আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

স্মৃতিময় ফাল্গুন দিন

সময়টা আশির দশকের গোড়ার দিকে। প্রজাপতির রঙ্গিন পাখায় উড়ার মতন চঞ্চলতার ছড়াছড়ি বয়স। ফাগুনের ফুরফুরে জীবন। বই মেলা আজকের মতন এমন জমজমাট ছিল না তখন। প্রাণের তাগিদ ছিল, পাঠ আগ্রহীদের পদচারণায় মুখর হতো বাংলা একাডেমী প্রঙ্গণ।

লেখক কবিদের সমাগমে সমৃদ্ধ অসম্ভব সুন্দর এক পরিবেশ ছিল। ভালোলাগা মেধাও মননের তাগিদে জড়ো হওয়া মানুষের সমন্বেয়ে ছিমছাম বইয়ের উৎসব ছিল। আজকের মতন ব্যাপক প্রচার প্রচরণা ছিল না তখন। আমার প্রথম বই মেলায় যাওয়ার অভিজ্ঞতা ছিল বিচিত্র। একজন কবির বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে ।

তিনিই প্রথম মোড়ক উন্মোচনের প্রথা চালু করেন বাংলা একাডেমীতে। প্রকাশিত হচ্ছে উনার তৃতীয় বই, সেখানে যাওয়ার জন্য অনুরোধ ছিল। কিছু বন্ধুসহ বিকালে সেই অনুষ্ঠানে গেলাম। ছোটখাট আয়োজন, বড় বড় কবিদের সমাগমে আন্তরিক অনুষ্ঠান। বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হলো, কবি মোহাম্মদ রফিক মোড়ক খুললেন বইয়ের, নাম, প্রকাশক, চিত্রকর, চিত্রশিল্পী, বইয়ের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, লেখকের পরিচয় বলার সাথে উৎসর্গ কাকে করা হয়েছে তা জানান হলো।

আর খুব অবাক বিষ্ময়ে দেখলাম বইটি আমাকে উৎসর্গ করা হয়েছে। আমি লজ্জিত হলাম। আসলে বয়সটা তখন একটা বাধা ছিল বিশেষ করে আমাদের সামাজিক প্রেক্ষিতে। তাই লজ্জিত হয়ে ছিলাম, বিষয়টাকে উপভোগ করার চেয়ে। উৎসর্গের কারণটি কবির পক্ষ থেকে যথাযথ ছিল।

আমাদের মাঝে বোঝাপড়ার সমস্বয় যথাযথ অনুধাবন করেই তিনি বইটি আমাকে উৎসর্গ করেছিলেন হয়ব বা। কিন্তু তখন দেখেছিলাম, কবির অনেক প্রিয়বান্ধবী মনঃক্ষুন্য হলেন। বইটির বিষয় যা সর্বজনীন তার চেয়ে অনেকে বইটির উৎসর্গ নিয়ে অনেক বেশী ব্যস্ত হয়ে পরেছিলেন, যা কবির একান্ত নিজেস্ব অনুভব,ভাললাগার ব্যাপার। প্রথম বই মেলায় যাওয়া, প্রথম মোড়ক উন্মেচান অনুষ্ঠান দেখা, প্রথম একটা বইয়ের উৎসর্গ পাওয়ার মতন অনেকগুলো প্রথমের সমন্বয়ের বিচিত্র অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে আমার বই মেলায় যাওয়ার শুরু । ঐতিহ্য আর কৃষ্টি জীবন যাপনের খাদ্যের প্রয়োজনের পাশাপাশি বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়ার মতন হৃদয়ানুভুতি, মনন চেতনার বিকাশ কখন কি ভাবে নিজের মধ্যে সঞ্চারিত হয়েছিল জানিনা।

তবে ভাবনার জগতে, বছরের কিছু সময় এলে উন্মনা, এক মাতাল, অস্তিরতা পেয়ে বসত। কয়েক বছরের মধ্যে বই মেলা হয়ে গেলে মেধা মননের এক অন্যতম আকর্ষণ। মিলন মেলা কতজনের সাথে পরিচয়, আড্ডা নতুন নতুন অভিজ্ঞতা, সুন্দর এক অনাবীল সময়ের অপেক্ষা বছর জুড়ে। এক সময় সেই বই মেলায় আমার একটি বই প্রচার হলো। কবিতার বই।

প্রথম ভালবাসা, প্রথম সন্তান যেন। তিলতিল করে এক একটি অক্ষর সাজিয়ে হৃদয়নুভুতি মেধা আর মনন চেতনার বিকাশ নিজের মধ্যে সঞ্চারিত আনন্দ বেদনা ভাললাগা ক্ষোভ, তারই বিকাশ লেখায় । অনেক আগ্রহ আর সংকোচ ভাললাগায় উদ্বেল, উন্মাদনা এক মাতাল অস্থিরতা নিজের লেখা ছাপার অক্ষরে, নিজের বই সে এক ভীষণ অন্যরকম অনুভুতি। গভীর গোপন ইচ্ছা যা অঙ্কুরিত ছিল অন্তরে তার বিকাশ শুরু হলো। যখন বড় বড় কবি লেখকের হাতে তুলে দিয়েছি আমার নিজেস্ব বই অদ্ভুত এক ভালোলাগায় ভরে উঠেছে মন।

মেলা শেষে দেখলাম ছাপানো বই প্রায় সব বিক্রি হয়ে গেছে। মেলায় এমন সারা মাস ব্যাপী উপচানো র্দশকের ভীড় ছিলনা, ছুটির দিনগুলো, বসন্ত শুরু, আর শেষ দশদিন অনেক জমজমাট থাকত। মেয়েরা স্টলে বসত না সেসময়। আমাদের প্রকাশনি নিয়ে আমরা প্রথম মেয়েরা স্টলে বসা শুরু করলাম মেলায়। আমাদের প্রকাশনির কয়েকটা বই ছিল প্রথম শুরু করার জন্য।

সে সময় অন্য প্রকাশনির বই বিত্রিু করা যেত। ”একাত্তুরের ঘাতক ও দালাল” এই নামে একটা বই অনেক বিক্রি করেছিলাম সে সময় যার কয়েকটা সংস্করণ হয়েছিল একমাসের মধ্যে। আর ছিল জাহানারা ইমামের "একাত্তরের দিনগুলি'' । ফাল্গুনের প্রথমদিন বিটিভির ক্যামেরা হলুদ শাড়ী পরে স্টলে বসা আমার বোন আর আমার ছবি তুলে নিয়ে গেলো । আমাদের টিভিতে দেখেছে তাই জানাতে অনেকে ফোন করল কিন্তু নিজেদের দেখতে পেলাম না আমাদের কেমন দেখাল।

টানা কয়েক বছর মেলায় স্টল করেছিলাম। জীবন স্রোতের বাঁকে বয়ে যেতে যেতে অনেক দূরে চলে গেলাম মেলা থেকে। তবে হৃদয়ের গভীরে প্রথিত শিকড় উপড়ে ফেলা যায় না। ডালপালা মেলতেই থাকে আপন মনে । কয়েক বছর পর আমার অনুপস্থিতেই প্রকাশিত হলো প্রথম বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ।

কুড়ি বছর পর প্রকাশিত হলো দ্বিতীয় বই, ছোটগল্পের, সে কথা পরে বলব আবার কোনদিন। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।