You can do anything, but not everything.
বন্ধুবর মিনার সবুর করিতে চাহিতেছিলেন; উহার “স্টুডেন্ট” এর পরীক্ষা; কিন্তু অভি আর দৌলা সবুর করিতে চাহিতেছিলেন না; বিশেষ করিয়া দৌলা। উহার নাকি ঢাকার বাইরে যাইবার জন্য প্রাণ হাস ফাস করিতেছিল। উহা ছাড়াও অভির বাড়ি যাইবার সময়ও ক্রমেই কমিয়া আসিতেছিল; ভদ্র অভদ্র কোন উপায়েই উহাকে বাড়ানো যাইতেছিল না। সকলের হাতেই টাকার সংকট ; কিন্তু ভ্রমণের আনন্দের আপেক্ষিক গুরুত্ত টাকার শোকের চেয়েও কিঞ্চিৎ উপরে আছে , সেইজন্যই তাড়া। আমি ছিলাম গ্রুপে নতুন; সুতরাং ভ্রমণসম্বন্ধে আমার মত যাচাই করা অনাবশ্যক ছিল।
আমার কাজ আমি করিয়াছি , একখানা টিউশনি বাগাইয়া কিছু অর্থ বগল দাবা করিয়াছি। সুতরাং; সকল পক্ষই ভ্রমণে যাইবার জন্য বিচলিত হইয়া উঠিল।
আমাদের দেশে যে মানুষ একবার ভ্রমণে বাহির হইয়াছে ভ্রমণ সম্বন্ধে তাহার মনে আর কোনো উদ্বেগ থাকে না। নরমাংসের স্বাদ পাইলে মানুষের সম্বন্ধে বাঘের যে দশা হয়, বাস ট্রাক লঞ্চ নৌকা বিমান সম্বন্ধে তাহার ভাবটা সেইরূপ হইয়া উঠে । অবস্থা যেমনি ও মাধ্যম এবং গন্তব্য যাহাই হউক, অভাব ঘটিবামাত্র তাহা পূরণ করিয়া লইতে তাহার কোনো দ্বিধা থাকে না।
যত দ্বিধা ও দুশ্চিন্তা সে দেখি আমাদের নবীন ছাত্রদের । ভ্রমণের পৌনঃপুনিক প্রস্তাবে তাহাদের ব্যাগ কাপড়ে কাপড়ে মোটা হইয়া উঠে আর যাত্রার ঠিক প্রাক্কালে উহার দুশ্চিন্তার ভারে সকল কাপড় নামিয়া যায় !!!
সত্য বলিতেছি , আমার মনে এমন বিষম উদ্বেগ জন্মে নাই । বরঞ্চ কুষ্টিয়া ভ্রমণের কথায় আমার মনের মধ্যে যেন দক্ষিনে হাওয়া দিতে লাগিল। কৌতূহলী কল্পনার কিশলয়গুলির মধ্যে একটা যেন কানাকানি পড়িয়া গেল । যাহাকে ২৫ তারিখ একটা কন্টেস্টের কোড জমা দিতে হইবে , তাহার পক্ষে এ ভাবটা দোষের ।
আমার এ লেখা যদি টেক্স্ট্বুক্-কমিটির অনুমোদিত হইবার কোনো আশঙ্কা থাকিত তবে সাবধান হইতাম।
আমরা যেই পরিবহনে করিয়া কুষ্টিয়া রওয়ানা দিয়াছিলাম তাহার সত্য নামটা দিব না। কারণ , পৃথিবীর ইতিহাসে তাহার নামটি লইয়া প্রত্নতাত্ত্বিকদের মধ্যে বিবাদের কোনো আশঙ্কা নাই। যে তাম্রশাসনে তাহার নাম খোদাই করা আছে সেটা আমার হৃদয়পট । কোনোকালে সে পট এবং সে নাম বিলুপ্ত হইবে , এমন কথা আমি মনে করিতে পারি না ।
কিন্তু , যে অমৃতলোকে তাহা অক্ষয় হইয়া রহিল সেখানে ঐতিহাসিকের আনাগোনা নাই।
আমার এ লেখায় তাহার যেমন হউক একটা নাম চাই। আচ্ছা , তাহার নাম দিলাম চান্দের গাড়ি। চান্দের পৃষ্ঠে গাড়ি ছাড়িয়া দিলে জেইরুপ উত্থাল পাতাল অবস্থা হইবে; একদম শেষ সিটে বসিয়া আমাদেরও সেই অবস্থা হইয়াছিল !!!!
