চিত্ত যেথা ভয়শূন্য আজকে একজন বিদেশী বন্ধু ফোন করেছিলো। ফোন ধরতেই তাঁর কণ্ঠে সহানুভূতি ঝরে পড়লো। সে বলল, আমি জানি তোমাদের ওখানে গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ধ্বসে প্রায় ৪০০ শ্রমিক মারা গেছেন, তোমার দেশবাসীর জন্য আমার আন্তরিক সমবেদনা, তোমাদের গার্মেন্টস সেক্টরে তো আগেও এমন অনেক দুর্ঘটনা হয়েছিলো? আমি বললাম, ধন্যবাদ তোমাকে, তবে এটা গার্মেন্টস দুর্ঘটনা নয়। একটা বহুতল ভবন ধ্বসে পড়েছে, সেই ভবনে কয়েকটা গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি ছিল, ভবনটিতে একটা শপিং মল ও ছিল, ব্যাংক ছিল, কিন্তু সেদিন শপিং মল আর ব্যাংক বন্ধ ছিল। আমরা একটা দ্রুত প্রবৃদ্ধিশীল দেশ এবং গার্মেন্টস আমাদের প্রধান শিল্প, কিছু কিছু দুর্বলতা এখনো আছে যে কারণে এমন দুঃখজনক দুর্ঘটনা ঘটছে, তবে আমরা সবাই মিলে এমন ব্যবস্থা নিচ্ছি যেন ভবিষ্যতে এমন ঘটনার মুখোমুখি হতে না হয়।
একটা বিষয় মনে হয় আমরা বারবারে ভুল করি। কোন একটা সমস্যাকে মোকাবেলা করতে হলে সেটাকে আইসোলেট করতে হয়, আমরা সমস্যা মোকাবেলা করতে যেয়ে সেটাকে জেনারেলাইজ করে ফেলি। একজন বিবেকহীন ডাক্তার দেখলে বলে ফেলি “ডাক্তাররা” কসাই, আমরা বলতে পারিনা “এই ডাক্তারটা কসাই”। আবেগের আতিশয্যে “ডাক্তাররা” বলে ফেলায় সেটা আমাদের সবার গায়ে লেগে যায়। আমরা সবাই মিলে নিজের মর্যাদা রক্ষার জন্য প্রতিবাদ করতে থাকি আর সত্যিকারের “কসাই গুলো” দাঁত কেলিয়ে হাসে।
আইসোলেট করতে না পারায় কসাই” গুলো পার পেয়ে যায়। অথচ হয়তো আমরা বেশীরভাগ ডাক্তারই চাইছিলাম এই বিবেকহীনটা শাস্তি পাক।
একইভাবে কিছু নন কমপ্লায়েন্ট গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি নিয়ে আমরা যদি বলতে থাকি বাংলাদেশের গার্মেন্টস মালিকেরা হৃদয়হীন আর বেপরোয়া, তাহলে কী এটা সত্য কথন হবে? আমাদের যে ফ্যাক্টরি গুলো কমপ্লায়েন্ট সেগুলো কী দোষ করেছে? শ্রমিক বিক্ষোভের শেষ লক্ষ্য হয়ে যাচ্ছে কোন না কোন গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি, এর মধ্যেই ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটা ফ্যাক্টরি, আগুনেও পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে কমপক্ষে দুটো ফ্যাক্টরি। এসব কেন? গার্মেন্টস শিল্প ধ্বংস হয়ে গেলে আমরা বাঁচবো? কয়েকটা নন কমপ্লায়েন্ট ফ্যাক্টরির দায় কেন পুরো শিল্প খাত নেবে? গার্মেন্টস শিল্পের নেতাদেরও আত্ম অনুসন্ধান করতে হবে পোষাক শিল্পে ভাল মালিক, ভালো ফ্যাক্টরি থাকা সত্তেও, কেন তারা ভাল ভুমিকা নিতে পারে না, বার বার সতর্কবাণী উচাচারণ করার পরও কেন পোশাক শিল্পে একটার পর একটা দুর্ঘটনা ঘটে, কেন বিজিএমইএ অপরাধী জেনেও অনেক মালিককে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেয়। এই ঘটনাগুলোই হয়ে উঠেছে এই পোষাক শিল্প নামক প্রতিষ্ঠিানটির সেন্ট্রাল টেন্ডেনসি।
মানুষ এটাকেই পর্যবেক্সণ করে রিএক্ট করে।
