একজন অলস মানুষ আমি এক মাস হতে চলল, এ-লেভেল শিক্ষার্থী হিমাদ্রী মজুমদার খুনের ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। পুলিশের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গতকাল শনিবার চট্টগ্রাম মহানগর হাকিম মুনতাসির আহমেদ হত্যার ঘটনায় ব্যবহূত জার্মানির ডোবারম্যান নামের তিনটি কুকুর চিড়িয়াখানার হেফাজতে দেওয়ার আদেশ দেন।
পরে গতকাল রাত ১০টার দিকে চেতনানাশক ইনজেকশন দিয়ে কুকুরগুলোকে অচেতন করে চট্টগ্রাম চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাওয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গতকাল শহরের প্রবর্তক মোড়ে মাদকবিরোধী সংগঠন ‘শিকড়’-এর সদস্যরা মানববন্ধন করেন। পাঁচলাইশ এলাকায় মাদকের বিরুদ্ধে সোচ্চার ভূমিকা রাখার কারণেই হিমাদ্রীকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয় বলে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ধারণা।
এ মামলার মূল আসামি জুনায়েদ আহমদ ওরফে রিয়াদের (২৫) সঙ্গে হিমাদ্রী ও শিকড়ের সদস্যদের চার মাস আগে কথা-কাটাকাটি হয়েছিল বলেও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে। এর জের ধরেই তাঁকে হত্যা করা হয়। গত ২৭ এপ্রিল কুকুর লেলিয়ে দেওয়ার পর শহরের মাস্টারমাইন্ড কারিকুলাম স্কুলের চতুর্থ তলার ছাদ থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেওয়া হয় হিমাদ্রীকে। ওই ভবনের তৃতীয় তলায় জুনায়েদের বাসা। সামারফিল্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজের ছাত্র হিমাদ্রীকে কৌশলে সেখানে ডেকে নেওয়া হয়েছিল।
গুরুতর আহত হিমাদ্রী ২৬ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর গত বুধবার ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে মারা যান।
ঘটনার পরপরই হিমাদ্রীর বাবা প্রবীর মজুমদার পাঁচলাইশ থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। এর পরও পুলিশ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ঘটনার দুই দিন পর হামলাকারী জুনায়েদ লন্ডনে পালিয়ে যান। পুলিশ সূত্র জানায়, হিমাদ্রীর মৃত্যুর পর গত বুধবার জুনায়েদ ও তাঁর বাবা শাহ সেলিম ওরফে টিপুসহ পাঁচজনকে আসামি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা হয়েছে।
মামলার অন্য তিন আসামি হচ্ছেন সাজু (২৭), জেনি (২৫) ও শাওন (২৩)। মামলার বাদী হিমাদ্রীর মামা। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মামলা হওয়ার পরও পুলিশ আসামিদের গ্রেপ্তার করতে পারেনি। এ প্রসঙ্গে পাঁচলাইশ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আলমগীর হোসেন বলেন, ‘হিমাদ্রীর পরিবার আমাদের সহযোগিতা করছে না। তারা ভয় পাচ্ছে।
আমাদের ডিসি ও এসি স্যারও হিমাদ্রীর পরিবারের সঙ্গে কথা বলেছেন। আসামিরা পলাতক রয়েছে। ’
জিডির পরও কেন এ ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি, জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা উপপরিদর্শক (এসআই) কাজী জহির বলেন, ‘তখন থেকে হিমাদ্রীর পরিবারের সহযোগিতা পাইনি। আমরা হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসাধীন হিমাদ্রীর সঙ্গে কথাও বলেছি। ’
পুলিশের খাতায় শাহ সেলিম পলাতক থাকলেও গত শুক্রবার তাঁর মুঠোফোন খোলা ছিল।
গতকাল শনিবার তাঁর ফোন নম্বরে অনেকবার চেষ্টা করে বন্ধ পাওয়া গেছে। গতকাল ওই বাসায় গিয়ে গৃহপরিচারিকা পাখি বেগম ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায়নি। পাখি বেগম বলেন, ‘বাসার মালিকেরা এখানে আসেন না। ঘটনার দিন এখানে তাঁরা ছিলেন। ’