ভ্রমণের অরুণোদয় হইল একখানি টিকেটের কাগজের আভাসে। সবচেয়ে কম দামে ভ্রমণের উপায় খুজতেসিলাম।
একজন দালাল আসিয়া বলিলেন, “এইবার এই গাড়িতে উঠে পড়ো — একেকজন ৪০০ করিয়া টাকা দিয়া। ”
বাস স্টেশনে পৌছাইবার পূর্বের ভ্রমণটা বিশেষ সুখকর ছিল না। রিকশা করিয়া যাওয়ার পথে ঝুম বৃষ্টি নামিয়া সকলকে এক দফা গোসলের ব্যাবস্থা করিয়া দিয়াছিল। বাসে উঠিবার পূর্বে তাই সকলে যথাসম্ভব ভেজা কাপড় পরিবর্তন এবং হাত পা মাথা মুছিয়া উঠিয়া পড়িলাম গাড়িতে !!!!
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ বাস ছাড়িল। আজকাল সকল কিছুই মোবাইলেকরা যায়; খোমাখাতা খুলিয়া স্ট্যাটাস দিয়া বসিলাম; “আমি বাইর হইলাম; এইবার আমি ভ্রমণে বাইর হইলাম !!” দুষ্টু লোকেরা নানান মন্তব্য করিলো, কয়েকশত লাইক পড়িল , কিন্তু আমি তাহাতে গা করিলাম না ।
ঘড়ির কাটা টিক টিক করিতে লাগিল; আর সামনের সিটে জনৈক ভদ্রলোক কানে হেডফোন গুজিয়া হিন্দি সিরিয়াল দেখিয়া যাইতে লাগিলেন !!! আমার পাশে বসা বন্ধুটি আমাকে নিভৃতে অপরাধীর মতো সসংকোচে বলিলেন; “আমাদের দেশে এখন এই ধরণের পুরুষ মানুষ অনেক আছে। উহাকে কিছু গঞ্জনা দেওয়া উচিত হইবে কি?” ঠাট্টার সম্পর্কের বন্ধু বান্ধব একত্রে থাকলে যা হয় আর কি; শুরু হইল উহাকে গঞ্জনা করা। গঞ্জনার কিছু শব্দ বোধকরি হেডফোন ভেদ করিয়া উনার কানেও পৌছাইল। কিওদক্ষণ পরে ভদ্রলোক নোটপ্যাড অফ করিয়া ঘুমানোর প্রস্তুতি লইতে লাগিলেন। আমরাও সেই পথ অনুসরন করিলাম !!!
খানিক পর ঘুম ভাঙ্গিল জনতার হুড়োহুড়িতে।
বাস যমুনা সেতুর উপরে; সকলেরই উহা দেখা চাই। জানালার পাশে সিট হওয়ায় মাথা কাত করিয়া রাখিয়াই দেখিয়া ফেলিলাম যমুনা ব্রিজ। যদিও অন্ধকার ছাড়া কিছুই দেখা জাইবে না যানতাম; তাও পকেট হইতে মোবাইল বাহির করিয়া দুই চারটে ফটোও তুলিয়া ফেলিলাম !!!!
