সম্পাদনা করি আমিরাত-বাংলা মাসিক মুকুল। ভালবাসি মা, মাটি ও মানুষকে.. লুৎফুর রহমান
২০ আগস্ট ২০১২। আরব আমিরাতের ঈদুল ফিতরের পরের দিন। চিরচেনা দেরা দুবাইয়ের বুক যেন আজ নতুন করে দেখা। ভোরের কুয়াশা কেটে দেশে যখন সুর্য উঠে যেমন লাগে আজ ঠিক তেমনি লাগছিলো দেরা দুবাইকে।
পরদেশের সব পরবাসী সবাই ঈদের ছুটিতে। নগরে নেই ব্যস্ততা। তাই ভোরবেলা নাসির স্কয়ারের দিকে ছুটে চলা আমাদের। মশকুর, জাবেদ ও তুষার কে নিয়ে যাত্রা। উদ্দেশ্য দুবাই নাসির স্কয়ারের ইউনিয়ন মেট্্েরা স্টেশন।
মাত্র ৫ মিনিট হেঁটেই পৌঁছে গেলাম মেট্্েরা মানে ইলেক্ট্রিক ট্রেন স্টেশনে। যথারীতি ৫ মিনিট পর-ই এসে গেলো ড্রাইভারবিহীন অত্যাধুনিক দুবাই মেট্্েরা। উঠে বসাতেই চলতে শুরু করলো আমাদের লক্ষ্যেস্থল জুমেরাহ বীচের পানে। মাটির নীচে অনেকক্ষণ চলার পর আবার উপরে উঠে গেলো মেট্্েরাটি। ১০ মিনিট মেট্রোতে জার্নির পরই চলে আসলাম ইতিসালাট টাওয়ার স্টেশনে।
নেমে গেলাম আমরা। আগে থেকেই আমাদের জন্য গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছিলেন মায়নুর ইসলাম ও সালেহ আহাদ টিপু ভাই। মেট্টো থেকে নেমেই দেখা হলো তাদের সাথে। প্রথমে ঈদের কোলাকুলি করেই উঠে গেলাম গাড়িতে।
যাত্রা হলো শুরু...
সবে মাত্র সকাল ১০টা।
দুবাইতে এত্তো গরম গাড়ির ভেতরের এসিও কাজ করছেনা। ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্র-ই মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় এমন ভাব। দুবাইতে সাধারণত ৫০ এর উপর তাপমাত্রা থাকেনা। আর ভরা গরমের দিনে ৪৫-৪৮ থাকে। নানা রকম কথা আর মধুর স্মৃতিচারণ নিয়ে আমাদের গাড়ি চলছে দুবাই শহরের অন্যতম পর্যটন স্পট জুমেরাহ’র দিকে।
গাড়িতে বাজছে বাংলা গান। সেই সাথে আমাদের হৈ হুল্লুড় আর প্রাণবন্ত গপসপ নিয়ে গেছে সাত সমুদ্র তেরো নদীর ওপারে। আমার জন্মভূমি, আমাদের প্রিয় দেশে। আমাদের গ্রামে। যেখানে লুকিয়ে আছে আমাদের ফেলে আসা ঈদ।
প্রবাসী জীবনে ঈদগুলোও কেমন পর পর লাগে। আমাদের দেশের বাতাসগুলো ঘুম পাড়ায় আর মরুভূমির বাতাসগুলো ঘুম তাড়ায়। এমন গরম বাতাস গায়ে মেখে পৌছে গেলাম জুমেরাহ বীচে। তখন ভর দুপুর। প্রচণ্ড রোদে বীচের বালু আর পানি ঝিকমিক করছে।
প্রথমেই আমাদের চোখে ধরা পড়লো কিছু আজব টাইপের বাঙালি পর্যটকদের। যাদের কাণ্ড দেখে শুধু হাসি নাই। বরং অবাকও হয়েছি। এরা এসেছেন আরব আমিরাতের রাজধানী আবুধাবী থেকে। ৫০ সদস্যের দল।
বুকে ব্যাজ ধারণ করে আছেন ‘বনভোজন’র আর এসেছেন বীচ ভোজনে। সেই সাথে এই দেশে পাবলিক প্লেস মানে খোলামেলাভাবে পান খাওয়া বলা হয় মমনু মানে নিষেধ। রয়েছে মুকালাফা বা জরিমানাও। কোনকিছুর পরোয়া না করেই মধ্যবয়সি বাঙালি ভদ্রলোক প্রকাশ্যে পান খাচ্ছেন। এটা দেখে মশকুরের মন্তব্য ছিলো এমনই-সব পর্যটন এলাকায় বাঙালিদের হেয় করে দেখার এটা অন্যতম কারণ।
