চোখ কেড়েছে চোখ ,উড়িয়ে দিলাম ঝরা পাতার শোক...।
ঘুরে আসতে পারেন--->
১ম পর্ব (( কালের কপোলে শিশির বিন্দু, তাজমহল-আগ্রা ))
২য় পর্ব ((আগ্রা ফোর্ট +ফতেপুর সিক্রি ))
৩য় পর্ব (( রূপবান রাজস্থান-জয়পুর ))
জয়পুরে আমাদের দ্বিতীয় দিনের সফর শুরু হল সুন্দর,শুভ্র একটা মন্দির দিয়ে। পুরো ভারত জুড়ে ছড়িয়ে থাকা বিড়লা মন্দিরগুলোর একটি জয়পুর বিড়লা মন্দির। আরেক নাম লক্ষ্মী-নারায়ণ মন্দির ।
মহারাজার কাছ থেকে দানস্বরূপ পাওয়া জমিতে ভারতের বিখ্যাত বিড়লা গ্রুপ অব ইণ্ডাসট্রিস এই মন্দির নির্মাণ করে।
আগাগোড়া শুভ্র মার্বেলে গড়া মন্দিরটি মোতি ডাঙ্গুরি নামে ছোটোখাটো এক টিলার ওপরে বানানো ।
( তিন গম্বুজের তলায় তিন ভিন্ন উপাসনালয় )
এটা শুধু নামেই মন্দির। আসলে এখানে তিনটি ভিন্ন ধর্মের উপাসনালয় আছে। অসম্ভব সুন্দর এই উপাসনালয়টি । শ্বেতপাথর কুঁদে নানা পৌরাণিক কাহিনী,ধর্ম গ্রন্থের শ্লোক তুলে ধরা হয়েছে।
আছে রং বেরঙের কাঁচের জানালা । এক একটি জানালায় এক একটি গল্পের অংশ । শুধু দেবদেবী না,সক্রেটিস-কনফুসিয়াস-বুদ্ধ সহ আরও অনেকেই আছেন পাথরের ভাস্কর্য হয়ে ।
মন্দিরের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ , তাই বাইরে থেকেই ক্যামেরায় বন্দী করে রাখলাম স্মৃতি ।
( প্রণামের ভঙ্গিমায় অভ্যর্থনারত নারী মূর্তি )
( ঢুকতেই চোখে পরে শিব মন্দির )
( মহাদেব -শিব )
( শ্বেতপাথরের শৈল্পিক কারুকাজ )
( দেবী মূর্তি শ্বেতপাথরের পিলারে )
এরপর গেলাম সিটি প্যালেসে ।
এখানেও প্যালেসের ভেতরে ছবি তোলা নিষেধ শুনে মন খারাপ হয়ে গেলো । কিন্তু কি আর করা......গাইড নিয়ে ঢুকে পরলাম ভেতরে । ( এখানে সিটি প্যালেসের কিছু ছবি দিলাম,নেট থেকে নিয়ে )
( বাইরে থেকে সিটি প্যালেস ,এটা কিন্তু আমার তোলা ছবি )
এটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহারাজ সওয়াই জয়সিং। ‘সওয়াই’ শব্দের বাংলা অর্থ সোয়া (এক এবং এক তৃতীয়াংশ )।
যিনি সাধারণের থেকে সব দিক দিয়ে সোয়া গুণ বেশি প্রতিভাসম্পন্ন,এমন রাজাই পেতেন ‘সওয়াই’ উপাধি।
( মহারাজা ভবন )
সিটি প্যালেসের সাদা মার্বেলে গড়া সাততলা চন্দ্রমহলে থাকতেন রাজা-মহারাজারা। এখন সেখানে হয়েছে আর্ট গ্যালারি আর মিউজিয়াম। রয়েছে ঘোড়ায় টানা রথ, পালকি,কামান, রাজপোশাক, গয়নাগাটি, অস্ত্রশস্ত্র এমন অনেক কিছু।
( চন্দ্রমহল ও মহলের সামনে আমরা ,গাইডের ক্যামেরায় চুরি করে তোলা ছবি )
এখানে দুটি বিশাল রুপার তৈরি জলের পাত্র আছে,রাজা ভ্রমণের সময় যেগুলোতে গঙ্গাজল সাথে রাখতেন। কথিত আছে,জয়সিং তার পুরো জীবনে গঙ্গা জল ছাড়া অন্য কোন পানীয় পান করেননি।
পাত্র দুটি এর বিশালতার কারণে জায়গা করে নিয়েছে গিনেস বুক-এ।
[
৭ ফিট লম্বা,৪ ফিট প্রস্থ,২৫০ কেজি ওজনের মহারাজা সোয়াই মাধো সিং কী বিশালাকৃতি ছিলেন তা মিউজিয়ামে রাখা তাঁর পোশাকআশাক দেখলেই বোঝা যায় । এমনকি ৫বছর বয়সেও উনি যে প্যান্ট পরতেন সেটার দুই পায়ের মধ্যে দূরত্ব তিন ফিট !
