অকস্মাৎ হতচকিত ঘটনা! দূর্ঘটনা তো বটেই। দূর্ঘটনাই ঘটেছিল বই কি। আহামরি তেমন কিছু নয়। হাতের দুটো আঙ্গুল বাসের চাকায় পিষ্ট হয়েছিল! হোক না দুটো মাত্র আঙ্গুল, দূর্ঘটনাই তো! পুরো হাতটাই চাপা পড়তে পারত! কিংবা পা; এমনকি পুরো শরীরটাও! যাই হোক শুধু দুটো আঙ্গুলের উপর দিয়েই যখন যাত্রা রক্ষা হচ্ছিল, তখন স্কুল ছুটি হয় ছুটি হয় অবস্থা। শেষ পিরিয়ড চলছে।
স্বভাবতই ছাত্রবৃন্দের দৃষ্টি যতনা ব্লাকবোর্ডে তার চাইতে ঢের বেশী জানালার বাইরে। নীলাকাশ, রাস্তাঘাট সবাইকে ডাকছে। মাথায় শুধু ঘুরছে এখনও ঘণ্টা বাজছে না কেন?
তবে, সেদিন আর ঘণ্টা বাজবার প্রয়োজন হয়নি শেষতক। সবাই ঘণ্টার অপেক্ষা না করেই ক্লাস থেকে বেড়িয়ে পড়েছিল। শিক্ষকবৃন্দও তাতে বাদ সাধেননি, বরং ছাত্রদের সাথেই দৌড় দিয়েছিলেন!
এখনও বুঝতে পারেন নি? ওই যে প্রথমেই বললাম না দূর্ঘটনার কথা! স্কুলের কোন এক ছাত্র কোন ভাবে ক্লাস শেষের আগেই বেড়িয়ে পড়েছিল বাইরের ডাকে; সম্ভবত নবম কি দশম শ্রেণীর।
আমি মনে হয় তখন অষ্টম শ্রেণীতে, অর্থাৎ ১৯৮৭ সালের কথা। তো সেই ছেলে বাসে ওঠবার সময় যে কোন ভাবেই হোক পড়ে যায় এবং দূর্ঘটনাটি না ঘটে উপায় থাকে না! যেহেতু শেষ পিরিয়ড এবং সবার দৃষ্টি ক্লাসের বাইরে, কজেই দূর্ঘটনাটি কারও নজর এড়ায়নি এবং মূহুর্তের মধ্যেই আমরা পুরো স্কুলকে রাস্তায় দেখতে পাই।
কয়েকজন শিক্ষক ছাত্রটিকে ধরাধরি করে হাসপাতালে নেবার ব্যবস্থা করলেন। তবে দূর্ঘটনায় তো আর সবাই পতিত হয়নি, কাজেই যারা দূর্ঘটনায় পতিত হয়েছিল না সেই সব ছাত্রবৃন্দ তড়িৎ আরেকটি ঘটনা ঘটিয়ে ফেলল। তারা ঢিল ছোড়াছুড়ি করে রাস্তায় গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দিল।
কিন্তু যেহেতু সেদিন এমনিতেই বেলা হয়ে গিয়েছিল কাজেই ঘটনা আর বেশী দূর গড়াল না; কারণ সবাই বাড়ীর পথ ধরেছিল।
কিন্তু ঘটনা আসলে সেখানে শেষ নয় বরং শুরু। পরদিন সবাই আবার স্কুলে আসলে ক্লাসে না বসে সোজা রাস্তায় জড়ো হল এবং পুনরায় ভাংচুর, ফলাফল রাস্তা বন্ধ। রোকেয়া স্মরণী যদিও সেই সময় খুব বেশী ব্যস্ত রাস্তা ছিল না, কিন্তু তারপরেও ঘটনা আরও অনেক দূর গড়াল। শিক্ষকবৃন্দ বালকদিগকে শ্রেণীকক্ষে নিতে যারপরনাই ব্যর্থ হলেন এবং সেখানে যুদ্ধাবস্থা বিরাজমান ছিল।
ঘটনা আরও অধিকদূর গড়াবার পূর্বেই শান্তি পুনরুদ্ধারে দৃশ্যপটে মারদাঙ্গা পোশাকে দাঙ্গা পুলিশের আবির্ভাব হল। বালকবৃন্দ এর জন্য প্রস্তুত ছিল না এবং সেই সময়ের প্রেক্ষিতে এই স্বল্প সময়ে কোন ডাকসাইটে কিশোর নেতার উত্থান দূরকল্প বিষয় ছিল। স্বভাবতই সবাইকে ক্লাসে ফিরতে হল, যদিও পাঠদান হচ্ছিল না। শিক্ষকবৃন্দ ক্লাসে ছিলেন কি ছিলেন না অতটা মনে নেই; তবে সিনিয়র শিক্ষকদের অনেকেই পুলিশের এবং প্রশাসনের সাথে মিটিং-এ ব্যস্ত ছিলেন।
