যেমন কর্ম তেমন ফল।
জলাধার সংরক্ষণ আইন উপেক্ষা করে ভরাট করা হচ্ছে রাজধানীর কৃষি ও জলাভূমি। বিশেষ করে রাজধানীর উত্তরাংশের উত্তর খান, দক্ষিণ খান, বরুয়া ও ডুমনি এলাকায় কৃষিজমি, সরকারি খাল ও জলাশয় ভরাট করছে এক শ্রেণীর ভূমিদস্যু। রাজউক এসব অবৈধ ভরাট কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিলেও তা মানা হচ্ছে না। অবৈধভাবে জমি ভরাটের অভিযোগে এলাকা থেকে একটি হাউজিং কোম্পানির ৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।
কিন্তু এরপরও জমি ভরাটের মহোত্সব থামছে না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) তথ্য অনুযায়ী সারাদেশে প্রতি বছর ৪২ হাজার একর কৃষিজমি ও জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। জলাধার সংরক্ষণ আইন করেও ভরাটের কবল থেকে কৃষিজমি ও জলাশয় রক্ষা করা যাচ্ছে না। পরিবেশবিদরা বলেছেন, এভাবে ভরাট প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে দেশে ভয়াবহ কৃষিভূমি ও মত্স্য সম্পদের অভাব দেখা দেবে। এতে করে দেশে তীব্র খাদ্য সংকটের সৃষ্টি হতে পারে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, উত্তর খান, দক্ষিণ খান, বরুয়া ও ডুমনি এলাকায় প্রতিদিন শতাধিক ড্রেজার দিয়ে মাটি ভরাটের কাজ চলছে। এতে করে জলাবদ্ধতা স্থানীয় অধিবাসীদের জন্য স্থায়ী সমস্যায় পরিণত হয়েছে। শত শত একর কৃষিজমির উত্পাদন ব্যাহত হচ্ছে। বেকার হয়ে পড়েছে এলাকার শত শত কৃষক পরিবার। কৃষকরা বলছেন, একাধিক প্রভাবশালী মহল জলাভূমি ভরাটের পাশাপাশি জোর করেই তাদের জমিগুলো ভরাট করছে।
এ ব্যাপারে আদালত, থানা কিংবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে লিখিত অভিযোগ করেও ভুক্তভোগীরা কোনো প্রতিকার পাচ্ছেন না।
রাজউক, গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, বাপা ও পরিবেশ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, অবৈধ ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে শত শত একর কৃষিজমি জোর করে ভরাটের ফলে উত্তরখান, দক্ষিণখান, বরুয়া ও ডুমনি এলাকায় স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে কৃষিজমিগুলো সারাবছরই পানির নিচে ডুবে থাকে। ফলে কয়েকশ’ কৃষক পরিবার বেকার হয়ে পড়েছে। তাদের জীবন ও জীবিকায় নেমে এসেছে স্থবিরতা।
রাজউক ওই এলাকার কৃষিজমি, খাল-বিল ও সরকারি জলাশয় ভরাট করা থেকে সংশ্লিষ্টদের বিরত থাকার নির্দেশ দিলেও তা মানা হচ্ছে না। এদিকে রাজউক জলাধার সংরক্ষণ আইনে ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে মামলা করেও অবৈধ ভরাটকাজ ঠৈকাতে পারছে না। স্থানীয়দের অভিযোগ, তাদের শেষ সম্বল কৃষিজমিগুলো রক্ষায় সংশ্লিষ্ট থানায় একাধিক মামলা এবং জিডি করেও ফসলি উর্বন জমিগুলো রক্ষা করতে পারছে না। একটি ক্ষমতাধর মহল আবাসন প্রকল্পের সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে নিরীহ কৃষকের জমি দখল করে নিচ্ছে। কৃষকের চোখের সামনেই তার শেষ সম্বল কৃষিজমিটি দখল করে বালু ভরাট করছে।
পুলিশের সাহায্য না পেয়ে অনেকে বালু ভরাটে বাধা দিতে গিয়ে হাউজিং কোম্পানির মাস্তানদের হাতে লাঞ্ছিত ও রক্তাক্ত হয়ে ঘরে ফিরছে। পুলিশ এদের বিরুদ্ধে মামলা না নিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জিডি নিচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে তা-ও নিচ্ছে না বলে জানিয়েছেন উত্তর খান, দক্ষিণ খান, বরুয়া ও ডুমনি এলাকার ভুক্তভোগী মানুষ। তারা ভূমিদস্যুদের বিরুদ্ধে প্রতিকার চেয়ে রাজউক, সংশ্লিষ্ট থানা পরিবেশ অধিদফতরসহ খোদ প্রধানমন্ত্রীর কাছে একাধিকবার আবেদন করেছেন।
ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিক্রিয়া
বরুয়ার অদিবাসী শফিকুর রহমান বলেন, রাজধানীর উত্তরাঞ্চলের শত শত একর জমিতে সবজি চাষ করে এলাকার কয়েকশ’ পরিবার জীবিকানির্বাহ করছে।
জলাবদ্ধতার জন্য তাদের চাষাবাদ ব্যাহত হচ্ছে। ওয়াসেক আহমেদ বলেন, গত কয়েক বছর ধরে উত্তর খান, দক্ষিণ খান, বরুয়া, ডুমনি এলাকার কৃষিজমিগুলো অবাধে ভরাট করা হচ্ছে। কিছু হাউজিং কোম্পানি ৫-১০ বিঘা জমি কিনে শত বিঘা জমি অবৈধভাবে ভরাট করছে। আদালত, এমনকি থানা পুলিশ করেও এদের কবল থেকে কৃষিজমি রক্ষা করা যাচ্ছে না। প্রতিদিনই শতাধিক ড্রেজার দিয়ে বালু ফেলে কৃষিজমি ভরাট করা হচ্ছে।