হয়তো সেকারণেই এমন দুর্ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় আমরা যা করছি সেটা রেসপন্স নয় সেটা হয়ে উঠেছে রিয়াক্সন। রেসপন্স ভবিষ্যৎে একই ধরণের সমস্যাকে মোকাবেলা করার সামর্থ্য তৈরি করে, আর রিয়াক্সন আমাদের পিছিয়ে দেয়। বরং আমাদের এই আবেগকে কাজে লাগিয়ে তৈরি করি আরো উন্নত নিরাপদ কর্ম পরিবেশ, গার্মেন্টস শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন, বর্ধিত মজুরির এবং শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষা। এবং সর্বোপরি নিশ্চিত করি দায়ী গার্মেন্টস মালিকদের জবাবাদিহিতা এবং শাস্তি।
এসব কিছুর পাশাপাশি রাজনৈতিক নেতৃত্বের অন্তর্দৃষ্টি বাড়াতে হবে। কারই কেন জানি কোন ভিসন নাই। এত বছরে, গার্মেন্টস এর একটা মন্ত্রনালয় তৈরি হয়নি। রেশম অধিদপ্তর করে গেছে ব্রিটিশরা কিন্তু গার্মেন্টস এর মন্ত্রনালয় তো দুরের কথা কোনো অধিদপ্তর ও হয়নি। সবচেয়ে বড় শিল্পখাতের জন্য রাষ্ট্রীয় গুরুত্ব কতটুকু আছে সেটা বুঝতে হলে এই উদাহরণ টা যথেষ্ট।
ট্রেড ইউনিয়ন নিয় আমাদের প্রধান শঙ্কা তৈরি হয়েছে সরকারী শিল্পে ট্রেড ইউনিয়নের বিব্রতকর অভিজ্ঞতা থেকে। এর কারণ সরকারী শিল্পে ট্রেড ইউনয়নে চেক এন্ড ব্যালান্স ছিলনা। সরকারী শিল্প বছরের পর বছর বিপুল ক্ষতি গুনেও লে অফ হয়নি, জনগণ এর টাকায় কোটি কোটি টাকা লস দিয়ে চালিয়ে যাওয়া হয়েছে বছর এর পর বছর । কিন্তু, পোশাক শিল্পের বিনিয়োগ রাষ্ট্রীয় নয় ব্যাক্তিগত এবং ফিনান্স পুঁজির, এখানে শ্রমিকেরও একটা ঝুঁকি থাকে যে, মালিক লাভ করতে না পারলে, ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাবে। ফলে দেখা যাবে যে, একটা সময় দুই পক্ষ ভারসাম্য মুলক একটা অবস্থানে পৌঁছাবে যা শিল্প এবং শ্রম মুখী হবে।
সরকারি ফ্যাক্টরির ট্রেড ইউনিয়নের খারাপ অভিজ্ঞতার কথা বলে গ্রাম থেকে আসা অরক্ষিত নারি শ্রমিকদের মালিক পক্ষের সীমাহীন লোভ এর মুখে বছর এর বছর অধিকারহীন ভাবে দমিয়ে রাখার দিন শেষ। ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রতিষ্ঠা করলে,একটা ফেয়ার বারগেন এর প্রেক্ষাপটে আমাদের পোশাক শিল্প নতুন শক্তি অর্জন করবে, শ্রমিক অধিকার উন্নত হবে এবং বহির্বিশ্বে এই শিল্পের ভাবমূর্তি বাড়বে। আজকের প্রেক্ষাপটে এটাই হয়ে উঠতে পারে সঠিক রেসপন্স।
সারা দেশ তাকিয়ে ছিল উদ্ধার পর্বের শেষ দিকে সেলাই দিদি শাহিনাকে বাঁচানোর জন্য। শাহিনাকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি।
এই শাহিনা শুধু মাত্র রানা প্লাজায় প্রান হারানো অজস্র মৃত মানুষের মুখ নয়, শাহিনার জীবন দিয়ে বাংলার মুখ কে দেখে যায় । শাহীনার গল্প আমাদের বাংলার গল্প। যেখান আছে ১৬ কোটি সাধারণ মানুষ যারা অদম্য প্রাণ শক্তি এবং পরিশ্রম। স্বপ্ন একটাই তাঁর পরিবার এর জন্যে দু মুঠো ভাত, পরনের কাপড় আর মাথার উপরে একটা আচ্ছাদন। তবুও শাহিনারা সেই ন্যূনতম প্রত্যাশার জীবন নিশ্চিত করতে পারেনা।
আমরা চাইলেও শাহিনাদের বাঁচাতে পারিনা। শাহিনার গল্প জাতি হিসেবে আমাদের বার বার জিততে জিততে হেরে যাওয়ার গল্প। গার্মেন্টস শিল্প যে বিজয়ের সুচনা করতে পারতো সেটা কী জিততে জিততে আবারো হেরে যাবে? আর এই শিল্পকে বিজয়ী করতে পারে সরকার আর শিল্প মালিকেরা যৌথ ভাবে। আমরা সেই সঠিক রেসপন্সের অপেক্ষায় আছি।
কৃতজ্ঞতা: বন্ধু জিয়া হাসানের কিছু প্রাসঙ্গিক ভাবনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।