জ্যোৎস্নার নদী পেরিয়ে
=============
রাকিবুল রকি
------------------
দুই ঘণ্টা পর সুযোগ পেলাম গাড়িসহ ফেরিতে ওঠার। অবশ্য এই দুই ঘণ্টা যে মন্দ কেটেছে, তা নয়। মাওয়া ফেরি ঘাটে আমরা যখন এসে পেঁৗছেছি তখন রাত এগারোটার ওপরে। শীতের সময় হিসেবে অনেক রাত; কিন্তু গন্তব্য সুন্দরবন হওয়ায় এসব কিছু মনে ধরছে না। ফেরিঘাটে এসে পথের দোকানের চোখ ঝলসানো আলো, ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ সত্যি উপাদেয় এবং ক্ষুধা উদ্রেককারী।
তাই খাওয়া-দাওয়া, দর্শনে দুই ঘণ্টা চোখের পলকে কেটে গেছে বলা যায়। তবে শীতের রাতে ভাত-মাছ খাবার কাহিনী শোনানোর জন্য এ গল্প লিখতে বসিনি, আমার হৃদয়ের গহিনে তুলে রাখা কিছু পবিত্র সুন্দর মুহূর্তকে পাঠকের সঙ্গে ভাগাভাগি করে নেওয়ার জন্যই এ গল্পের অবতারণা। যাই হোক, ফেরি ছাড়ার কিছুক্ষণ পর বলা যায় কিছুটা ধাতস্থ হয়ে দলে বলে ফেরির সামনে চলে এলাম। আকাশে ভরা চাঁদ, জ্যোৎস্না ঢেলে দিচ্ছে চরাচরে, নদীর বুকে জ্যোৎস্না প্রতিফলিত হওয়ার ফলে মনে হচ্ছিল জ্যোৎস্নার নদী পেরিয়ে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি কোনো এক বৈকুণ্ঠের দিকে। রবীন্দ্রনাথ থাকলে কী করতেন জানি না, আমরা সবাই মূক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম কিছুক্ষণ।
নদীর বুক থেকে উঠে আসা ঠাণ্ডা বাতাসের ধারালো বর্শা গরম কাপড়ের ফাঁকফোকর গলিয়ে শরীরে আঘাত হেনেও কাটাতে পারছে না চন্দ্রগ্রস্ত রাতের অপার্থিব নৈসর্গিক দৃশ্যের ঘোর। যে ঘোর মুখের ভাষা কেড়ে নেয়, চোখ জলে ভরিয়ে দেয়। বেশ কিছুক্ষণ এভাবে কেটে গেল। তারপর সবাই মিলে একসঙ্গে ছবি তুললাম, কথা বললাম, গান গাইলাম আর শীতের কারণে একজন একজন করে সবাই গাড়িতে গিয়ে বসল। শুধু দাঁড়িয়ে রইলাম আমি, আর যার কথা বলার জন্য এই গল্প_ সেই মিলিশা, মিলিশা ঘোষ।
মিলিশার দেহ বা মন কোনোটারই সৌন্দর্য বর্ণনা করার সাধ্য আমার নেই, আর এটা কোনো মুগ্ধ মজনুর অতিশয়েক্তি নয়। এর পাশাপাশি আরেকটি জিনিস স্বীকার করে নেওয়া ভালো, রাতের সৌন্দর্যের যে বর্ণনাটুকু দিলাম সেটাও মিলিশা বর্ণিত সৌন্দর্যেরই ভগ্নাংশ মাত্র। দেখা এবং অনুভব করার ক্ষমতা ছাড়া প্রকাশ করার কোনো গুণই আমার মধ্যে নেই।
মিলিশা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে, মুখে মায়াবি হাসি, সেই মুখে পড়েছে চাঁদের আলো, হাল্কা বাতাসে উড়ছে মাথার রেশম চুল_ মনে হচ্ছে জ্যোৎস্নার তৈরি প্রতিমা ও। সত্যি বলছি তখন আমার কাছে ওর তুলনায় প্রকৃতির সব সৌন্দর্য ম্লান হয়ে গিয়েছিল কিছুক্ষণের জন্য।
