সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে
বালকের আকাশদর্শণ-বায়োগ্রাফিমূলক ১
আর্টের স্কুল-বায়োগ্রাফিমূলক ২
এই পোস্টের সাথে একজনের অনুপ্রেরণা জড়ানো আছে। তাঁর প্রায় এক হালি নামের মধ্যে একটা নাম হলো - একলব্যের পুনর্জন্ম। তিনি একজন বড় মাপের কবি। তাই তাঁকে ধন্যবাদ দিয়ে খাটো না করে লেখাটা শুরু করা গেলো না। আশাকরি তিনি এসে তাঁর ধন্যবাদটা বুঝে নিবেন।
যে কোন লেখার ফরমায়েশি হয়ে ওঠার পেছনে দুটো প্রধাণ বৈশিষ্ট্য হলো -
১. এতে প্রচুর অযত্নের ছাপ থাকবে এবং
২. যিনি লিখছেন তিনি এমন ভাব করবেন যেন তার অনেক কাজ। নিতান্তই চাপের মুখে পড়ে তাড়াহুড়ো করে লিখে ফেলেছেন।
আমি যে সমগ্র লেখা জুড়ে এইসব বৈশিষ্টাবলী অক্ষুণ্ণ রাখার প্রাণপন চেষ্টা করেছি, তা পাঠক একটু পড়লেই বুঝতে পারবেন।
-----------------------------------------------------------------------------------
বালকের পৃথিবী ভাবনা - বায়োগ্রাফিমূলক ৩
আমার চোখে রাজ্যের ঘুম আর ডান কাঁধে একটা শান্তি নিকেতনি। দৈর্ঘ্যে এবং গাম্ভীর্যে আমাকে ছাড়িয়ে গিয়ে পায়ের গোড়ালি ছুঁয়ে দিচ্ছে বারবার।
মা'র কিনে দেওয়া। শান্তি নিকেতনি ঝুলিয়ে ছেলেকে আর্টিস্ট বানাবে। ভিতরে একটা নতুন কেনা খাতা, একটা প্যাস্টেলের বক্স। প্যাস্টেলের বক্সের মলাটে টম এন্ড জেরির ছবি। ছবির কাহিনী খুবই ইন্টারেস্টিং।
জেরি ন্যাংটো হয়ে সাওয়ার নিচ্ছে আর টম তলোয়ারের মত গোঁফগুলো দু'দিকে বাড়িয়ে দিয়ে পিছন থেকে উঁকি দিচ্ছে। কিন্তু এতো মজার বিষয়েও আমি আজ কোন আগ্রহ পাচ্ছি না। আমার কাঁধ থেকে ঝোলানো শান্তি নিকেতনি যে হেলেদুলে, বাতাসে উড়ে আমার পার্শ্ববর্তী রাস্তাঘাট পরিস্কারের দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে ওদিকেও খুব একটা ভ্রুক্ষেপ নেই।
ছুটির দিনে ঘুম হারানোর চেয়ে শোকাতুর বিষয় আর কিইবা হতে পারে? আমার এই এলোমেলো, ইতস্তত পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য আসলে মা'র প্রতি একটা মৌন স্মারকলিপি লেখা। শান্তি নিকেতনির ঝাড়ু হয়ে ওঠা এই স্মারকলিপির একটা অংশ মাত্র।
মা ছোটবেলা থেকেই খুব বুদ্ধিমতী ছিলেন। অধিকাংশ কথাবার্তা আমার মুখ ফুটে বেরুবার আগেই অনায়াসে বুঝে ফেলতেন। এবারও তার অন্যথা হলো না। আমার ঝাড়ুদার হয়ে ওঠার প্রবৃত্তি তার চোখে ধরা পড়ে গেলো। "ছেলে ঝাড়ুদার হতে চাইছে" এটা নিশ্চয় কোন মা'ই সজ্ঞানে মেনে নিবেন না।
আমার মাও নিলেন না এবং তৎক্ষণাৎ আমার শান্তি নিকেতনির কাঁধের ঝুলে একটা বড় গিট্টু মেরে দিলেন। ওবেচারা দৈর্ঘ্যে ও গাম্ভীর্যে ছোট হয়ে গিয়ে গোঁড়ালি থেকে আমার হাঁটুতে উঠে এলো। আমিও ঝাড়ুদার থেকে আর্টিস্ট বনে গেলাম।
সামনে একটা ছোট মাঠ। মাঠ পারলেই ক্লাসরুম।