খুব একচোট দুষ্টুমি আর হাসাহাসি করলাম আমরা সবাই সেই পোশাকগুলো দেখে । গাইডও কিন্তু বলতে গিয়ে হেসে ফেললেন । বেচারা মাধো সিং নয় জন স্ত্রী থাকার পরও সন্তানের মুখ দেখতে পারেননি শারীরিক স্থূলতার কারণে।
চন্দ্রমহল ছাড়াও প্রাসাদের অন্যান্য অংশে রয়েছে মুবারক মহল, দেওয়ান-ই-খাস (বিশেষ ব্যাক্তিদের জন্য দরবার) ও দেওয়ান-ই-আম (সাধারন মানুষদের জন্য দরবার) ।
সিটি প্যালেসে অদ্ভুত সুন্দর চারটি প্রবেশ দ্বার আছে,যা চারটি ঋতুর বৈশিষ্ট্যে বিশেষায়িত। গ্রীষ্ম,বর্ষা,শরৎ এবং শীত । রাজারা আলাদা আলাদা ঋতুতে আলাদা আলাদা ভাবে গেটগুলো ব্যাবহার করতেন। এই না হলে রাজা ! এখন অবশ্য শুধু ময়ূর দরওয়াজা খোলা আছে।
[
( গ্রীষ্মকালীন পদ্ম দ্বার )
( ময়ূর দারওয়াজা-বর্ষার জন্য )
( গাঢ় সবুজ রঙের বসন্ত দারওয়াজা )
প্যালেসের উঠোনে রাজস্থানী বাদ্যযন্ত্রে সঙ্গীত শোনানোর ব্যাবস্থা আছে। এই সুযোগ কি হারানো যায় !পুতুল নাচও দেখলাম। বিশেষভাবে তৈরি রাজস্থানি পুতুলের নাচে ছোটোবেলাকে আবার ফিরে পেলাম।
সিটি প্রাসাদের ঠিক পাশেই বিশাল এলাকা নিয়ে অবস্থিত জন্তর-মন্তর, জয়সিংহ নির্মিত পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মানমন্দির। জয় সিংহ প্রতিষ্ঠিত পাঁচটি মান মন্দিরের মধ্যে জন্তর-মন্তর সর্বশ্রেষ্ঠ।
অন্য মানমন্দিরগুলি দিল্লী, বারানসি ও উজ্জয়িনিতে অবস্থিত। এই মানমন্দির প্রমাণ করে জ্যোতির্বিদ্যায় জয় সিংহের অসাধারণ ক্ষমতা। তখনকার দিনের জ্যোতির্বিজ্ঞানচর্চার অন্যতম নিদর্শন এটি ।
সূর্যের উত্তরায়ন ও দক্ষিনায়ন দেখার জন্য এখানে আছে নাড়ীবলয় । ‘বৃহৎ সম্রাট যন্ত্র’ নামে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সূর্যঘড়ি টাও রয়েছে এখানে-মোটামুটি ২ সেকেণ্ডের এদিক-ওদিকে সঠিক সময়ই দেয়।