বাঙালিরা আইন জানেনা আর মানেনা। সবশেষে ছবি তুললাম জুমেরাহ বীচকে পিছে নিয়ে। আমরা মানলাম আইন। মূল বীচ এলাকায় ছবি তুলা নিষেধ। তাই বীচের বাইরে থেকে ছবি তুলে নিলাম।
বীচে গোসলের জন্য প্রস্তুত হলাম। গোসল করতে ফর্মাল ড্রেস তথা ফুল প্যান্ট শার্ট গ্রহণযোগ্য নয়। এমন পোষাকে কাউকে দেখলে বীচ এলাকায় থাকা সিকিউরিটি বাঁশি বাজিয়ে সতর্ক করে দেয়। এতেও কেউ না মানলে জরিমানা দিতে হয়। আমরাও যথারীতি থ্রি কোয়ার্টার প্যান্ট ও শর্ট গ্যাঞ্জি পরে নামলাম বীচের বুকে।
হাজার বিদেশী মানুষের ঢল দেখে বিস্মিত সবাই। সকল দেশের সকল মানুষের আপন ভাষায় চলছে ভাষা বিনিময়। কিন্তু সকলের হাসির ভাষা একই। দুবাইয়ের যতোটা পর্যটন স্পট আছে তার বেশি জুড়ে রয়েছে জুমেরাহ। তাই বিদেশী পর্যটকদেরও জুমেরাহ’র দিকে চোখ।
জুমেরাহ বিশাল বীচের নিরিবিলি পরিবেশ পর্যটকদের মন জোগায়। জুমেরাহও বিশাল বিস্তুত এলাকা নিয়ে আপন গৌরবে দাঁড়িয়ে আছে দুবাইয়ের বুকে। ১,২,৩ জুমেরাহতে রয়েছে ওপেন বীচ, ফ্যামেলী বীচ, ওয়াদি ওয়াটার পার্ক, খেজুর গাছের সারি সারি শৈল্পিক পাল্ম জুমেরাহ, এবং বিশ্বের চতুর্থ উচু হোটেল বুর্জ আল আরব। আমরা অনেকক্ষণ সমুদ্রের পানিতে অবগাহন করে উঠে এলাম তীরে। সারা শরীর যেন লবণাক্ত হয়ে গেছে।
তাই উপরে রাখা শাওয়ারে গোসল সেরে উঠে গেলাম।
কোথাও আমার হারিয়ে যাবার নেই মানা...
গোসলের পানি ঠাণ্ডা হলেও উপরের গরম আর নীচের মরুভুমির বালু আমাদের প্রাণ যেন হাঁপিয়ে তুলছে। এবার জুমেরাহ এলাকার বুর্জ আল আরবের দিকে ছুটে গেলাম আমরা। গাড়িতে নেমেই একটা গ্র“প ছবি নিলাম। ছবিটি তুলে দিলেন ইউরোপ থেকে আসা এক বন্ধু।
আমরা দেখতে লাগলাম পৃথিবীর ৪র্থ উচু হোটেল বুর্জ আল আরব। সমপূর্ণ সাগরের পানির উপর বানানো হয়েছে নান্দনিক শিল্প দিয়ে। একসময় দুবাই বলতেই বুর্জ আল আরবকে বুঝানো হতো। ৭০ তলা বিশিষ্ট সাত তারা এই হোটেলটির উচ্চতা ৩২১ মিটার। ২৮০ মিটার আর্টিফিশিয়াল বরফ দিয়ে রাখা হয়েছে হোটেলটি।
সেই সাথে বীচ থেকে তীরপর্যন্ত বানানো হয়েছে একটি ব্রীজও। কৌতুহলী মানুষৈর ভীড় ঠেলে আমরাও হোটেল দর্শন শেষে এবার গেলাম আল ওয়াদি ওয়াটার পার্কে। বাচ্চা থেকে বয়স্ক সকলের বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হয়ে ওঠে পার্কটি। পাকের প্রবেশদ্বারে কৃত্রিম ঝর্ণাধারা সকলের দৃষ্টি কাড়ে। গরমে প্রত্যেক পর্যটক অস্বস্তি বোধ করছেন তবুও হার মানছেননা উপভোগ থেকে।
ঠিক তেমনি আমরাও। এদিক ওদিক শুধু ক্যামেরার ক্লিক আর ক্লিক। আমরা গরমে কাতর হয়ে গেছি। তাই মায়নুর ভাইয়ের পরামর্শে প্রথমেই ঢুকতে চাই মল অব আমিরাতে। পরাণটা ঠাণ্ডা করতে চাই।
গাড়িতে উঠে বসলাম আমরা। মায়নুর ভাই ড্রাইভ করে ঢুকলেন মল অব আমিরাতের পার্কিংয়ে। আহা! এতো শান্তি লাগছে! ঠাণ্ডায় শীত শীত অনুভব হচ্ছিল। হাত মুখ ধুয়ে দেখতে লাগলাম বিশাল মল অব আমিরাতকে। আমাদের দেশের কয়েকটি মার্কেট এক করলে বোধ হয় এমন বড় হবে।
