আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বালকের আকাশদর্শণ-বায়োগ্রাফিমূলক ১

সুবিনয় মুস্তফীর কথা মনে পড়ে এই হেমন্তের রাতে

মা কে পাশে রেখে হুডতোলা রিকশায় আমি চোখ পাতি বাইরে। শুক্রবারের আসন্ন বিকেল। রাস্তা তো নয় যেন পিচ ঢালা ফুটবল খেলার মাঠ। তাই রিকশা চলছে দ্রুতলয়ে। এবড়ো থেবড়ো রাজপথ অভদ্রের মতো তার অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে প্রায়শ:।

ঘুম চোখেও আমি অস্হিমজ্জায় টের পাই তাদের সশব্দ এবং কর্কশ কথোপকথন। দীর্ঘ সাতদিনের এক আপোষহীন রুটিনের পরে এই শুক্রবারের বিকেলগুলো আমার জন্য দেবতার উপঢৌকনের মতো ছিলো। "যা খুশি কর্"ব্যাপারটার মধ্যেও একটা সুক্ষ কারচুপি আছে বলে আমার বিশ্বাস। দেখা গেল প্রায় আমার এই সাধের ইচ্ছেমতন বিকেলে আমি বাবার কাঁধ জড়িয়ে পরম আনন্দে ঘুমিয়ে আছি। সেই সুত্রে ঘুমও একটা ব্যক্তিগত শখের ব্যাপার হতে পারে।

যদি এমন একটা বহুজাতিক কোম্পানির চাকরী পেতাম যেখানে স্যুট-টাই পড়ে নটা-পাঁচটা ঘুমিয়ে থাকার জন্য মাস শেষে কড়কড়ে নোটে মাইনে দেবে। সাথে ফেস্টিভল বোনাস,মেডিকেল কেয়ার,ট্রান্সপোর্ট ফি সহ আরো কতও কী!!-আহা!!কী ঘুমবিলাস। তো এই ঘুম তাড়িত বৈকালিক সৌখিনতা সপ্তাহের অন্যান্য দিনগুলোতে আমার মার যথেষ্ট সৌজন্যবোধের অভাবে হরহামেশাই মুখ থুবড়ে পড়ে। পুত্রের ব্যক্তিগত শখের ব্যাপারে মার হয়তো আপত্তি নেই মোটেও কিন্তু এখনো দ্বিতীয় শ্রেণীতে অধ্যয়নরত নাবালকের ব্যক্তি হয়ে ওঠার ঔদ্ধত্যে তিনি মা হিসেবে কপালে শতকোটি বলিরেখা আঁকবেন,অত:পর প্রয়োজনবোধে নানাবিধ উপকরনসমেত (উদাহরনস্বরূপ-আমার রুলটানার স্কেল,ভাতের চামচ)তেড়ে আসবেন অশনী গতিতে-এটাই প্রচলিত সমাজের চিত্র। বলাবাহুল্য আমার মা এই চলচ্চিত্রের একজন সুদক্ষ কৌশলী।

এছাড়া অন্যান্য সময়ে তিনি কলেজে রসায়ন পড়ান। এই রসায়ন বিষয়বস্তুটা যে কি পরিমান রস বিবর্জিত তা বোধকরি দ্বিতীয় শ্রেণীতে পড়ার বহুআগে থেকেই আমি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছিলাম এবং উচ্চ মাধ্যমিক পড়ার সময় পুরাকালের উপলব্ধির সাথে ভুক্তভোগী বাস্তবতার একটা নান্দনিক মেলবন্ধন তৈরীর অবকাশ পাই। রসায়ন শিক্ষার অবসরে মা র নানাবিধ রাসায়নিক কর্মকান্ডে আমরা পরিবারের সবাই (এমনকী ক্ষেত্রবিশেষে বাবাও)বিক্রিয়ক হবার আশঙ্কায় তটস্হ থাকি সারাক্ষণ। বাবা গনিতের লোক। আটপৌরে,সাধাসিধে,কারো সাতে নাই পাঁচে নাই টাইপের বিশেষনগুলোর এক সাক্ষাত মুখপাত্র।