বিক্রি হয়ে যাচ্ছে জলাশায়ও। ব্যক্তিবিশেষের জমিও জবরদখল করা হচ্ছে। এলাকার একমাত্র ডুমনি খালসহ জলাশয়ও ভরাট হয়ে যাচ্ছে অবাধে। তারা এর প্রতিকার দাবি করছেন।
রাজউকের উপ-পরিচালক (নগর পরিকল্পনা অঞ্চল-২) মোঃ সিরাজুল ইসলাম বলেন, রাজধানীর উত্তরখান, দক্ষিণখান, বরুয়া ও ডুমনি এলাকার শত শত একর কৃষি জমি, জলাশয় ও ডুমনি খাল রক্ষায় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সুস্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে।
তিনি বলেন, একটি আবাসন প্রকল্প ওই এলাকায় গড়ে তোলা হয়েছে রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই। তাছাড়া স্থানীয় বাসিন্দা আক্কাস আলী, আলফাছ উদ্দিন, আবুল হাসেম, আবুল কাশেম, আবদুল মোতালেব, আমির হোসেন, সিরাজুল ইসলাম, রমজান আলীসহ শতাধিক কৃষক পরিবারের জমি জবরদখলসহ বালু ভরাটের অভিযোগ রয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত প্রতিটি কৃষক রাজউকে লিখিত অভিযোগসহ সংশ্লিষ্ট থানা এবং আদালতে জমি দখল ও বালু ভরাট রোধে মামলা করেছে। আদালত ও রাজউক ইতিমধ্যেই হাউজিং সংস্থাটিকে সকল কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তারা রাজউক ও আদালতের সকল নির্দেশনা উপেক্ষা করেই কৃষি জমি ও জলাধারসহ খাল-বিল দখল এবং ভরাট প্রক্রিয়া অব্যাহত রেখেছে।
এ ব্যাপারে জলাধার সংরক্ষণ আইনে মামলা হলেও পুলিশ রহস্যজনক কারণে ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে কার্যকর কোন ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সভাপতি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ বলেন, প্রতিবছর দেশে ৪২ হাজার একর কৃষি জমি ও জলাশয় ভরাট হয়ে যাচ্ছে প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায়। কৃষি জমি ও জলাশয় ভরাট বন্ধে দেশে জলাধার সংরক্ষণ আইন প্রণিত হলেও তার কোন কার্যকারিতা নেই। পুলিশ ও ভূমি প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহায়তায় প্রতিদিনই কৃষি জমি ও জলাশয় ভরাট অব্যাহত রয়েছে। তিনি রাজধানীর উত্তরখান, দক্ষিণখান, বরুয়া ও ডুমনি এলাকাসহ রাজধানীর পার্শ্ববর্তী কেরানীগঞ্জ, সাভার এলাকার জলাভূমি ও কৃষি জমি ভরাট বন্ধে প্রশাসনের প্রতি কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের আহবান জানান।
রাজউক চেয়ারম্যানের বক্তব্য
রাজউকের চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নূরুল হুদা বলেন, উত্তরখান, দক্ষিণখান, বরুয়া ও ডুমনি এলাকায় রাজউকের অনুমোদন ছাড়াই একাধিক অবৈধ আবাসন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। অননুমোদিত এসব হাউজিং কোম্পানিগুলো সরকারি খাল-বিল, জলাশয় অবৈধভাবে ভরাটের পাশাপাশি ব্যক্তি বিশেষের জমিও জবরদখল করে নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই এসব আবাসন প্রকল্পের বিরুদ্ধে জলাধার আইনে মামলা করা হয়েছে। মাটি ভরাটসহ সকল কার্যক্রম বন্ধে রাজউক অননুমোদিত হাউজিং কোম্পানিগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে। সাইনবোর্ডগুলোও অপসারণ করা হয়েছে।
রাজউক চেয়ারম্যান বলেন, এদের বিরুদ্ধে সরকারি ডুমনি খাল ভরাটেরও অভিযোগ রয়েছে। রাজউক ও ওয়াসা কর্তৃপক্ষ খালটি যৌথভাবে উদ্ধারের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ওয়াসার চেয়ারম্যান প্রকৌশলী ড. গোলাম মোস্তফা এ প্রসঙ্গে বলেন, রাজধানীর উত্তরাঞ্চলের অন্যতম পানি প্রবাহের উত্স ডুমনি খালটি ভরাটের ফলে উত্তরখান, দক্ষিণখান, বরুয়া ও ডুমনি এলাকার নিম্নঞ্চল সারা বছরই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে করে পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বৃষ্টির পানিতে জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হচ্ছে।
তিনি বলেন, ওয়াসার খাল উদ্ধার অভিযানের তালিকায় ডুমনি খালটি রয়েছে। শিগগিরই রাজউক ও ঢাকা ওয়াসা যৌথ উদ্যোগে খালটি উদ্ধারে অভিযান শুরু করবে। এ লক্ষ্যে সকল পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ চলছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।