চোখ কেড়েছে চোখ ,উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক...।
আমার ভারত ভ্রমণ --১ম পর্ব (( কালের কপোলে শিশির বিন্দু, তাজমহল-আগ্রা ))
আমার ভারত ভ্রমণ -২য় পর্ব ((আগ্রা ফোর্ট +ফতেপুর সিক্রি ))
আয়তনের বিচারে ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের বৃহত্তম রাজ্য রাজস্থান। শতদ্রু-সিন্ধু নদীর উপত্যকা বরাবর প্রসারিত থর মরুভূমি এই রাজ্যের অধিকাংশ অংশ জুড়ে রয়েছে।
রাজস্থান রাজ্যের রাজধানী জয়পুর। আগ্রা থেকে পশ্চিমে ২০০ কি.মি. দুরে অবস্থিত।
১৭৪৭ সালে মহারাজা দ্বিতীয় সোয়াই জয় সিং শহরের পত্তন করেন। রাজার নাম থেকেই শহরের নাম হয় জয়পুর। ভারতবর্ষের প্রথম যে কয়েকটি শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছিল জয়পুর তাদের মধ্যে অন্যতম।
(ট্রেনের জানালা দিয়ে রাজস্থান)
গর্বের বিষয়,বিদ্যাধর ভট্টাচার্য নামের একজন বাঙ্গালী স্থপতি জয়পুর শহরের ডিজাইন তৈরী করেন প্রচীন হিন্দু স্থাপত্য ও শিল্প-শাস্ত্রের অবলম্বনে।
********** জয়পুর ***********
সকালে আমাদের ট্রেন থামল জয়পুর ষ্টেশনে ।
জয়পুর এর আরেক নাম ‘পিঙ্ক সিটি’। ১৮৫৩ সালে প্রিন্স অফ ওয়েলস-এর জয়পুর সফরকে স্বাগত জানাতে আতিথ্যের নিদর্শন স্বরূপ শহরের সব বাড়িঘর গোলাপি রঙ করা হয় । সেই থেকে এই নামকরণ ।
( জয়পুর ষ্টেশন )
টিভি তে দেখে কিংবা বই পড়ে রাজস্থানিদের যেমন করে কল্পনা করে নিয়েছিলাম --মেয়েদের দুহাতের কনুই অব্দি শাঁখা-চুড়ি,জমকালো কাঁচ বসানো ঘাঘরা,নানা ধাতুর গয়না পরা থাকবে। আর পুরুষেরা হবে জাঁকালো লম্বা গোঁফ,খাটো ধূতি-ফতুয়া ওয়ালা ।
ভোরবেলা স্টেশনে নেমেই আশেপাশের মানুষ গুলোর মাঝে তেমন কাওকে খুঁজতে শুরু করলাম । কিন্তু নিরাশ হতে হল । বুঝে নিলাম , ঐতিহ্যবাহী পোশাকে ওদের সবসময় দেখা যাবেনা । তবে পুরুষদের কারো কারো মাথায় রাজস্থানি পাগড়ী আর চুন্দ্রি শাড়ীর লম্বা ঘোমটা দেয়া কিছু মেয়ের দেখা মিললো ।
''পদ্মিনী প্যালেস ''-- এটাই ছিল আমাদের হোটেলের নাম ।
নামটা পছন্দ হল আর হোটেলটাও। নিজের রুমে গিয়ে একটু গড়িয়ে নিলাম বিছানায় । প্রথম দিনে কোন সাইট সিয়িং নেই । তাই তাড়াহুড়োও নেই ।
দুপুরে বেশ জমিয়ে খেলাম স্থানীয় রাজস্থানি হোটেলে।
ওরা প্রধানত নিরামিষভোজী। রাজস্থানে সবজীও পাওয়া যায় প্রচুর। ভারতের অনেক প্রদেশের ''থালি'' ই বেশ জনপ্রিয়। ''থালি'' একসাথে অনেক ধরনের খাবারে সাজানো থালা বা প্লেট। আমাদের রাজস্থানি থালির মেন্যুতে ছিল--চানা (ছোলা)র ডালের পরোটা,পাঁচমিশালী সবজী কারি,ডাল বাটটি,পালং পনির,পাঁপড়,রশুনের চাটনি,এক ধরনের সবুজ রঙের দইয়ের শরবত আর সবশেষে মিষ্টি মুখের জন্য চুরমা।
( রাজস্থানি থালি )
