সবকিছুই চুকিয়ে গেছে গালিব! বাকি আছে শুধু মৃত্যু!! ক্রিকেটীয় বিবেচনায় আইপিএল সিরিয়াস কোন ক্রিকেট নয়। এটা বিনোদন এবং টাকা উপার্জনের একটি সহজ মাধ্যম মাত্র। অনেক ক্রিকেটবোদ্ধা এটা বলে থাকেন যে, পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী ক্রিকেট বোর্ড তথা ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড নিজেকে আরো বিত্তবান এবং অন্য দেশের ক্রিকেট স্ট্রাকচারকে ভেঙে দেয়ার জন্য এই আইপিএলের মতো একটি সম্পূর্ণ বাণিজ্যিক ক্রিকেটের পত্তন ঘটিয়েছে। পর্যবেক্ষণের আলোকে বলা যায় এক্ষেত্রে ভারতীয় ক্রিকেটবোর্ড কিছুটা হলেও তার এ উদ্দেশ্যে সফল হয়েছে। অতিসম্প্রতি ইংল্যান্ডের সেরা ব্যাটসম্যান কেভিন পিটারসেন আন্তর্জাতিক ওয়ান ডে এবং টি-টুয়েন্টি ম্যাচ হতে অবসর গ্রহণ করেছেন।
ধারণা করা হচ্ছে আইপিএলে আরো বেশি সময় দেয়ার জন্যই তিনি এমনটা করেছেন। এর আগে শ্রীলংকার সেরা বোলার লাসিথ মালিঙ্গা টেস্ট ক্রিকেট থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন। এর মূলেও রয়েছে আইপিএলকে বেশি গুরুত্ব দেয়া। ওয়েস্ট ইন্ডিজের সেরা ব্যাটসম্যান গ্রিস গেইল শুধুমাত্র আইপিএল এবং অন্যান্য টি-টুয়েন্টি টুর্ণামেন্টে খেলার জন্য নিজ দেশের ক্রিকেট বোর্ডের সাথে ইচ্ছাকৃত একটি ঝামেলা পাকিয়ে নিজের দেশের পক্ষে খেলা থেকে বিরত থাকছেন। কাজেই বলা যায় অন্য দেশের ক্রিকেটে গোলমাল পাকানোর যে ফন্দিটা ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড আইপিএলের মাধ্যমে নিয়েছে তাতে সে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে এবং এ সফলতা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
শ্রীলংকা, ইংল্যান্ডে বা সাউথ আফ্রিকাতে প্রতিভাবান ক্রিকেটারের অভাব নেই। একজনের অুনপস্থিতিতে সাময়িক ক্ষতি হলেও অন্যজনকে দিয়ে কিছু সময় পরে হলেও তারা তা পুষিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু আমাদের মতো দেশে যেখানে সবেধন নীল মণি একজন মাত্র বিশ্বমানের ক্রিকেটার রয়েছেন সেখানে আইপিএলের কারণে যদি তার পূর্ণ সেবা থেকে দেশ বঞ্চিত হয় তবে এরচেয়ে হতাশার আর কিইবা হতে পারে। পাঠক, কোন রাখঢাক না রেখেই আমি এখানে আমাদের ‘সবেধন নীল মণি’ ক্রিকেটার বলতে আমাদের সাকিব আল হাসানকেই বুঝাচ্ছি। আর আইপিএলের কারণে দেশ তার পূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশংকাটা এ কারণে করা হল যে, আইপিএলের ইমিডিয়েট পরেই সাকিব বিশ্রামের কথা বলে জিম্বাবুয়ে সফর থেকে তাঁকে বাদ দেয়ার অনুরোধ করেছেন।
একজন ক্রিকেটার বিশ্রাম চাইতেই পারেন। এটা অস্ট্রেলিয়া, ভারত, সাউথ আফ্রিকার মতো ক্রিকেট খেলুড়ে দেশে যাদের খুব ব্যস্ত আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সূচি আছে তাদের ক্ষেত্রে খুব অস্বাভাবিক কোন ঘটনা নয়। তারপরেও খুব বেশি খেলোয়ারকে কিন্তু বিশ্রাম চাইতে দেখা যায় না। সাধারণত বিশ্রামগুলো দেওয়া হয় বা চাওয়া অপেক্ষাকৃত দুর্বল দলগুলোর বিরুদ্ধে খেলার সময়ে বা কম গুরুত্বপূর্ণ সিরিজগুলোতে। কিন্তু আমাদের বাংলাদেশের সাপেক্ষে যেখানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ খুবই কম সেখানে এই বিশ্রাম চাওয়া কতটুকুন যৌক্তিক সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠতেই পারে।
ক্রিকেটাররা প্রায়ই বলে থাকেন যে, দেশের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করাই সবচেয়ে বেশি সন্মানের। এ বিবেচনায় অন্যান্য বাণিজ্যিক টুর্ণামেন্টে নির্বিঘ্নে খেলা একজন খেলোয়ার যখন নিজের দেশের খেলার সময়ে বিশ্রামে যেতে চান তখন তার দেশের প্রতি কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন তুলাটা অবান্তর নয়। টুর্ণামেন্টটি যদি কম গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে বিশ্রামের বিষয়টি যৌক্তিক হত। ওয়ানডে ম্যাচে বড় দলের সাথে কালে-ভদ্রে দু’একটি ম্যাচ জেতাকে বাদ দিলে আমাদের ক্রিকেটের লেভেলটা ঐ জিম্বাবুয়ের কাছাকাছিই রয়েছে। এমনকি গত সফরে আমরা জিম্বাবুয়ের নিকট টেস্ট এবং ওয়ান ডে দুটোতেই লজ্জাজনকভাবে পরাজিত হয়েছি।