কিভাবে অদ্ভুত দর্শন সব মার্বেল পাথরের যন্ত্র দিয়ে তখনকার দিনে জ্যোতির্বিদ্যা চর্চা হতো কে জানে !তবে যন্ত্রগুলো খুব ইন্টারেস্টিং ।
( নাড়ীবলয় )
( সম্রাট যন্ত্র-বড় সূর্যঘড়ি )
( ছোট সূর্যঘড়ি )
( জয় প্রকাশ যন্ত্র,এদিক + ওদিক )
প্রত্যেকটা রাশির জন্য এখানে আলাদা আলাদা করে মার্বেল পাথরের স্তম্ভ করা আছে । আমি ''অ্যাকুয়ারিয়াস'' এর সামনে দাড়িয়ে তুলে নিলাম ছবি । অন্যরাও ছবি তুলল যার যার রাশির স্তম্ভের সামনে দাড়িয়ে ।
( রাশি বলয় )
( প্রত্যেক রাশির নাম ও প্রতীক চিহ্নসহ পরিচয় ফলক )
( আমার রাশি স্তম্ভ )
সবার শেষে দেখলাম জয়পুরের প্রধান ভ্রমণ আকর্ষণ।
নগরীর পুরনো অংশে রাজস্থানের প্রচীন রাজধানী অম্বর। জয়পুর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরে রাজপুত রানা অম্বর সিংহ তৈরি করেছিলেন এই গিরি-প্রাসাদ । সম্রাট আকবরের প্রিয় অমাত্য মহারাজা মান সিংহের স্মৃতি বিজড়িত হয়ে আছে এখানে।
এখান থেকেই রানা অম্বর সিংহ মোঘল সম্রাট আকবরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষনা করেছিলেন।
আরাবল্লি পর্বতের ঢালে এক পাহাড় চূড়ায় এই রাজকীয় দুর্গপ্রাসাদ।
( আরাবল্লি পাহাড়ের চূড়ায় অম্বর প্রাসাদ )
চূড়ায় ওঠার জন্য পাহার কুঁদেই তৈরি করা হয়েছিল সিঁড়িযুক্ত আঁকাবাঁকা বহু পাকা সড়ক। সেসব সড়ক দিয়ে জিপে করে দুর্গে পৌঁছাতে সময় লাগে আধ ঘন্টার মত । হাতি বা উটের পিঠে চেপেও জাওয়া যায় । তবে এতজনের জন্য সেই ব্যাবস্থা করা সম্ভব নয় বলেই আমাদের জিপে যেতে হল ।
( পাহাড় ঘুরে যাওয়ার পথে )
আঁকাবাঁকা পথগুলো ঘুরে ঘুরে যাওয়ার সময় খুব উত্তেজনা আর আনন্দ হচ্ছিল ।
যেন বইয়ে পড়া কোনো রূপকথার গল্প আস্তে আস্তে জীবন্ত হয়ে উঠছে
চোখের সামনে। আর হলও তাই !
