সরকারের পাঁচটি সংস্থার কাছে এখন রাজধানীর ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের পাঁচটি তালিকা আছে। ভবনগুলোর শ্রমিক-কর্মচারী ও বাসিন্দাদের নিরাপত্তায় দ্রুত ঝুঁকি কমানোর আশ্বাসও সরকার দিয়েছিল। কিন্তু কোনো উদ্যোগই শেষ পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি।
মারাত্মক দুর্ঘটনা এবং ব্যাপক প্রাণহানির পর বিভিন্ন সময়ে তোড়জোড় করে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর এসব তালিকা করা হয়েছিল। কিছুদিন এসব ভবনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে চিঠি চালাচালিও চলেছে।
কিছু কিছু ব্যবস্থাও নেওয়া হয়। কিন্তু পরিস্থিতি শান্ত হলে থেমে যায় সবকিছু। রানা প্লাজা ধসের পর আবার শুরু হয়েছে সরকারি তোড়জোড়।
২০০৪ সালে শাঁখারীবাজারে ভবনধসের পর ঢাকা সিটি করপোরেশন (ডিসিসি) থেকে ৫৫৮টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করা হয়। ২০০৫ সালে তেজগাঁও এলাকার ফিনিক্স ও সাভারের স্পেকট্রাম ভবনধসের পর শিল্প মন্ত্রণালয় থেকে ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা ভবনের তালিকা করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
সেই সিদ্ধান্ত আর বাস্তবায়িত হয়নি।
২০০৯ সালে ত্রুটিপূর্ণ নির্মাণের কারণে রাজধানীর তেজগাঁওসহ বিভিন্ন এলাকায় একাধিক ভবন হেলে পড়ে অনেক মানুষ আহত হয়েছিল। এ নিয়ে রাজধানী জুড়ে আতঙ্ক তৈরি হলে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) জরিপ চালিয়ে ৩২১টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে।
আবার ২০১০ সালে নিমতলীতে রাসায়নিক গুদামে অগ্নিকাণ্ডের পর ১২৮টি গুদাম ও ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ঢাকা জেলা প্রশাসক ও বিস্ফোরক অধিদপ্তর যৌথভাবে এসব ভবনের তালিকা করে।
২০১২ সালের নভেম্বরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেডে অগ্নিকাণ্ডের পর শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কারখানা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়। এ সময় প্রায় ৯০০ কারখানায় নিরাপত্তা নেই বলে চিহ্নিত করা হয়। আর সর্বশেষ সাভারে রানা প্লাজা ভবনের দুর্ঘটনায় পাঁচ শর বেশি লোকের মৃত্যুর পর তৈরি পোশাক কারখানার মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ ঝুঁকিপূর্ণ পোশাক কারখানা চিহ্নিত করার উদ্যোগ নিয়েছে। সরকারও পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, আগে যে ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, তা এবারও নেওয়া হচ্ছে।
এতে দুঃখজনক দুর্ঘটনা বন্ধ হবে না। তিনি মনে করেন, ইমারত নির্মাণ বিধিমালা বাস্তবায়নের জন্য রাজউককে জরুরি ভিত্তিতে কাজ শুরু করতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনীয় জনবল নিয়োগ দিতে হবে এবং পেশাজীবী সংগঠনগুলোকেও তা তদারকির সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। তাহলে ভবন দুর্ঘটনাসংক্রান্ত সমস্যাগুলো কমে আসবে।
কার কী দায়িত্ব: ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিরুদ্ধে কারা ব্যবস্থা নেবে, তা নিয়েও সরকারের দুই সংস্থা একে অপরের ওপর দায় চাপাচ্ছে।
রাজউক ও ডিসিসি ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের তালিকা করে একে অপরের কাছে পাঠিয়েছে। ডিসিসি থেকে সম্প্রতি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন-মালিকদের চিঠি দেওয়া হলেও তারা এখন পর্যন্ত কোনো ভবন-মালিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়নি। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার এখতিয়ার কার, তা নির্ধারণ করতে ডিসিসি থেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠিও দেওয়া হয়েছে।
রাজউকের প্রধান প্রকৌশলী এমদাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীতে যেসব ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত হয়েছে, তার বেশির ভাগের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দায়িত্ব ঢাকা সিটি করপোরেশনের। তারা সেই দায়িত্ব পালন না করায় একের পর এক দুর্ঘটনা ও সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
ফলে তাদের উচিত নিজেদের দায়িত্ব পালন করা। তাতেই অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।
এ বিষয়ে ডিসিসি দক্ষিণের প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা-২০০৯ অনুযায়ী ভবনের নকশা অনুমোদন থেকে শুরু করে সব নিয়ম মানা হচ্ছে কি না, তা দেখার দায়িত্ব রাজউকের। তারাই ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভাঙার আইনি অধিকার রাখে। স্থানীয় সরকার আইনে আমাদের এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হয়নি।