নান্দনিক শিল্প কর্ম দিয়ে গড়া এখানকার সবক’টি মল। এর মধ্যে মল অব আমিরাত ও দুবাই মল উল্লেখযোগ্য। মল অব আমিরাত ২০০৫ সালে স্থাপিত হয়েছে। ২২৩,০০০ স্কয়ার মিটার নিয়ে গঠিত মলটিতে রয়েছে পাকঘরের কেনাকাটা থেকে সিনেমা হল পর্যন্ত। এক কথায় দৈননন্দিন জীবনের সব রয়েছে এখানে।
অনেকক্ষণ নানারকম আইটেম দেখে আর মনমাতানো সব ছবি তুলে পেটকে শান্ত করতে ঢুকলাম কেএফসিতে। লাইনবদ্ধ মানুষের সাথে আমরাও লাইনে দাঁড়ালাম। অবশেষে কেএফসি নিয়ে বসে গেলাম আপন জায়গায়। খেয়ে দেয়ে এবার রওনা হলাম বার দুবাইস্থ আল সাফা পার্কে। বাঙালিদের ঈদ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে ওখানে।
আয়োজন করেছে বড়লেখা প্রবাসী পরিষদ, দুবাই এবং মিডিয়া পার্টনার ও সার্বিক সহযোগিতায় ছিলো আমিরাত-বাংলা মাসিক পত্রিকা মুকুল। বিকেলের মিঠে রোদে শত-শত বাঙালি ব্যাচেলর ও পরিবার এসে জড়ো হলেন পার্কে। লাগছিল কোন ডাকবাংলাতে বসে আছি। খাঁটি বাংলা কথা, বাংলা খেলা, বাংলা গান। ইভেন্ট ছিলো ছেলেদের ফুটবল, হংসশিকার, রশিটান, মোরগের লড়াই এবং মেয়েদের বালিশ বদল ও চেয়ার দৌড়।
খুবই ইনজয় করলাম। আয়োজকদের একজন হয়ে বেশি উপভোগ করলাম। সেইসাথে মূল পরিকল্পক কবি আব্দুল আজিজ সেলিমের প্রাণবন্ত পরিচালনা ও মহিলাদের পরিচালক লেখিকা
মোস্তাকা মৌালার পরিচালনায় মুগ্ধ সবাই।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...
পার্কের ঈদ উৎসবে রূপ নিয়েছে মিলন মেলার। হারানো বন্ধু ইকবাল, হিফজুর ও হাদিকে পেলাম এখানে।
সেইসাথে পেলাম আলতাব মামা ও উনার স্ত্রীকে। এদের সাথে এখানে দেখা হবে এটা ছিলো কল্পনাতীত। তাই এটা বাড়তি পাওয়া। এছাড়া আরেকটি ব্যাপার খুবই ইনজয় করেছি। আমার অনেক ফেসবুক বন্ধু আমাকে চেনেন।
আমি যাদেরকে চিনিনা। ওরা সবাই এসেই আমাকে জিজ্ঞেস করলো- আপনি মুকুল পত্রিকার লুৎফুর ভাইনা? আমি-হ্যাঁ বলাতেই উনারা বল্লেন আমরা আপনাকে চিনি। ফেসবুকে আপনার কর্মকাণ্ড দেখি। আর এ দলে ছিলেন সালমান, খায়রুল, মুহিনসহ অনেকেই। আড্ডাতে বাংলাদেশ থেকে আসা মৌলভীবাজার জেলার বড়লেখার সুজানগর ইউপি চেয়ারম্যান নসিব আলী সাহেবের গানে মাতোয়ারা হয়ে ওঠেন দর্শকরা।
রাত বেজে যায় ১০টা। দর্শকদের একটাই আকুতি ওয়ান মোর প্লিজ। অবশেষে পার্ক কর্তৃপক্ষ গান বন্ধ করতে বলে। সাঙ্গ হয় মিলন মেলা। শেষ হয়ে যায় আমার ভ্রমণ মিশনও।
অনেক আনন্দ করে আবার ফেরলাম দেরা দুবাই শহরের বুকে। উঠলাম মশকুরের বাসায়। এার আগে মায়নুর ভাই ও টিপু ভাই চলে গেলেন। আমরাও ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পড়লাম। অনেক ধেকার পরই আমাদের কাছে লাগছিল-দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া...।
লেখক: সম্পাদক, মাসিক মুকুল, দুবাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।