একদম ভোরে ভোরে নামিলাম কুষ্টিয়া শহরে। খানিক খাওয়া দাওয়া করিয়াই রওয়ানা দিলাম রবীন্দ্র কুঠিবাড়ির উদ্দেশ্যে। উহাতে যাইতেও বেশ হ্যাপা।
প্রথমে অটোরিক্সা করিয়া পৌছাইলাম বড়বাজার। সেইখান হইতে নদী পার হইয়া অপর পার হইতে আবার অটো ভ্রমণ। রাস্তার অবস্থাও তেমন সুবিধার নহে। ঠক্কর ঠক্কর করিতে করিতে ভাঙ্গা মাজা লইয়া পৌছাইয়া গেলাম কুঠিবাড়িতে।
প্রবেশ করিবার প্রাক্কালেই গেটে টিকেট কাউন্টার।
আমরা যারা এদেশি, তাদের জন্য প্রবেশমূল্য ১০/-, আর বিদেশি পর্যটকদের জন্য ১০০/-
ঢুকতেই যে ব্যাপারটি প্রথমেই চোখে পড়িল তাহা হইল প্রচুর সংখ্যক আম গাছ। একটা বেদিতে কবির “দুই বিঘা জমি” কবিতাটি লেখা। একটু এগুলেই ডানে মূল বাড়ি। মূল ভবনটি দোতলা। নিচতলার সোজা ঘরটিতে রয়েছে একটি টেবিল, যেটিতে বসে তিনি খাজনা আদায় করিতেন।
বামদিকের কক্ষটিতে রয়েছে দু'টি পালকি, একটি চেয়ার যেটি আবার অন্যে বহন করে নিয়ে যাওয়া যায়। দোতলায় তাঁর শোবার ঘর রয়েছে। সেখানে তাঁর ব্যবহৃত একটি খাট আছে। আর বারান্দায় একটা নৌকা মত আছে।
এই কুঠিবাড়িতে যে বিষয়টি লক্ষ্যণীয়, তা হল, এখানে প্রচুর সংখ্যক ছবি রয়েছে।
গান্ধীজি'র সাথে, আইনস্টাইনের সাথে, তার পুত্র-কন্যাদের সাথে, তার স্ত্রী মৃণালিনী দেবীর সাথে। এখানে কবির নিজের হাতে লিখিত একটি কবিতা, একটি বাংলা চিঠি, একটি ইংরেজী চিঠিও আছে। আর আছে কবির আঁকা কয়েকটি ছবি। এখানে কবির একটি প্রমাণ আকারের ছবিও আছে। তবে দুঃখের বিষয়; সবগুলোই প্রতিলিপি !!! কোনটারই আসল কপি চোখে পড়িল না !! শোবার ঘরের পাশেই একখানা বাথরুম আছে।
সেখানে আবার একটি ইংলিশ কমোড বসানো !!!
প্রায় ঘন্টা দুয়েক ঘুরিয়া ফিরিয়া অতঃপর রওয়ানা দিলাম লালন শাহের মাজারের উদ্দেশ্যে। বাহন – পুনরায় সেই অটোরিক্সা। মাজারের ভেতর অসাধারণ সুন্দর। ঢুকতেই মূল মাজার যেটি, সেটি একটি গম্বুজাকৃতি মসজিদের মত কক্ষে। এটিকে ঘিরিয়া ছোট একটি বাগান।
বাগানের উপর দিয়া একটু পায়েচলা পথ। এটি দিয়ে হাঁটিয়া ঢুকিতে হয় মাজারে। মাজারের বাইরে আরও সাতজন বাউলের কবর। মাজারের সামনেই যথারীতি এক বাউলমত লোক, সামনে একটি দানবাক্স।
আমরা সেখান থেকে এগিয়ে গেলাম আমাদের মূল লক্ষ্যের দিকে।
বাউলরা যেখানে গান করেন, সেই স্থানের দিকে। বাউলরা আসলে সর্বত্রই গান করেন। তাও, একটি চারদিক খোলা হলঘরের মত জায়গা আছে। তারা সবাই সেখানেই গান করেন। এরপাশেই একটি চারতলা ভবন।
এটিই মূল ভবন। এটিই লালন একাডেমি!! এখানে নিচতলায় অফিস। আর লালন জাদুঘর। জাদুঘরে প্রবেশ মূল্য মাত্র ২ টাকা !!! ভিতরে যে কি আছে তা সহজেই অনুমেয় !!! লালনের অনুসারিদের ব্যাবহার করা কয়েকটা থালা বাটি টাইপ জিনিস আর লালনের ঘরের দরজা ছাড়া দেখার মত তেমন কিছুই নাই !!!!
লালনের মাজার হইতে বাহির হইয়া রওয়ানা দিলাম স্টেশনের দিকে। সেইখানে এক হোটেলে ভরপেট ভাত মাংস খাইয়া অতঃপর রওয়ানা দিলাম ফরিদপুরের দিকে।
বাস ড্রাইভার বোধহয় নিয়মিত ইংলিশ মুভি দেখেন। ধারণা করিলাম উনার প্রিয় মুভি সিরিজ, “ফাস্ট এন্ড ফিউরিয়াস। “ বাসখানিকে মোটামুটি উরালপঙ্খী লেভেলে উন্নীত করিয়া উনি চালাইতে লাগিলেন !!!!
