বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দুর্নীতিবাজদেরকে অপসারন করুন শিক্ষাঙ্গন সুশৃঙ্খল রাখতে রিটের বিকল্প কি নেই?
প্রকৌশলী তৈরির অন্যতম উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) এখন চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। কেন এই অস্থিরতা ? উল্লেখযোগ্য কারণ হল, ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে ৫৮ জন জ্যেষ্ঠ শিক্ষককে ডিঙিয়ে অধ্যাপক হাবিবুর রহমানকে প্রোভিসি নিয়োগ এবং ২০১০ সালের আগস্টে ভিসি হিসেবে অধ্যাপক নজরুল ইসলাম নিয়োগ লাভের পর বদলি, পদোন্নতি ও প্রশাসনিক কাজে দলীয়করণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে স্বাভাবিক মাত্রা ছাড়িয়ে যায়। উচ্চ মহলের হস্থক্ষেপে শুরুতে ভিসি, প্রোভিসিবিরোধী আন্দোলনের সাময়িকভাবে সুরাহা হলেও এ বছরের ৭ এপ্রিল থেকে বুয়েট শিক্ষক সমিতি কর্মবিরতি শুরু করে। লাগাতার ২৮ দিন কর্মবিরতির পর ৪ মে প্রধানমন্ত্রীর আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে আন্দোলনকারী শিক্ষকরা ৫ মে থেকে আন্দোলন স্থগিত করেন। ৯ জুন সমিতির সভায় ৩০ জুনের মধ্যে ভিসি ও প্রোভিসিকে পদত্যাগ করতে সময় বেঁধে দেয়া হয়।
এর মধ্যে তারা পদত্যাগ না করায় ১৪ জুলাই থেকে লাগাতার কর্মবিরতির ঘোষণা দেয় সমিতি। বুয়েট কর্তৃপক্ষ ১১ জুলাই থেকে ৪৪ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করলে আন্দোলনকারী শিক্ষক এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে ওই আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী ছাত্র, কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ভিসি ও প্রোভিসির অপসারণের দাবিতে প্রশাসনিক ভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট কর্মসূচি পালন করতে থাকে।
প্রকৌশল বিদ্যার সর্বোচ্চ এই বিদ্যাপীঠ অচলাবস্থার ঘোর অন্ধকারে আবদ্ধ থাকতে পারে না মর্মে ২৯ জুলাই সুপ্রিমকোর্টের এক আইনজীবীর রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ প্রাথমিক শুনানি শেষে বুয়েটের ছাত্র-শিক্ষক ও কর্মচারীদের চলমান আন্দোলন বা ধর্মঘটের ওপর অন-র্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং এই আন্দোলন কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না তাও জানতে চাওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্টদের কাছে।
একই সময়ে বাংলাদেশের অন্যতম উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নটর ডেম কলেজও রিটের কবলে পড়েছে। চলতি বছর সরকার একাদশ শ্রেণীতে অনলাইনে ভর্তি কার্যক্রম শুরু করে।
শিক্ষা বোর্ড এ সংক্রান- যে সার্কুলার জারি করে তাকে অস্পষ্ট এবং অনলাইন পদ্ধতিকে ছাত্রদের স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার এবং তথ্য অধিকারের লঙ্ঘনসহ ২০১২ সালের একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি নীতিমালা কার্যকর না করার দাবিতে নটর ডেম কলেজের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক হাইকোর্টে রিট করেন। তৎ প্রেক্ষিতে হাইকোর্ট শুধু নটর ডেম কলেজের জন্য অনলাইনে ভর্তি প্রক্রিয়া ৬ মাসের জন্য স'গিত ঘোষণা করেন। শিক্ষা বোর্ড এই আদেশের বিরুদ্ধে চেম্বার জজ বিভাগে আপিল করলে সি'তাদেশ দেয়া হয়। এ অবস্থায় নটর ডেম কলেজ আগের নিয়মে ভর্তি হওয়া প্রায় আড়াই হাজার শিক্ষার্থীকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ড এখনও রেজিস্ট্রেশন দেয়নি। এ নিয়ে নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী-শিক্ষক এবং অভিভাবকেরা উদ্বিগ্ন।
এখন কলেজ কর্তৃপক্ষ চায় শিক্ষার্থীদের রেজিস্ট্রেশন আর আদালত অবমাননার ভয়ে শিক্ষা বোর্ড ধীরগতিতে চলছে।
শুধু বুয়েট আর নটর ডেম কেন? দেশের অসংখ্য উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চরম সংকট আর অচলাবস্থার মধ্যে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সিলেটের এমসি কলেজের ঐতিহ্যবাহী ছাত্রাবাস সরকার সমর্থিত ছাত্রলীগ নামধারী সন্ত্রাসীরা পেট্রল দিয়ে পুড়িয়ে দিল অথচ আমাদের গতানুগতিক প্রতিবাদ করা ছাড়া কিছুই করার নেই, হয়তো অপরাধীদের কিছু হবেও না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হল থেকে এক ছাত্রকে পুলিশ আটকের তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ছাত্র বিক্ষোভ ও সহিংসতার মুখে কর্তৃপক্ষ ২৫ আগস্ট পর্যন- ক্যাম্পাস বন্ধ ঘোষণা করে। এর আগে ৯ জানুয়ারি ছাত্রলীগের দলীয় কোন্দলের শিকার হয়ে মেধাবী ছাত্র জুবায়েরের মৃত্যু হয়।
