আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বেকারের ডায়েরী

বাক স্বাধীনতা মানে সত্য বলার অধিকার। আমার একটা হাতঘড়ি আছে। মনট্রেক্স ব্র্যান্ডের ঘড়ি। আব্বু কিনে দিয়েছিলো মাস্টার্স পরীক্ষা দেয়ার পর। এর আগেও অবশ্য অন্য ঘড়ি ছিল।

আমার ঘড়িটা সময় দশ মিনিট এগিয়ে দেয়া আছে। যখন দেখায় সকাল ৯:৪৫। প্রকৃত সময় তখন ৯:৩৫। সাধারণত যারা ঘড়ির সময় এগিয়ে রাখে তারা ব্যস্ত মানুষ হয়। তাদর সময়ের অনেক দাম থাকে।

কিন্তু এখন আমার সময়ের কোন দাম নেই। কোন ব্যস্ততাও নেই। ঘড়ির সময়টা এগিয়ে রাখা শুরু করেছিলাম ছাত্র থাকা অবস্থায়। ক্লাশের যাতে দেরী না হয় তাই এই ব্যবস্থা। অভ্যাসটা এখনও রয়ে গেছে।

কিন্তু এখন পুরো ব্যাপারটাই অর্থহীন। আমার আর কোন ক্লাশ নেই। বছর চারেক আগেই জীবন থেকে ক্লাশ করার দিনগুলো চলে গেছে। এখন আমার পরিচয় একটাই- বেকার। বিকেলের দিকে অবশ্য কিছুটা ব্যস্ততা থাকে।

তখন কয়েকটা টিউশনি থাকে আমার। ছাত্র থাকা অবস্থায় আমি অবশ্য টিউশনি করিনি কখনো। তার দরকারও পড়তো না। আব্বু যে টাকা দিত তাতে তার পুরো মাস চলে যেত। বাসা থেকে টাকা নেয়া অনেক আগেই বন্ধ করে দিয়েছি।

ইচ্ছে হয় না বাসা থেকে টাকা নিতে। দীর্ঘদিনের বেকারত্ব আমার ভিতরে একটা হীনম্মন্যতার জন্ম দিয়েছে। এখন লজ্জা লাগে বাসা থেকে টাকা চাইতে। কিন্তু পেট তো চালাতে হবেই। তাই বাধ্য হয়ে টিউশনি শুরু করেছি আড়াই বছর হলো।

এতে দিন বেশ ভালোই কেটে যায়। কিন্তু লজ্জা কাটে না। বলতে লজ্জা নেই, ছাত্রজীবনে ভালো ছাত্র হিসেবে সুনাম ছিলো আমার। এসএসসি থেকে শুরু করে মাস্টার্স পর্যন্ত রেজাল্ট ভালোই করেছি। আমি ভাবতাম অনেক ভালো কিছু করবো জীবনে।

এমনকি আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হবার মতন রেজাল্ট ধারণ করে আছি। রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের ফলে সেটা হতে পারিনি। টিচার হয়েছে আমার চেয়ে বেশ পিছিয়ে থাকা দুই সহপাঠী। না,এর জন্য কোন ক্ষোভ নেই আমার। ক্ষোভটা আমার অন্য জায়গায়।

শিক্ষক না হতে পারি- সেটা অনেক বড় বিষয়। অন্য কোন চাকরী কি আমি পেতে পারি না? কিন্তু হলো না- হচ্ছে না। অনেক অনেক পরীক্ষা দিয়েছি আমি। অনেক জায়গায় ইন্টারভিউ দিয়েছি। কিন্তু সোনার হরীণ আমার হস্তগত হয়নি।

একটা মেয়ে। তার নাম সাদিয়া। সেই মেয়েটির সাথে প্রেম ছিলো। সে আমার ভার্সিটির ছাত্রী। আমার তিন বছরের জুনিয়র একটা মেয়ে।

সেই সাদিয়াও আমাকে ছেড়ে চলে গেছে মাস দুই হলো। তারই বা কি দোষ? কতদিন অপেক্ষা করবে সে আমার জন্য? তার প্রথম দিকের অপক্ষার প্রহরগুলো আমার জন্য হলেও শেষ দিকে এসে সেটা আমারর চাকরীর জন্য অপেক্ষায় পরিণত হয়েছিলো। কিন্তু না,আমি তাকে কিছুই দিতে পারলাম না। কী দুঃখ! কী লজ্জা! একটা চাকরী হলো না আমার। তাই সাদিয়া চলে গেল আমাকে ছেড়ে।

এ জন্য সাদিয়ার উপর অভিমান করব?। কোন অধিকারে? কেন সে অপেক্ষা করবে আমার মত একটা মেরুদন্ডহীন যুবকের জন্য যে কিনা একটা চাকরী পর্যন্ত জোগাড় করতে পারে না? তারও তো একটা জীবন আছে। গাছতলায় বসে জীবন কাটানোর মত প্রেম এখন আর কোথাও পাওয়া যায় না। লাইলী মজনুর আমলে ছিলো কিনা সেটাও সন্দেহ। গত কয়েক মাসে সাদিয়ার সাথে আর কথাও হতো না তেমন একটা।

দেখা হোক আর ফোনে কথা হোক, সাদিয়ার কথা শুধু 'চাকরীর কিছু হলো?’ জাতীয় কথাবার্তায় পরিণত হয়েছিলো। একসময় সাদিয়া ছিলো আমার প্রেরণার উৎস। পরে সাদিয়াও হারিয়ে ফেলেছিলো প্রেরণ দেয়ার প্রেরণা। তাই একদিন ক্ষমা চেয়ে সাদিয়া চলে গেল। দোয়া করে গেল যেন আমি একটা ভালো চাকরী পাই আর তার চেয়ে অনেক ভালো একটা মেয়ে পাই।