আদালতের আদেশ: হিমাদ্রীর পেছনে লেলিয়ে দেওয়া জার্মানির হিংস্র তিনটি কুকুরকে চিড়িয়াখানার হেফাজতে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন মহানগর হাকিম মুনতাসির আহমেদ।
গতকাল এক আদেশে তিনি বলেন, এই তিনটি কুকুর হিমাদ্রী হত্যাকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ আলামত। এগুলোকে চিড়িয়াখানা কর্তৃপক্ষ যত্ন নেবে। আর আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তদন্তের অগ্রগতি আদালতকে জানাতে হবে।
এ প্রসঙ্গে তদন্ত কর্মকর্তা কাজী জহির বলেন, ‘আমরা কুত্তা নিয়ে মহা বিপদে আছি। এগুলোর পাশে কেউ ঘেঁষতে পারছে না।
এগুলোকে চিড়িয়াখানার হেফাজতে দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। আমরা দ্রুত সময়ের মধ্যে কুকুরগুলো চিড়িয়াখানায় হস্তান্তর করব। ’
ঘটনার নেপথ্যে: মাদক ব্যবসার প্রতিবাদই হিমাদ্রী খুনের মূল কারণ বলে মনে করছে পুলিশ ও হিমাদ্রীর বন্ধুরা। ছাদ থেকে ফেলে দেওয়ার পর আহত হিমাদ্রী হাসপাতালের শয্যায় শুয়ে ঘটনায় জড়িত ব্যক্তিদের নাম বলে গেছেন। ওই জবানবন্দি হিমাদ্রীর বন্ধুরা রেকর্ড করেন।
হিমাদ্রী বলছিলেন, তিনি একটি মেজবানে যাওয়ার জন্য রিজভি ভাইয়ার বাসায় যাচ্ছিলেন। পাঁচলাইশে পৌঁছার পর রিয়াদ, শাওন, জেনি ও সাজু তাঁকে সেখান থেকে টেনেহিঁচড়ে জুনায়েদের বাসার ছাদে নিয়ে যান। হিমাদ্রী তখন তাঁদের করজোড়ে বলেন, ‘ভাইয়া, আমি কোনো দোষ করিনি। ’ তার পরও হিমাদ্রীকে কুকুর লেলিয়ে দেওয়া হয়। হিমাদ্রী তখন রেলিংয়ে উঠে পড়েন।
এরপর তাঁকে ধাক্কা মেরে ছাদ থেকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়। গুরুতর আহত হিমাদ্রীকে প্রথমে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। পরে অবস্থার অবনতি হলে ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে পাঠানো হয়।
শিকড়ের সাধারণ সম্পাদক জাওইদ আলী চৌধুরী বলেন, ‘দুই বছর আগে আমরা পাঁচলাইশে মাদক ব্যবসা বন্ধের জন্য সংগঠনটি গড়ে তুলি। তখন থেকেই এলাকার মাদক ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আমাদের বিরোধ।
হিমাদ্রী আমাদের সক্রিয় সদস্য। এ নিয়ে গত বছরের জুনে আমাদের সঙ্গে মাদক ব্যবসার হোতা শাহ সেলিমের সংঘর্ষ হয়। তখন আমরা পাঁচলাইশ থানায় জিডি করেছিলাম। এরপর চার মাস আগে হিমাদ্রীর সঙ্গে সেলিমের ছেলেদের কথা-কাটাকাটি হয়। এ ঘটনার কারণেই তাঁকে পরিকল্পিতভাবে খুন করা হয়।
’
গতকাল দুপুরে হিমাদ্রীর বাসায় গিয়ে দেখা যায়, তাঁর মা গোপা মজুমদার অঝোরে কাঁদছেন। তিনি বলেন, ‘হাসপাতালে ছেলে আমাকে বলেছে, “মা, আমাকে বাঁচাও। ” আমি বাঁচাতে পারলাম না। ’ বাবা প্রবীর মজুমদার বলেন, ‘কী হবে! আমার ছেলেকে কি আর ফিরে পাব? আমার কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে তার মায়ের কিনে দেওয়া পাঞ্জাবিটা সেদিন প্রথম পরে বের হয়েছিল। আর ফিরল না।
’
মানববন্ধন: হিমাদ্রী হত্যার প্রতিবাদে গতকাল নগরে দুটি মানববন্ধন ও সমাবেশ হয়েছে। দুপুরে নগরের প্রবর্তক মোড়ে শিকড় ও বিকেলে প্রেসক্লাব প্রাঙ্গণে হিমাদ্রীর বন্ধুরা আরেকটি মানববন্ধন করেন। শিকড়ের সভাপতি এম ইসমাইল, সাধারণ সম্পাদক জাওইদ আলী চৌধুরী, রেজাউল করিম প্রমুখ এতে বক্তব্য দেন। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।