ফলে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলোর বিরুদ্ধে রাজউককেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ’
সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এবং দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার কারণেই দুর্ঘটনা কমানো যাচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মনে করছে। আবার ভবন-মালিক রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতাশালী বলেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ এই তিন কারণেই দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ভবনধসের ঘটনা ঘটল এবার সাভারে।
বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিসের (বিলস) হিসাবে গত এক যুগে বিভিন্ন শিল্পকারখানায় দুর্ঘটনায় ছয় হাজার ৪০৬ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে।
বিলসের হিসাবে ২০০০ সালে যেখানে শ্রমিকের মৃত্যুসংখ্যা ছিল ৩০১ জন, সেখানে ২০১২ সালে এসে তা তিন গুণ বেড়ে ৯০৬ হয়েছে।
একের পর এক দুর্ঘটনা: ২০০৪ সালের ৯ জুন গভীর রাতে পুরান ঢাকার শাঁখারী বাজারের একটি ভবন ধসে একই পরিবারের নয়জনের মৃত্যু হয়। এ সময় ৩০ জন আহত হন। রাজউক ও ডিসিসি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করতে একটি কারিগরি কমিটি গঠন করে। কমিটি প্রাথমিকভাবে সারা দেশে ৫৫৮টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে।
এসব ভবন বসবাসের অনুপযোগী ঘোষণা করে তা খালি করার নির্দেশও দেয় ডিসিসি। তোড়জোড়ের কারণে ছয়টি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ভেঙে নতুন করে নির্মাণ ও ১০টি ভবন মেরামত করা হয়। তার পরই থেমে যায় সব ধরনের উদ্যোগ।
২০০৫ সালের ১১ এপ্রিল সাভারের স্পেকট্রাম ভবনের শাহরিয়ার সোয়েটার্স কারখানার ৬৪ জন শ্রমিকের মৃত্যু ও ৮০ জন আহত হন। ২০০৬ সালে তেজগাঁও শিল্প এলাকায় ফিনিক্স গার্মেন্টস কমপ্লেক্সের পাঁচতলা ভবনধসে ২১ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার পর স্পেকট্রাম ভবনের মালিককে কেবল দেড় মাস হাজতে থাকতে হয়েছিল, কিন্তু কোনো সাজা হয়নি। ওই দুই দুর্ঘটনার পরও সরকারের কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর ও রাজউক থেকে তদারকি বাড়ানোর উদ্যোগ চলে। একপর্যায়ে তা-ও থেমে যায়।
২০১০ সালের ২ জুন পুরান ঢাকার নিমতলীতে রাসায়নিকের গুদামে আগুন লেগে ১২৪ জনের মৃত্যু হয়। ওই ঘটনার পরের দিন জাতীয় শোক দিবসও ঘোষণা করা হয়।
ঢাকা জেলা প্রশাসক ও বিস্ফোরক অধিদপ্তর থেকে ১৮০টি ভবন থেকে রাসায়নিকের গুদাম সরিয়ে ফেলানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
২০১০ সালের অক্টোবরের মধ্যে গুদামগুলো সরানোর নির্দেশ দেওয়ার পরও পুরান ঢাকায় লালবাগ, সূত্রাপুর, শ্যামনগর, কোতোয়ালি এলাকা থেকে এখনো গুদাম সরানো হয়নি। গুদামগুলোর ওপরের ভবনে ঝুঁকির মধ্যে এখনো বসবাস করছে হাজারো মানুষ।
গত নভেম্বরে আশুলিয়ায় তাজরীন ফ্যাশনসে আগুন লেগে ১১২ জন শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ওই কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেন বহাল তবিয়তে আছেন।
সরকারি তদন্ত কমিটি তাঁকে দায়ী করলেও কোনো ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। এখনো অনেক শ্রমিক ক্ষতিপূরণ পাননি।
তাজরীন দুর্ঘটনার পর কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর থেকে দুই হাজার ৩৮১টি কারখানা পরিদর্শন করা হয়। পরিদর্শনে প্রায় ৯০০ কারখানা পাওয়া যায়, যারা শ্রম আইন, কারখানা আইন ও ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ভঙ্গ করে কারখানা পরিচালনা করছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০০ কারখানা কর্তৃপক্ষ কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তরের লাইসেন্স ছাড়াই পরিচালিত হচ্ছে।
এমনকি বিজিএমইএ-ও একটি টাস্কফোর্স করে ভবন পরিদর্শনের কাজ শুরু করেছিল। কিন্তু লোক দেখানো সেই টাস্কফোর্সের আর কোনো খবর নেই।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, মালিকেরা নিজেদের রক্ষা করতে এ ধরনের কর্মসূচি হাতে নিলেও পরিস্থিতি শান্ত হলে তাঁরাও আবার যেনতেনভাবে মুনাফা করতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। আবার সরকারও নানা মহলের চাপে পড়ে কিছু উদ্যোগ নেয়। ফলে শেষ পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপই দু-তিন মাসের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।
এর ফলে দুর্ঘটনা, বিপর্যয় ও প্রাণহানিও বন্ধ হয়নি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।