ক্লাসের নাম "হাসিখুশি"। আমার মত যেসব ছোট্ট বাচ্চা চোখ কচলে, হাঁড়িমুখ করে বাসা থেকে একগাদা মন খারাপের দিস্তা নিয়ে প্রতি সপ্তাহে এখানে ছবি আঁকতে আসে, মূলত: ওদের জন্যেই এই ক্লাস।
ক্লাসের বেঞ্চিগুলো বেঢপ সাইজের। বসে থেকে টেবিল নাগাল পেতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। কিছু আর্টিস্ট দেখি হাত পা ছড়িয়ে দিয়ে টেবিলের উপরেই বসে পড়েছে।
কি সাংঘাতিক অভদ্র লোকজন! আমি কিছুক্ষণ জানলার বাইরে তাকিয়ে থাকি। মা'কে কোথাও দেখা যাচ্ছে না। খানিকটা আকাশ আড়াল করা আম গাছটাকে দেখা যাচ্ছে। আম গাছে অনেক কাকের বাসা দেখা যাচ্ছে।
হঠাৎ দেখি একটা ইয়া বড় গোঁফ ওয়ালা ব্যস্ত ভঙ্গিতে ক্লাসরুমে এসে ঢুকলো।
হাসি হাসি মুখ। কিন্তু গোঁফের আড়ালে তার হাসি বারবার চাপা পড়ে যাচ্ছে।
- আপনারা সবাই একটু ঠিকঠাক হয়ে বসেন তো দেখি। তারপর আসেন আমরা একটু গল্প গুজব করি।
চুলগুলো ঘাড় ছুঁই ছুঁই।
খুব শীর্ণকায় দেহে বেখাপ্পা ঢোলা একটা প্যান্ট। সরু কোমর। দেখে মনে হচ্ছে একটা জীবন্ত বালুঘড়ি সারা ক্লাসময় হেঁটে হেঁটে বেড়াচ্ছে। উনি বিভিন্নভাবে আমাদের সাথে সুসম্পর্ক তৈরী করার চেষ্টা করলেন। তার মধ্যে একটা হলো এই "আপনি আপনি" করে বলা।
ছোটরা সবসময় নিজেদের বড় ভাবতে পচ্ছন্দ করে। বালুঘড়ির এটা ভালোই জানা আছে। তার আরো কিছু মনভোলানো কথার শেষে আঁকিবুকি শুরু হলো। আঁকার বিষয় আমাদের চারপাশের পৃথিবী। আমি খানিকটা মাথা চুলকে খাতাটা বের করে গালে হাত দিয়ে বসে থাকলাম।
চারপাশে তো অনেক জিনিসপত্র। কোনটা ফেলে কোনটা আঁকি। তাছাড়া পৃথিবীর তুলনায় খাতাটা অনেক ছোট।
- কি আপনি আঁকছেন না কেন? মন খারাপ?
- না।
- তাহলে?
- কি আঁকবো ঠিক বুঝতে পারছি না?
- কেনো? পৃথিবী আঁকবেন।
পৃথিবী দেখেছেন কখনো?
- দেখেছি।
- কোথায় দেখেছেন?
- আমাদের বাসায়। ড্রইং রুমে।
- বাহ্! তাহলে ওটাই আঁকেন।
- গোল তো আঁকতে পারি না।
- আজকে তো প্রথম দিন। তাই পুরো গোল না হলেও সমস্যা নেই।
বালুঘড়ির কথা মত কালো প্যাস্টেলটা বের করে একটা গোল আঁকলাম। এবার চারপাশের জিনিসত্র আঁকতে হবে। জিনিসপত্রের কথা ভাবতেই প্রথমেই মনে এলো মাটি।
মাটি ছাড়া তো পৃথিবী সম্ভব না। গোলের ভেতরে সব মাটি। মাটির উপরে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। কিন্তু. . . কিন্তু . . . কিন্তু নিচের দিকে যারা আছে ওদের তো ধপাস্ করে যাওয়ার কথা। তাহলে?
তাহলে কি নিচে কেউ থাকে না? মেটে রঙটা হাতে নিয়ে দাগ দিতে যাব, এমন সময় মনে পড়লো সমাজ বইয়ের কথা - পৃথিবীর তিনভাগ জল, একভাগ স্হল।
মা বলেছে - স্হল মানে মাটি, জল মানে পানি। এইরে! তাইলে তো পানিও দেয়া লাগবে। গাঢ় নীলটা বের করি। গোলটার তিনভাগ এই রঙ দিতে হবে। কিন্তু পৃথিবীর সাথে পানিটা লেগে আছে কিভাবে? মাটি নাহয় লেগে আছে বুঝলাম, কিন্তু পানি তো ঝপাস্ করে পড়ে যাওয়ার কথা।
তাহলে?