দাঙ্গা পুলিশ স্কুলের ডান পাশের মাঠে অবস্থান নিয়েছিল, অর্থাৎ স্কুল এবং রাস্তার মাঝে।
অপরপক্ষে বালকবৃন্দ শ্রেণীকক্ষে অলস সময় অতিবাহিত করছিল। এই অলস সময়েই ঈবলিশ তার দৈনন্দিন কর্মটি সমাধা করে, ফলশ্রুতিতে অন্য ঘটনাটি সংঘটিত হয়। ঘটনার নায়ক ৬ষ্ট কি ৭ম শ্রেণীর এক বালক! আমি স্পষ্টঃতই এখনও তার মুখাবয়ব স্মরণ করতে পারি। মুখে সব সময় একটি লাজুক দুষ্টু হাসি লেগে থাকত। মাথা ভর্তি ছোট করে ছাটা খাড়া খাড়া চুল।
গায়ের রং শ্যামলার চাইতেও অধিক গাঢ়। তাতে তার বালক সুলভ সরলতার কোন ঘাটতি হয়নি এবং আর দশজন গোবেচারা ছাত্রের সাথে তার তুলনা অতি স্বাভাবিক ছিল।
নিঃসন্দেহে সে ঘটনার পরম্পরা সম্পর্কে ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেনি। মূলতঃ ঘটনা তেমন কিছু ছিল না। শ্রেণী কক্ষের ভাঙ্গা বেঞ্চের পায়া হাতে নিয়ে সেই অলস সময়ে মাঠে অবস্থানরত দাঙ্গা পুলিশের দিকে ষ্টেনগানের ভঙ্গীতে তাক করেছিল।
তাতে মারদাঙ্গা পোশাকের দাঙ্গা পুলিশের কারো কারো পিলে চমকে গিয়ে থাকবে! তারা প্রধান শিক্ষিকার নিকট নালিশ জানাতে বিন্দুমাত্র দেরী করেনি। প্রধান শিক্ষিকা পিলে চমকে আহত হওয়া দাঙ্গা পুলিশ সহযোগে চিহ্নিত শ্রেণীকক্ষে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনা করেন এবং বেঞ্চের পায়াসহ বালককে পাকড়াও করেন। বোধকরি তখন সে তার সহপাঠিদের RAMBOর ভূমিকায় বিমল আনন্দ দিচ্ছিল!
এবং অতঃপর:
পানি আরও অধিক দূর গড়াতে মূহুর্তমাত্র সময় নিল। যদিও কথা থেকে যায় কোথাকার পানি কোথায় গড়াল! সময়ের গতি গেল বেড়ে। RAMBO বালকের অভিভাবক তলব করা হল।
অভিযুক্ত RAMBO বালককে দাঙ্গা পুলিশের পিলে চমকে দিয়ে আহত করার অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করে স্কুল থেকে TC দেওয়া হল।
আমি এখনও চোখ বন্ধ করলে কাঁদতে কাঁদতে সেই বালকটিকে বড় বোনের হাত ধরে স্কুল থেকে চলে যেতে দেখতে পাই। ছেলেটার চোখে কালো ফ্রেমের চশমাও ছিল।
বেলা শেষের ভূমিকা:
পিলে এখন আর আমাদের চমকায় না। অথবা অধিক ভয়ে কুঁচকিয়ে মটকা মেরে আছে! দেশে জাদরেল প্রধান শিক্ষকও এখন আর নেই।
সবই অতীত দিনের কাহিনী। নচেৎ কবেই ‘অভিভাবক’ তলব করে হাতে নগদ TC ধরিয়ে কতজনকে দেশ থেকে বিদেয় করে দেওয়া হত!
জুন ০২, ২০১২
সিঙ্গাপুর ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।