জুবায়েরের মৃত্যুতে ফুঁসে ওঠে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনের মুখে তৎকালীন ভিসি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। নতুন ভিসি ২০ জুলাই ভিসি প্যানেল নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করলে শিক্ষকদের একাংশ ওই নির্বাচন স'গিতের দাবিতে প্রশাসনিক ভবন অবরোধ করে রাখে। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার শিক্ষার্থীর অগণিত দৃশ্যমান সমস্যা সমাধানের উদ্যোগ না নিয়ে কর্তৃপক্ষ পদ্মা সেতু নির্মাণে সরকারকে এক কোটি টাকা দেয়ার ঘোষণা দিলে প্রগতিশীল শিক্ষার্থীরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষ ও গোলাগুলিতে মেধাবী ছাত্র সোহেল রানা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ ডাকসু নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সংহতি সমাবেশে তারা ভিসির পদত্যাগ দাবি করেছে। কে জানে, কবে এ ব্যাপারে আরও একটি (একাধিকও হতে পারে) রিট পিটিশন দাখিল হতে পারে।
এভাবে কথায় কথায় রিট আর উচ্চাদালতের দ্বারস' হওয়ার সংস্কৃতি আমাদের পবিত্র শিক্ষাঙ্গনের প্রিয় শিক্ষার্থী বন্ধুদের ও শ্রদ্ধের শিক্ষক সমাজের তথা রাষ্ট্রের জন্য কতটা প্রয়োজনীয় এবং প্রাসঙ্গিক তা বিবেচনার সময় এসেছে। কোন এক পক্ষের পক্ষাবলম্বনপূর্বক হাইকোর্টে রিট পিটিশন দাখিল করে আন্দোলনকারীর যৌক্তিক ও ন্যায়সঙ্গত দাবি বন্ধ করে রাখা যায় না। জনস্বার্থে রিট পিটিশন দাখিল করার ন্যায়ত অধিকার হরণ করার পক্ষে আমি নই কিন' কথায় কথায় রিট পিটিশন দাখিল করার মহোৎসব শুরু হলে এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজে পড়বে।
সে সঙ্গে হাইকোর্টে বিচারপতি সংকটের কারণে স্বাভাবিক মামলাগুলো বছরের পর বছর ধরে নিষ্পত্তি না হওয়ার দরুন বিচার প্রার্থীরা চরম উৎকণ্ঠায় দিনাতিপাত করছে। এখন যদি এই বিচারপতিদের রিট পিটিশন শুনতেই দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় করতে হয়, তাহলে কার্যতালিকায় অন-র্ভুক্ত অতি গুরুত্বপূর্ণ ও সংবেদনশীল মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া আরও বিলম্বিত হবে, যা হবে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা।
ছাত্রাবস্থায় আমি ভালো শিক্ষার্থী ছিলাম না ঠিক; কিন' ব্যক্তিত্ববোধসম্পন্ন নিষ্ঠাবান শিক্ষার্থী বন্ধুদের সমীহ করে কথা বলতে এবং আদর্শ ও নীতিবান শিক্ষকদের উপযুক্ত সম্মান-শ্রদ্ধা জানাতে কার্পণ্য করিনি কখনও। বুয়েটসহ দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানোন্নয়ন, গবেষণাকর্ম, অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ শিক্ষার ধারাবাহিকতা রক্ষায় সরকারকে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের মনে রাখা দরকার যে, দেশের ষোল কোটি মানুষের কষ্টার্জিত টাকায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চলছে।
তারা যেন উচ্চ শিক্ষা গ্রহণ শেষে দেশ তথা সমাজের উন্নয়নে স্ব-স্ব অবস্থানে থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে, সেভাবেই লক্ষ্য স্থির করে তাদের অগ্রসর হতে হবে। নিজেদের পছন্দসই ব্যক্তিকে ভিসি/প্রোভিসি নিয়োগের দাবিতে মাসের পর মাস আন্দোলন-সংগ্রাম জিইয়ে রেখে পাঠকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদান না করে মাস শেষে বেতন-ভাতা উত্তোলনের সংস্কৃতি থেকেও সংশ্লিষ্টদের বেরিয়ে আসতে হবে। কোমলতি শিক্ষার্থী বন্ধুদের একবিংশ শতাব্দীর যোগ্য উত্তরসূরি তথা প্রশাসক, রাজনীতিক ও সমাজ বিপ্লবী হওয়ার শপথ নিতে হবে। রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের (টেন্ডারবাজি, চাঁদাবাজি) পথ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পবিত্রতা আমাদেরই রক্ষা করতে হবে।
পার্শ্ববর্তী দেশগুলোর মতো আমাদের দেশেও উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মানোন্নয়ন এবং দেখভালের বৃহত্তর স্বার্থে একজন উচ্চ শিক্ষামন্ত্রী নিয়োগ করা যেতে পারে, তবে সেটা সরকারের স্বেচ্ছাধীন সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে। এজন্য আপনি রিট পিটিশন ফাইল করে উচ্চাদালতে আরও একটি মামলার বোঝা চাপিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করছেন না তো?
লেখক : পলাশ কুমার রায়, আইনজীবী
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।