সারাদিন দেখি ইংরেজী এ্যালফেবেট নিয়ে কি সব কাটাকুটি!!a আর b যোগ করলে কিভাবে c হয় এই চিন্তায় আমার প্রায় রাতে ঘুম হয় না অবস্হা। মাঝে মাঝে বড়োদের উপর বেজায় রাগ হয়। ওরা নিজেদের বেশি বেশি চালাক ভাবে। রসায়নবিদ হবার সুবাদে মাকে আমি কখনো দেখি নাই লম্বা চুলের বেনী দুলিয়ে সারা ঘরময় আনমনে গুন গুন করে বেড়াতে কিংবা আমার গনিতবিদ বাবাকে নাকের ডগায় চশমা ঝুলিয়ে কোন স্বাস্হ্যবান কবিতার বই হাতে সুনশান প্রশান্তমুখ। এহেন ডেডিকেটেড গনিত আর রসায়নের মিউচুয়াল আন্ডারস্টেন্ডিংএ আমার মতো নচ্ছার অলস মস্তিষ্ক উৎপাদিত হবার প্রবাবিলিটি এতোই ক্ষীণ যে মটরশুটিবিদ্যা অনুসারে আমার প্রপ্র-পিতামহের কাউকে না কাউকে অবশ্যই বাঈজী দলের সর্দার হতে হবে।

তো শুক্রবারের বিকেলে ঘুমানো ছাড়াও আরো একটি সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো --বারান্দায় বসে আকাশ দেখা। সবাই যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন আকাশের অনেক নিচে একটা পুকুর। পাড় ঘেঁষা রাস্তা-মানুষ। একটা কাঠমিস্ত্রির দোকান। ওদের অবিরাম ঠুক ঠাক।

একটা কাঠের ফ্রেমে খোদাই করা অবিকল মানুষের মুখ। বাবা বলেছে উনি আমাদের দেশের প্রেসিডেন্ট ছিলেন একসময়। প্রেসিডেন্ট ছিলো বলে তার মুখ খোদাই করে রাখতে হবে?প্রেসিডেন্টের তো ভারী মজা!!অথচ লোকগুলো সারাদিন কি কষ্টটাই না করছে এই ফ্রেমের পেছনে?ওদের তো আরো অনেক কাজ থাকতে পারে-খাট পালং চেয়ার টেবিল আলনা শো কেস শেলফ আরো কত কি পড়ে আছে!এসব মন-খারাপে আমারও প্রেসিডেন্ট হওয়ার সাধ জাগে। পরে ওদের সবাইকে ডেকে বলবো-তোমরা তোমাদের কাজ করো। আমার মুখের ফ্রেম বানানোর কোন দরকার নেই! মাঝে মাঝে অবশ্য শুধু আকাশ দেখেই কাটাতে হয়।

আমাদের রেলিংটা আমার মাথার চেয়ে বেজায় উঁচু হওয়ায় পায়ের তলায় মোড়া ছাড়া আমি নিচের পৃথিবী দেখতে পাই না। তখন বাসার অনেকে মিলে টেলিভিশন দেখে,শুক্রবার বিকেলে টিভিতে সাদা কালো ছবি। তাই মোড়া খালি পাওয়া যায় না। অবশ্য আমার আকাশ সবসময় রঙীন থাকে। আমি মেঘ গুলোর যাওয়া আসা দেখি।

কারো খুব তাড়া!!এই এলো এই চলে গেলো। কেউ কেউ খুব বড়ো। ওদের অতো তাড়া নেই। অনেকক্ষন তাকিয়ে থাকলে আমি ওদের মধ্যে চেনাজানা জিনিস পত্র দেখি। মনে হয় ওরা ইশারায় কিছু বলছে।

কখনো ইশারা সহজ থাকে। কখনো কোন মাথা মুন্ডু খুঁজে পাই না। একটা পিঁপড়ের পেটে আস্ত বাঘ ঢুকে যাচ্ছে এটা নিশ্চয় খুব একটা ভালো ইশারা না। তারপরও আমি সায় দেই--"অ বুঝছি! বুঝছি!" মেঘমানুষ!!পরে কি না কি মনে করে বসে? কোন মৌসুমে আকাশে ঘুড়ির মেলা বসে। আহা! সে এক দৃশ্য বটে।

এতো এতো ঘুড়ি। অথচ ঘুড়ির মানুষ দেখি না একটাও। কোন কোনটা মনে হয় আমাদের ছাদ থেকেই উড়ছে। আমার মনে হয় এই খেলায় মানুষের চেয়ে ঘুড়িই বেশী মজা পায়। আকাশের কাছ থেকে কেমন লাগে দেখতে?কিংবা মেঘগুলো থেকে আমাদের বাসা কেমন দেখা যায়?ঘুড়ি ওড়ানোর প্রতি আমার খুব একটা আগ্রহ দেখিনা কিন্তু ঘুড়ি হওয়ার খুব শখ আমার।

গুনীজনে কি সাধে বলে-অলস মস্তিষ্ক শয়তানের কারখানা? তো এই অলস মস্তিষ্ককে গতিশীল করতেই মার সহিত আমার দ্রুতগতির এই রিকশাভ্রমণ। আমার ইচ্ছে-বিকেল গুলোকে একটা সামাজিক রূপদানের মা-গত আরেকটি প্রয়াস। আমাদের গন্তব্য আর্টের স্কুল।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।