আম্বার দুর্গ মনোমুগ্ধকর রাজপুত স্থাপত্যের নিদর্শন। নাম শুনে মনে হয় মুসলমান কেল্লা, কিন্তু আম্বর নামটি রাখা হছে আম্বা নামের এক দেবীর নামানুসারে।
( দুর্গের গেট থেকে তোলা ছবি-পাহাড়ের কোলে মন্দির )
মুসলিম, হিন্দু আর রাজপুত স্থাপত্যের অপূর্ব মিশ্রণ এই আম্বর কেল্লা। রংবেরঙের কাঁচের সূক্ষ্ম নকশা করা শিশমহল, জেনানামহল, জয়মন্দির, যশমন্দির, সোহাগমন্দির সবই কি যে সুন্দর,না দেখলে বোঝানো যাবে না ।
রাজপুত রাজাদের প্রমোদ মহল ,''সুখনিবাসে'' আছে প্রাকৃতিক শীততাপ নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা।
দেওয়ান-ই-আম দেখে,কারুকার্যময় গণেশ পোল পেরিয়ে মনে হল সত্যিই অবিশ্বাস্য এই দুর্গ!আর রাজাদের কীর্তি। কত যুদ্ধ, বিগ্রহ,রাজ্যপাট আর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে দূর্গগুলি।
সেই কীর্তিমান রাজারা আজ নেই,থেমে গেছে রাজা-রানি আর তাদের জৌলুসময় জীবন । কিন্তু এখানো যেন প্রতিটা ইঁটপাথরে কান পাতলে শোনা যাবে তরোয়ালের ঝনঝন,হাতি-ঘোড়ার সগর্ব আস্ফালন অথবা জলসা ঘরে যেন বেজে উঠবে নূপুর !ইতিহাস বোধহয় এভাবেই কথা বলে যুগ যুগান্তর ধরে ।
ভীষণ ভাল লাগলো জয়পুর শহরটাকে ।
আরও কিছু ছবি --->
সিটি প্যালেস
( অপূর্ব অন্দর সজ্জা )
( কোন এক মহারাজার বিশ্রাম কক্ষ --এখনও ঠিক তেমনই সাজানো গুছানো )
( প্রাসাদের ক্লক টাওয়ার )
( দেয়ালে প্রাকৃতিক রঙের নকশা , যেগুলো মহল তৈরির পর থেকে একবারও আর নতুন করে রঙ করা হয়নি । হাজার হাজার বছর ধরে অবিকৃত রয়ে গেছে। মজার ব্যাপার হচ্ছে এই রঙগুলো শাকসবজি,ফলমূল কিংবা কোন রত্ন পাথর গুঁড়ো করে বানানো )
( দেওয়ান-ই-খাস )
***অম্বর প্যালেস***
(ভেতর দিক থেকে দুর্গের প্রবেশ ফটক )
(দুর্গের ছাদ থেকে পুরো এলাকা )
( প্রাসাদের ঠিক নীচেই মাতোয়া লেকের ভেতরে আছে একটি প্রমোদ উদ্যান। বাগানটি নাকি আসলে একটি গোলক ধাঁধা )
( কাঁচ আর অজস্র রঙিন রত্ন খঁচিত শিশ মহল )
( শিশ মহলের দেয়াল,ছাদ সবকিছুই নকশা করা কাঁচ দিয়ে বানানো।
সূর্যের আলোর প্রতিফলনে দারুণ এক মোহনীয় পরিবেশের সৃষ্টি হয় এখানে )
( আম্বর দুর্গের বিশাল এলাকা জুড়ে আছে আরও অনেক ছোট বড় প্রাসাদ আর মহল )
(দেওয়ান-ই-আম)
( দেওয়ান-ই-খাস)
( ভারি কাঠ খোঁদাই করে নকশা করা দরজা )
( দুর্গের ভেতর মাটির নিচের গোপন সুড়ঙ্গ পথ। কিছুদূর যাওয়ার পর অবশ্য পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে এখন )
( গনেশ পোলের সামনের দিক )
(ভেতরের দিক থেকে গনেশ পোলের গম্বুজ )
( গনেশ পোলের পেছনের দিক )
( মজার একটা জিনিস । জাদুর ফুল বলে এটাকে । এখানে আসলে একসাথে অনেকগুলো ছবি। আমাদের গাইড একটি কবিতা বলে বলে ছবিগুলো আলাদা আলাদা ভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলেন)
( আমাদের রাজস্থান ভ্রমণ শেষ হল, সাপের খেলা দেখে আর সাপ গলায় জড়িয়ে ছবি তুলে )
### এর পরের গন্তব্য ভারতের রাজধানী দিল্লী ###
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।