এক ফেরি জাহাজ জ্যোৎস্নার নদী কেটে এগিয়ে চলছে অনন্ত সুখের দেশে, তার সামনে দাঁড়িয়ে আছি আমি আর মিলিশা_ আমরা দু'জন শুধু। আর কেউ নেই_ কোথাও কেউ নেই, যেন আমরা আদম-হাওয়া। আদম-হাওয়া হলেতো ভালোই হতো, কোনো বাধা থাকত না আমাদের মধ্যে। এই কথাটা মনে পড়তেই একটা সূক্ষ্ম ব্যথা চিনচিন করে উঠল বুকের ভেতর। সামনেই অনার্স ফাইনাল_ তারপর নিশ্চয় ওর বাবা-মা মেয়েকে পাত্রস্থ করার জন্য উঠে পড়ে লাগবে।
তাদের কাছে নিশ্চয় এক স্বপ্নবাজ, ভবঘুরে ভিন্ন ধর্মের যুবকের মূল্য কানাকড়িও নয়।
আমি বললাম_ মিলিশা, আমার ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। এই আশ্চর্য সুন্দর রাত আমার জীবনে আর কখনও আসবে না। মিলিশা একটু হেসে বলল_ রকি, তুমি সবসময় ভুল চিন্তা করো। জীবনে কী পাব, কী পাব না তা ভেবে এই সুন্দর রাতটুকু নষ্ট করার কোনো মানে আছে বলো? বলে ও আমার মুখের দিকে একটু ঝুঁকে তাকাল।
আমি তাকালাম ওর চোখের দিকে। ও বলল, তুমি কি পড়োনি, মানুষ তারেই চায়, শীঘ্রই যারে ছেড়ে দিতে হয়। বোকা ছেলে, সুন্দর মুহূর্তগুলো ছোট বলেই সুন্দর। আমরা আমাদের সুন্দর অনুভূতিগুলো প্রাত্যহিকতার মলিনতায় নষ্ট করব কেন?
আমি বলতে চাইলাম_ কিন্তু...। ও আমাকে থামিয়ে দিয়ে বলল_ কষ্ট হবে জানি, এ কষ্ট কি আমার হবে না? তাছাড়া আমি যদি কিছু করি তাহলে মা_বাবাতো কষ্ট পাবেই, তারা আমাদের সমাজের কারও কাছে মুখ দেখাতে পারবে না।
বলো তা কি ঠিক হবে? আমি কিছু বললাম না। শীতল বাতাস আমার চোখে মুখে সুইয়ের ঘাই দিচ্ছে। মিলিশা বলল_ এই সুন্দর মুহূর্ত, এই জ্যোৎস্নারাত, নদী, শীতের মাদকতা রঙিন প্রজাপতি করে মনের কৌটায় তুলে রাখব, যখন ইচ্ছে হবে ছুঁয়ে দেখব, আদর করব। আমি মিলিশার মুখের দিকে তাকিয়ে রইলাম। তারপর বললাম_ আমি তা জেসাস নই মিলিশা, ক্রুশবিদ্ধ হয়ে আমি মহানুভবতা দেখাতে পারব না।
মিলিশা কিছু বলল না, একটু হেসে গাইতে শুরু করল_ আমি অকৃতী অধম বলে কম দাওনিতো কিছু...। আমি আমার কথার উত্তর পেয়ে গেলাম, তাছাড়া মনে হলো, এই গানই শুনতে আমার মন ব্যাকুল হয়ে ছিল। মিলিশা কীভাবে যেন আমার মনের কথা বুঝে ফেলে, গোপন থাকে না কিছুই। পৃথিবীর সব প্রেমিকের অবস্থা কি আমার মতোই? হবে হয়তো। মনের কথা না বুঝলে তাদের মনের মানুষ বলবে কেন? মিলিশা একের পর এক রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতে লাগলে_ আমার পরান যাহা চায়, হার মানা হার, আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়ে ছিলে।
আমি এক পার্থিব ঘোরের মাঝে চলে যেতে লাগলাম, এই জ্যোৎস্নাঙ্কিত শীতের রাত, হালকা কুয়াশা, নদী, নদীর বুকে ধু-ধু সাদা বালির বিস্তীর্ণ চর, কোথাও কোথাও গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুল আর মিলিশা। মনে হলো জীবনতো মন্দ নয়; এখন যদি মৃত্যুও আসে বলব, চল এগিয়ে যাই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।