তাহলে আর কি? পৃথিবীটা আসলে পানির উপরে ভেসে আছে। একটা অনেক বড় সমুদ্র। সমুদ্রের ভিতরে পৃথিবীর তিনভাগ ডুবে থাকে। আর উপরের একভাগে আমরা দাঁড়িয়ে থাকি। মাঝে মধ্যে আমারা হেঁটে হেঁটে সমুদ্রে বেড়াতে যাই।
মাছ ধরি। উপরের দিকে কিছু পাহাড়। খয়েরি রঙ এর। নীল রঙের আকাশ। আকাশে সূর্য।
একটা সবুজ আম গাছ। তার নিচে আমি। তারপর এই স্কুল। বাহ! নিজের বুদ্ধিমত্তায় নিজেই যেন চমকে উঠলাম।
এই করতে করতে দেখি অনেকের আঁকা শেষ হয়ে গেছে।
বালুঘড়িকে মাঝখানে বসিয়ে সবাই জটলা করে ছবি দেখাচ্ছে। একেকজন পৃথিবী সম্পর্কে নিজস্ব ধারণা ব্যক্ত করছে। লাল রঙের চশমা পড়া একটা মেয়ে বললো পৃথিবীতে নাকি কাকের সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। এ নিয়ে তার দু:শ্চিন্তার কোন শেষ নেই। সে নিজেও এঁকেছে একটা মস্ত কাকের ছবি।
পাশে একটা ছোট্ট পৃথিবী। কাকটা খুব আগ্রহ নিয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে আছে। যেন আরেকটু হলেই খেয়ে ফেলবে।
আমি খানিকটা ভয়ে ভয়ে আমার খাতাটা এগিয়ে দিলাম। সবাই আগ্রহ নিয়ে দেখতে শুরু করলো।
একজন জিজ্ঞেস করলো, "কালো মতন জিনিসটা কি?" আমি বললাম, "ঐটা আমি। আম গাছের নিচের দাঁড়িয়ে আছি। " তখন লাল রঙের চশমা পড়া মেয়েটা বললো, "আম গাছের নিচে আর কখনো দাঁড়িয়ো না। কাকে পু করে দিবে। " আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম।
বুঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমার মস্তবড় ভুল হয়ে গেছে।
বালুঘড়ি তার চুলে আঙুল চালাতে চালাতে বললো, "তা, আপনি পানিতে ভেসে ভেসে কোথায় যাচ্ছেন?" আমি বললাম, "পৃথিবী যে দিকে যাচ্ছে ঐদিকে। " কে যেন জিজ্ঞেস করলো, "এতো পানি কোত্থেকে এলো?" আমি তখন সমাজ বইয়ের তিন ভাগ একভাগ ব্যাপারটা খুলে বললাম। এটা শুনে দেখি বালুঘড়ি জোরে জোরে হাসতে শুরু করলো। এবারও গোঁফের নিচে তার হাসি চাপা পড়ে গেলো।
কোন একটা অদ্ভুত কারনে লোকটাকে আমার খুব ভালো লেগে গেলো। তার হাসি আড়াল করা গোঁফটাকেও। আরো কয়েকজনের ছবি দেখার পরে বালুঘড়ি বললো, "আমাদের এখানে একটা লাইব্রেরি আছে। আপনারা চাইলে ওখানে ঘুরে দেখতে পারেন। আর এখন আপনাদের ছুটি!"
ছুটি শব্দটার সাথে সবসময় একটা মন ভালো করা ব্যাপার থাকে।
যথারীতি আমারও
মন ভালো হয়ে গেলো। কিন্তু বাইরে বের হতেই দেখি চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার। ঝড়ো বাতাসে মাঠের ধুলো উড়ছে। গেটের কাছে আঙ্কেল আন্টিদের জটলা। কিন্তু মা'কে কোথাও দেখতে পেলাম না।
একটু পরেই ঝম ঝমিয়ে বৃষ্টি নামল। আমি তবু বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকলাম। মা আসলে যেন দূর থেকে আমাকে দেখতে পায়। ক্লাসরুমের টিনের চালে তুমুল শব্দ হতে লাগলো। আমি এতো জোরে বৃষ্টির শব্দ আগে কখনো শুনিনি।
----------------------------------------------------------------------------------
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।