বিকেল নাগাদ ফরিদপুরে অভির বাসায় পৌছাইয়া গেলাম। খানিকক্ষণ বিশ্রাম লইয়া সন্ধ্যায় বাহির হইলাম পদ্মার উদ্দেশ্যে। আবারও সেই অটো; তবে এইবার ব্যাটারি চালিত; কুষ্টিয়ার অধিকাংশ অটোর মত শ্যালো ইঞ্জিন চালিত নহে।
পদ্মার পারে সে এক অপূর্ব দৃশ্য !!!! অইদিন বোধকরি পূর্ণিমা ছিল। মৃদু একটা বাতাস বইতেছিল। আমাদের ঠিক সামনেই পদ্মা কি এক অপূর্ব মায়াময়তায় আমাদের ডাকতেছিল। সময় নষ্ট না করিয়া বসিয়া পড়িলাম জ্যোৎস্নাস্নানে !!! বেশি সৌন্দর্য বোধকরি মানুষকে খানিকটা বদলে দেয় !!! পদ্মার পাড়ে বসিয়া আমাদের মধ্যে আড্ডার বিষয়গুলি ক্রমেই প্রবল আধ্যাত্মিক; অদ্ভুত এবং খানিকটা ভয়াবহ রুপ ধারন করিল। আজ সে কথা না হয় থাক !!
পরদিন সকালবেলা বাহির হইলাম পল্লীকবি জসীমউদ্দিনের বাড়ি দেখিতে।
বাড়িতে পৌঁছাইয়া খানিক হতাশই হইলাম। অযত্ন অবহেলার ছাপ স্পষ্ট। বাড়ির আশপাশ মোটামুটি পাব্লিক ডেটিং প্লেইস হিসেবে ব্যাবহার হইতেসে !!! বাড়ির সামনে রাস্তার অপর পাশে কয়েকটা বসার স্থান; সেইখানেও মানুষ গরু ছাগল – সকলের অবাধ বিচরন !!! সেইখানেই খানিক বসিয়া অতঃপর বাড়ি ফিরিয়া আসিলাম।
ভ্রমণের মোটামুটি শেষ পর্যায়ে। ঢাকা ফিরিয়া আসিতেছি।
ফরিদপুর হইতে ঢাকা আসিতে মাঝে নদী পার হইতে হয়। লঞ্চে করিয়া নদী পার হইলাম। ছোটবেলায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নানু বাড়ি যাওয়ার সময় লঞ্চে যাইতাম। এই লঞ্চ গুলি উহাদের মত আকার আকৃতি প্রকৃতিতে বড় না হইলেও বহু দিন পর আবার লঞ্চ ভ্রমণে নস্টালজিক হইয়া পড়িলাম।
অতঃপর সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকায় আসিয়া পৌছাইলাম।
সাথে করিয়া নিয়া আসিলাম মোবাইলে ১৪৯ খানা ছবি আর মনে কিছু না ভোলার স্মৃতি !!!
( ## গল্পের শুরুতে হৈমন্তীর আদল আনার চেষ্টা ছিল; এই ধৃষ্টতার জন্য কবিগুরুর কাছে শুরুতেই ক্ষমাপ্রার্থী। লেখার শুরুতে বিশাল প্ল্যান ছিল; পুরা লেখাটাই এই আদলে টেনে নেওয়ার চেষ্টা করব; কিন্তু মাঝ পথে খেই হারিয়ে ফেললাম; তবে আশা আছে কোন একদিন আবার সময় পাইলে কিছুটা পরিবর্তন পরিমার্জন করার !!
## লেখাটা অর্ধেক লিখে ফেলে রাখসিলাম একদিন। আমি যেই লেভেলের আলসে; তাতে আর হয়ত শেষ করা হত না; কোন এক বন্ধু ভালরকম খোঁচাখুঁচি করে লেখাটা শেষ করাল। যা কিছু হাবিজাবি লিখলাম তা-ই তাকে উৎসর্গ করলাম ) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।