ট্রেনের প্যানট্রি কারের সুবাদে পালং পনির আগেও খেয়েছি। তেমন একটা ভাল লাগেনি। যে ওয়েটার আমাদের থালি সার্ভ করছিলেন,তার কাছে জেনে নিয়েছিলাম অপরিচিত খাবার গুলো সম্পর্কে। তবে সাথে ক্যামেরা না থাকায় ছবি তোলা হয়নি। এখানকার খাবারের ছবি গুলো নেট থেকে নেয়া।
খাবারগুলো দারুণ মজার। ওগুলোর সম্পর্কে কিছু না বললেই নয়।
''ডাল বাটটি'' একসাথে দুইটা আইটেমের খাবার। ছোলা বা মুগের ডাল আর সাথে মশলাদার সবজীর পুর দেয়া শক্ত একরকম পাউরুটি। পাউরুটির বৈশিষ্ট্যটা হচ্ছে,এটা কয়েকদিন আগে থেকে বানিয়ে রাখা হয়।
এটা রাজস্থানের মরুভূমি অঞ্চলের খাবার।
( ডাল বাটটি )
''চুরমা'' আসলে লাড্ডু । ময়দা,প্রচুর ঘি আর চিনি দিয়ে বানানো । সাথে থাকে কাজু,কাঠবাদাম আর কিশমিশ ।
( চুরমা )
আমি নিরামিষ খেতে পছন্দ করিনা ।
মিষ্টি তো দু'চোখের বিষ । তবে নতুন জায়গায় গেলে সেই জায়গার স্থানীয় খাবার,তা সে যাই হোক টেস্ট করি অনেক আগ্রহ নিয়ে । রাজস্থানের খাবার গুলো বেশ ভাল লেগেছিল । মাঝে মাঝে এখনও মনে পড়লে আবার চেখে দেখতে ইচ্ছে হয়।
বিকেলে বের হলাম ।
জয়পুর ঘুরে বেড়াবার উৎকৃষ্ট সময় সন্ধ্যায়,যখন সূর্য এর ফিকে লাল ও কমলা রঙের দ্যুতি ছড়ায়। উদ্দেশ্য শপিং ,
তবে যাওয়ার পথে দেখলাম ''গাইটোর'' নামক জায়গায়,মানসাগর সরোবরের মাঝখানে,রাজা সওয়াই প্রতাপ সিং এর তৈরী জলমহল ।
মহলের কাছে যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। রেলিং ঘেরা পাড় থেকেই দেখতে হয়।
গ্রীষ্মকালে একটু শীতল পরিবেশে থাকার জন্যই এই রাজপুত প্রমোদ ভবনটি নির্মিত হয়।
তিনদিকই পাহাড়ে ঘেরা। গোধূলির আলোয় ,লেকের পারে ঠাণ্ডা বাতাসে মন জুড়িয়ে গেল।
( জলমহল )
জল-মহলের ঠিক উল্টোদিকে রাজপরিবারের সমাধি ক্ষেত্র । আর আছে ৬.৫ কি.মি. দুরে নাহারগড় দুর্গ। রাতের বেলায় বিশেষ আলোয় সজ্জিত হলে যার সৌন্দর্য অবর্ণনীয়!
দূরে পাহাড়ের ওপর দেখা গেল ''অম্বর প্যালেস '' ।
অনেকটা চীনের প্রাচীরের মত দেখতে। মনে পড়ল কাল আমাদের সাইট সিয়িং শিডিউলে ওটার নাম দেখেছি।
( মানসাগরের পাড় থেকে আরাবিল্লী পাহাড় আর অম্বর প্যালেস )
রাস্তায় যেতে যেতে ছোট বড় আরও অনেক প্রাসাদ-দুর্গ দেখলাম। কয়েক মিনিটের জন্য গাড়ি থামিয়ে দেখে নিলাম বিশাল এক প্রাসাদ , হাওয়া মহল ।
রাজা সোয়াই প্রতাপ সিং এই অপরূপ প্রাসাদটি নির্মাণ করান।
অবিস্মরনীয় এই স্থাপত্য, যেখানে রাজপুত রমণীদের সয়ম্বর সভা বসতো। বাইরে থেকে দেখলে মনে হয়,এই প্রাসাদে কোন দেয়াল নেই,দরজাও নেই। শুধু সারি দিয়ে সাজানো আছে জানালা ।
( হাওয়া মহল )
বেলেপাথরের জালি পর্দার ৯৫৯টি জানালার আড়াল থেকে পর্দানসীন রাজমহিষীরা বাইরের দুনিয়া দেখতেন। আমার মনে হল,হাওয়া মহলের নামকরণ একদম সার্থক।
ভাবলাম,সবগুলো জানালা দিয়ে বাতাস এলে মহলের ভেতরের অবস্থা কেমন হত!