হাহ্‌ মেয়ে দিয়ে কী করবো আমি? খাওয়াবো কি? অবশ্য সত্যি কথা বলতে সাদিয়া চলে যাওয়ার পর কি কারণে যেন, আমার তেমন একটা দুঃখ হয়নি। বরং সে হালকা বোধ করেছি। একটা টেনশন দূর হয়েছে। এখন যেভাবেই হোক জীবনটা কেটে যাবে। চাকরীতে যোগদানের বয়স শেষ হয়ে আসছে ক্রমশ।

আর মাসখানেক পরেই সরকারি চাকরী করার প্রথম যোগ্যতাটা হারিয়ে ফেলবো আমি। এই যোগ্যতা চলে যাওয়া মানে সার্টিফিকেটিগুলো অর্থহীন হয়ে যাওয়া। এখনই ওগুলোকে নিছক কাগজ ছাড়া আর কিছু মনে হয় না আমার। কয় টাকা দাম হবে ওগুলোর? সবগুলো একসাথে করলেও পাঁচটাকা হবে না। প্রিয় ব্লগারগণ, আর একমাস পরে আমার জন্মদিন! বেসরকারী চাকরী করতে গেলে অভিজ্ঞতা লাগে।

আমার অভিজ্ঞতা নেই। শেষবার যখন ইন্টারভিউ দিলাম একটা চাকরীর- ওরা আমার অভিজ্ঞতার কথা জিজ্ঞাসা করলে আমি বলেছিলাম, ‘চার বছর চাকরী খোঁজার অভিজ্ঞতা আছে স্যার’। শুনে সবাই মিলে হা হা করে হেসে উঠেছিলো। কিন্তু চাকরী হয়নি। প্রিয় ব্লগারগণ,আমার মা বাবার অনেক স্বপ্ন ছিলো আমাকে নিয়ে।

আমার আব্বু একজন ব্যাংক কর্মকর্তা ছিলেন। কিন্তু তার স্বপ্ন ছিলো ছেলে বিসিএস ক্যাডার হবে। আব্বু আম্মু প্রায়ই আলোচনা করতেন আমার জন্য কোন ক্যাডার উপযুক্ত হবে সেটা নিয়ে। আমার স্বাস্থ্য ভালো, লম্বাও। ‘ওর জন্য পুলিশের চাকরীই পারফেক্ট'- বলতেন মা।

আব্বু বলতেন 'পুলিশের চাকরীতে বিপদ বেশি। ওর জন্য মেজিস্ট্রেট হওয়া ভালো। 'ফরেন সার্ভিস হলে ভালো কেমন হয়? আম্মু বলতো। এসব আলোচনা করতে করতে মা বাবার মুখদুটো উজ্জ্বল হাসিতে ভরে উঠতো। আহ্‌ কতই না স্বপ্ন ছিলো মা বাবার! কিন্তু আমি ব্যর্থ হয়েছি তাদের স্বপ্ন পূরণ করতে।

মা আমার সাথে ভালোভাবে কথা বলঅলেও আব্বু ইদানিং আমার সাথে ভালোভাবে কথা পর্যন্ত বলেন না। এমনকি চাকরী হচ্ছে না জন্য খোঁটাও দেন। বাসায় যাওয়াই ছেড়ে দিয়েছি আমি। মনে পড়ে হলের দিনগুলোর কথা। কতই না মজা ছিলো সে সময়! সবসময় শুনেছি আমি ভালো ছাত্র।

তখন কি জানতাম আমার জীবনটা এমন হয়ে যাবে? জীবনে আমি কোন ফাঁকিই তো দেই নি। তাহলে জীবন আমাকে ফাঁকি দিলো কেন? এটা একটা সত্য কথা যে, নিজের অনেক প্রশংসা শুনে আমি খানিকটা অহংকারী হয়ে গিয়েছিলাম। খোদা কি এ জন্যই আমাকে কষ্ট দিচ্ছেন? আমার ভার্সিটির বন্ধুদের সাথে এখন আর যোগাযোগ রাখি না। ফেসবুকে ঢুকি না। অনলাইনে আমার বেশিরভাগ সময় কাটে বিডিজবস আর প্রথম-আলো জবস –এ।

তবে সামহোয়্যার ইন ব্লগে সময় দেই। পড়তে ভালো লাগে। আমার প্রিয় বন্ধুরা সবাই ভালো ভালো চাকরীতে আছে। দেখা করি না। ভুল করে দেখা হয়ে গেলে দ্রুত দু কথা সেরে পালিয়ে আসি।

আমার মেসে যারা থাকে তারা সবাই ছাত্র। তারা বোঝে আমার অনুভূতিকে। তাদের কাছ থেকেই সান্তনা পাই। সাদিয়া চলে যাওয়ার পরে ওরা সবাই আমাকে অনেক সময় দিয়েছে। ওদের কথা আমার অনেকদিন মনে থাকবে।

এভাবেই দিনগুলো কেটে যাচ্ছে আমার। এভাবেই হয়তো কেটে যাবে আরও কিছুদিন। তারপর কি করবো? ভাবছি মুদিখানা খুলবো কিনা। নাকি সিএনজি চালাবো? জীবনে বড় কিছু হবার বাসনা ত্যাগ করেছি বহু আগেই। এখন আছে শুধু বেঁচে থাকার তাগিদ।

আছে শুধু সুখময় কিছু স্মৃতি। সাদিয়ার সাথে কাটানো সময়গুলো মিস করি। সাদিয়া, তুমি ভালো থেক। (কাল্পনিক) ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।