এখন সাকিব ঐ সফরে না থাকার কারণে আমাদের দলীয় শক্তি অনেকটাই খর্ব হবে। এবারও যদি আমরা জিম্বাবুয়ের কাছে লজ্জাজনকভাবে পড়াজিত হই তখন ইয়ান চ্যাপেলরা আবার আমাদের টেস্ট স্ট্যাটাসের যৌক্তিকতা নিয়ে সরব হবেন।
এখানে সাকিব বা তাঁর খুব নিকট ভক্তরা হয়তো বলতে চাইবেন যে, ক্রমাগত ক্রিকেট খেলার কারণে সে ক্লান্ত। বিশ্রাম পাওয়াটা তার অধিকার। দয়া করে এ বিতর্কে নামার আগে আপনাদের সংশ্লিষ্ট অন্য সব ক্রিকেট খেলুড়ে দেশের ক্রিকেটসূচির প্রতি একটু নজর দেওয়ার জন্য অনুরোধ করব।
সব বাদ দিয়ে এখানে আমি শুধুমাত্র শ্রীলংকার গত ৫-৬ মাসের ক্রিকেট সূচিটা বিশ্লেষণ করার জন্য অনুরোধ করব। শ্রীলংকা গত ছয়মাসে বিরামহীনভাবে সাউথ আফ্রিকা, অস্টেলিয়া, পাকিস্তান (সিরিজটি সংযুক্ত আরব আমিরাতে অনুষ্ঠিত হয়), বাংলাদেশ (এশিয়া কাপ) সফর করেছে। এ মাসে পাকিস্তান শ্রীলংকা সফরে গেছে। পাকিস্তানের পরে যাবে ভারত। এর মাঝে শ্রীলংকার অনেক ক্রিকেটার আইপিএলেও অংশগ্রহণ করেছে।
এতো বিরামহীন ক্রিকেট খেলার পরেও জানামতে শ্রীলংকার কোন ক্রিকেটারই বিশ্রামে যাননি। এসব ক্রিকেটারদের মধ্যে সাঙ্গাকারা, জয়বর্ধনে, দিলশান এর মতো পয়ত্রিশ বা এর উর্ধ্ব বয়সের খেলোয়াররাও রয়েছেন। সাকিব এদের তুলনায় তেমন কোন ক্রিকেটই খেলেননি। এমনকি আইপিএলেও তিনি নিয়মিত ছিলেন না। যেখানে শ্রীলংকার খেলোয়াররা বিরামহীনভাবে দেশের পক্ষে খেলার পরও ক্লান্তিবোধ করছেন না সেখানে তুলনামূলক অনেক কমসংখ্যক ম্যাচ খেলার পরও নিজের দেশের পক্ষে খেলার সময়ে সাকিবের এ ক্লান্তিবোধ নিঃসন্দেহে হতাশার।
এ আচরণে দেশের প্রতি তার কমিটমেন্ট নিয়ে প্রশ্ন ওঠতেই পারে।
শাকিবকে নিয়ে আমার আশংকা/হতাশাটা আসলে আরো অনেক ব্যাপক। এ আশংকা/হতাশার কেন্দ্রবিন্দুও সেই আইপিএল। আগামী বছর আইপিএল চলাকালীন সময়ে বাংলাদেশ দল জিম্বাবুয়ে সফর করবে। আইপিএলের প্রতি সাকিবের যে দুর্বলতা ইতোমধ্যে প্রকাশ পেয়েছে সে অভিজ্ঞতায় আগামী বছর আইপিএলের সময়ে সাকিব যেকোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিতে পারেন।
তিনি হয়তো দেশের চেয়ে আইপিএল-কেই বেশি প্রাধান্য দিতে পারেন। সে প্রাধান্যের কারণে সাকিব যদি মালিঙ্গা, গেইল, পিটারসেনের মতো কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তাহলে সেটাতে অবাক হওয়ার মতো কিছুই ঘটবেনা। এ কারণে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে বিষয়টি খুব বিচক্ষণভাবে মোকাবেলা করতে হবে। সাকিব বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা খেলোয়ার। কোন বিশেষ কারণে যদি তাকে হারাতে হয় তবে তা হবে আমাদের ক্রিকেটের অপূরণীয় ক্ষতি।
পাদটিকাঃ সদ্য সমাপ্ত আইপিএলে সাকিব-কে কেকেআর দলে নিচ্ছিলনা বলে ব্লগ, ফেসবুক, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়াতে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। ব্লগ আর ফেসবুকে লগইন করলে দেখা যেত শুধু সাকিব আর কেকেআর। সাকিব এখানে একতরফা নায়ক আর মালিক শাহরুখ সহ অন্য কেকেআর সংশ্লিষ্টরা ভিলেন। দেশের একজন ক্রিকেটারের প্রতি এই টান বা পক্ষপাতিত্ব সব অবস্থায়ই স্বাভাবিক। তবে সেই আইপিএলের সূত্র ধরে ক্লান্ত সাকিব যখন দেশের পক্ষে খেলতে নারাজ তখন সেই ব্লগ, ফেসবুক, ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া অস্বাভাবিক নীরব।
আমার মনে এ বিষয়টা নিয়েও যদি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এবং গণমাধ্যমে চর্চা হতো তবে তা সাকিবের মননে পরিবর্তন আনতে সহায়ক ভূমিকা পালন করত। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।