( বেলে পাথরের জানালাগুলো কি সুন্দর! )
চারপাশ দেখেতে দেখতে যাচ্ছি। উজ্জ্বল স্থাপত্যের সাথে যুক্ত হয়েছে রাজস্থানীদের উজ্জ্বল সাজপোশাক। রাজস্থানের রাজপথে উটচালিত যান,কিংবা বাহারি হাতি খুব সাধারণ ব্যাপার। এদের জীবনযাত্রার সাথে এসব সহজেই মানিয়ে যায়।
আগ্রার মত অত কমার্শিয়াল না হলেও কিছু রাজস্থানি বেশ চালাক।
আমরা উটের সাথে ছবি তুলতে চাই শুনেই বলল ৫০ রূপি করে দিতে হবে। তবে বুঝিয়ে শুনিয়ে রূপি ছাড়াই রাজি করিয়ে ফেললাম। রাজস্থানিরা আসলে বেশ সাদাসিধে,সরল এবং অতিথি পরায়ণ।
উটের সাথে ছবি তোলা তো হোলই ,পেশতা কুলফি,কাজু কুলফি আর মাঠা শরবতের মজা নেয়াও হল । ওদের কুলফি গুলো একটু আলাদা স্বাদের আমাদের চেয়ে।
প্রচুর বাদাম আর শুকনো ফল মিশ্রিত। একটু বেশি মিষ্টি কিন্তু দারুণ মজা খেতে।
তারপর গেলাম নিউমার্কেটে । জয়পুর চুন্দ্রি কাপড়ের জন্য বিখ্যাত ,যেটাকে স্থানীয় ভাসায় বলা হয় '' বাঁধনি কাপড় '' ।
এছারাও নানা উজ্জ্বল রঙের পোষাক,চুড়ি,কাপড়ের পুতুল আরও কতো যে সুন্দর সুন্দর জিনিসে মার্কেট গুলো ভর্তি ! যা দেখি তাই কিনতে ইচ্ছা করে ।
মনে মনে আফসোস করলাম!ইস,কেন আমি বড়লোক না !!!
( রাজস্থান নিউমার্কেট এবং জহুরি বাজারে ঢোকার গেট )
তবে এখানে জিনিস বেশ সস্তা। পুরো ভারতে আর কোথাও এত সস্তা জিনিস পাইনি। চুটিয়ে শপিং করলাম আমরা সবাই । জয়পুরি চুড়ি,কুর্তি,নাগড়া জুতো,পাথরের মালা,রুপার ছোট গয়না রাখার বক্স,পিতলের সিঁদুরদানী । বিশেষ একধরনের পুতুল আছে,রাজস্থানি সংস্কৃতিতে যার আলাদা স্থান।
সেরকম পুতুল কিনবো,আগেই ঠিক করে গিয়েছিলাম। খুঁজে খুঁজে সেগুলোও কেনা হল।
( কাঠের তৈরি রাজা-রাণী পুতুল )
কাঁচ বসানো ঘাঘরা কেনার খুব শখ ছিল আমার। মাঝে মাঝে কিছু নাচের স্টেজ শো করা হয়,সেরকম কোন একটাতে কাজে লেগে যাবে ভেবেছিলাম। অনেক ঘুরেও সেরকম একটা পেলাম না।
অথচ টিভি চ্যানেল গুলোয় এমন পোশাক কি অহরহই দেখা যায়!
সন্ধ্যার পরে গেলাম সিনেমা দেখতে । মজার ব্যাপার,বাংলাদেশের কোন হলে আমার যাওয়া হয়নি। তাই সেই প্রথম আমার হলে গিয়ে সিনেমা দেখা। তবে ভাবতে ভালই লাগলো অভিজ্ঞতাটা হচ্ছে ,''রাজমন্দির'' এর মতে হলে!
( বাইরে থেকে রাজমন্দির )
এশিয়ার বৃহত্তম সিনেমা হল “রাজমন্দির''সুন্দর করে রাজকীয় ভাবে সাজানো হলটা । বিশাল স্ক্রিনে বডিগার্ড সিনেমাটা দেখতে দারুন লাগলো ।
কেউ কেউ অবশ্য ঘুমিয়েও নিলো মনের আনন্দে ।
রাজস্থানের প্রথম দিন,বোনাস কয়েকটি ছবি----->
( জয়পুর শহর,ছোট-বড় এমন পাহাড়ের কমতি নেই )
( চলতি পথে চোখে পড়ে সুন্দর সুন্দর প্রাসাদ,বাড়ি-ঘর )
( জলমহলের সামনে আমরা )
( মানসাগর সরোবর )
( হাতি-ঘোড়া-উট ছাড়া কি রাজস্থান মানায়! )
( রাজমন্দির সিনেমা হল। ভেতরে-বাহিরে আর একটি সুরম্য রাজপুত প্রাসাদ যেন । )
( রাজস্থান দেখবো,অথচ মেহেদী দিয়ে হাত সাজাবো না!তাই কি হয়! )
বেশ রাত হল হোটেলে ফিরতে। তারপরও অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা দিলাম লবিতে সবাই মিলে।
পরদিন সকালে উঠে শুরু হবে আমাদের রাজপ্রাসাদ, উদ্যান, লোককাহিনী, সংগীত আর নৃত্যের বর্ণময় শহর জয়পুর ঘুরে দেখা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।