ফয়সাল। বন্ধুর এই উপকারটা কর্, আশিক। আমি তোর কেনা গোলাম হয়ে থাকবো।
আশিক অবশেষে বলল, ঠিক আছে, আমি ব্যাপারটা দেখছি। তোর লোনের বন্দোবস্ত আশা করি হয়ে যাবে।
কথা দিতে পারছি না, তবে চেষ্টা করে দেখবো। কিন্তু খবরদার, আমি এটার পেছনে আছি, কাউকে বলবি না কিন্তু।
ফয়সালের বুক থেকে যেন একটা পাথর নেমে গেলো, বাঁচালি বন্ধু। কত বড় উপকার করলি, তুই নিজেও জানিস না।
আশিক আবার বলে, আমি কিন্তু বলে রাখছি, কথা দিতে পারছি না।
লোন না পেলে আবার আমাকে দোষ দিতে পারবি না।
তুই বলেছিস, চেষ্টা করবি, এতেই কাজ হয়ে গেছে। তোকে আমি চিনি না?
খুব তেল মারছিস?
হাসল ফয়সাল। আচ্ছা, আজ আসি বন্ধু, বলে হঠাৎ চেয়ার ছেড়ে উঠে পড়ে সে।
সে কী? লাঞ্চ আওয়ার হয়ে গেছে, খাবি না? চল্ একসাথে লাঞ্চ করা যাক।
ঘড়ি দেখে বলল ফয়সাল, না রে, আজ একটু তাড়া আছে। একদিন এসে জমিয়ে গল্প করবো, খাওয়াদাওয়া সব হবে।
ভাবীকেও নিয়ে আসিস কিন্তু, অনেকদিন কথাবার্তা হয় না।
ঠিক আছে। চলি তাহলে।
ভাবীকে আমার সালাম দিস।
আচ্ছা। বাই।
ফয়সাল দরজাটা ঠেলে বেরিয়ে যায়।
আশিক গুম হয়ে নিজের চেয়ারে বসে আছে।
দীর্ঘ সময় ধরে সেই দরজার দিকে তাকিয়ে আছে, যে দরজা দিয়ে ফয়সাল বেরিয়ে গেছে। যেন কাঠের ভারী দরজাটাই কোন দোষ করেছে।
একটা খটকা, একটা অসামঞ্জস্য টের পেয়েছে সে, কিন্তু কী সেই খটকা, ধরতে পারছে না।
চোখমুখ কুঁচকে ভাবতে চেষ্টা করে সে, ভাবনার গভীরতায় তার দু'চোখ বন্ধ হয়ে আসে।
পুরো পাঁচ মিনিট ভাবার পর সে ধরতে পারে সমস্যাটা কী।
ফোনটার দিকে হাত বাড়ায় সে।
***
এক সপ্তাহ পর। একজন প্রতারক ফয়সালের নাম করে আশিকের কাছে এসেছিলো, ভুয়া কোম্পানির অ্যাকাউন্টে এক কোটি টাকা ঋণের বন্দোবস্ত করে দেওয়ার তদবির করতে। আশিক লোনের ব্যবস্থা করেছিলও। কিন্তু সে কী করে একটা সামান্য খটকা থেকেই যেন ধরে ফেললো, সেই প্রতারক ফয়সাল নয়, হুবহু ফয়সালের মতো দেখতে আরেকজন মানুষ।
এমন ব্যাপার সচরাচর দেখা যায় না, কাজেই সবাই খুব অবাক হয়েছে।
হাতকড়া পড়া ফয়সালের "ডামি" বলল, তুমি কী করে বুঝলে, আমি আসল ফয়সাল নই?
আশিক বলল, আমি আমার বন্ধুকে চিনবো না, তা কী করে হয়? দেরীতে হলেও বুঝতে পেরেছি যে ঘাপলা আছে। প্রথমত, তুমি আমাকে বারবার "বন্ধু" বলে সম্বোধন করেছ, যেটা কখনো ফয়সাল করতো না। সে আমাকে ডাকতো "দোস্ত" বলে, যেমনটা আমি ফয়সালকে ডেকে থাকি। তাছাড়া তুমি কোলাকুলি করার পর আমার সাথে হ্যান্ডশেক করেছিলে, সেটাও ফয়সাল কখনো করতো না।
সে কোলাকুলি করে আমার ডান কাঁধে আলতো করে একটা ঘুষি মারত।
নকল ফয়সাল মাথা নিচু করে।
আশিক আবার বলল, বন্ধুর চেহারা, গলার স্বর, আচরণ সব নকল করা যায়, তার সব বৃত্তান্ত জেনে নেয়া যায়, কিন্তু এসব খুঁটিনাটি আসল বন্ধু ছাড়া আর কেউ জানতে পারে না, তুমিও পারো নি।
পুলিশ লোকটিকে ভেতরে নিয়ে যায়। প্রচলিত আইনে প্রতারণার সাজা হবে তার।
***
"আসল ফয়সালের" সাথে সস্ত্রীক বসে বসে গল্প করছে আশিক, তার স্ত্রী কাজল, ফয়সালের স্ত্রী রেশমার সাথে বেশ বন্ধুত্ব পাতিয়ে নিয়েছে। এক সপ্তাহ আগে ঘটে যাওয়া কাহিনীটি শুনে ফয়সালের মুখ হাঁ হয়ে গেছে। সে বলল, সত্যি বলছিস, দোস্ত?
আশিক হাসল। ফয়সাল তাকে "দোস্ত" বলে ডাকছে, সে যে আসল ফয়সাল, তাতে আর কোন সন্দেহ নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।