স্যার, ঘেটুপুত্র কমলার চৌধুরী হেকমত আলী জমিদারের চরিত্রে তারিক আনামকে নিলে কেমন হয়?
: আমার ছবিতে উনি অভিনয় করবেন না। তা ছাড়া আমার মনে হয়, অভিনয়টা উনি ভালো জানেন না।
: না স্যার, এই চরিত্রের জন্য তারিক আনামই মানানসই।
যখন ঘেটুপুত্র কমলা চলচ্চিত্রের শিল্পী নির্বাচন চলছে, তখন পরিচালক হুমায়ূন আহমেদ ও তাঁর সহকারী জুয়েল রানার মধ্যে এ রকমই কথোপকথন হয়েছিল।
২.
শুটিং চলছে ঘেটুপুত্র কমলার।
ক্যামেরার পেছনে দাঁড়ানো হুমায়ূন আহমেদ। তারিক আনাম কমলা চরিত্রের মামুনের উদ্দেশে সংলাপ দিচ্ছেন, ‘কাছে আসো...আরও কাছে...গরমে গায়ে এত কাপড় রাখছ ক্যান?’
জমিদারের লোভাতুর দৃষ্টি। কমলার শরীর থেকে কাপড় খুলছেন তিনি। তার ঘাড়ে হাত দিলেন...।
এরপর ভাবলেন, এই দৃশ্যের ব্যঞ্জনাকে আরেকটু গভীর করতে মামুনের চুলে হাত রাখবেন।
এর আগেই পরিচালক বললেন, কাট কাট। যথেষ্ট হয়েছে। এ দৃশ্য এর বেশি বাড়ালে দর্শক ছি ছি করবে।
৩.
হুমায়ূন আহমেদের প্রথম দিককার কয়েকটি নাটকে অভিনয় করেছিলেন তারিক আনাম। তারপর কোথাও কেউ নেই ধারাবাহিককে কেন্দ্র করে হুমায়ূনের সঙ্গে সৃষ্টি হয় অভিমান এবং দূরত্ব।
ঘেটুপুত্র কমলায় কাজের আগে রুবিকস কিউব নামে একটি নাটকে তাঁকে অভিনয় করান হুমায়ূন আহমেদ। তারিক আনামের কথায়, ‘নির্মাতার পক্ষ থেকে এটা ছিল আমার জন্য “টেস্ট কেস”। আমার অভিনয় হুমায়ূন ভাই আগে সেভাবে খেয়াল করেননি। এ জন্য পরে আমার কাছে দুঃখও করেছেন তিনি। তাই এ নাটকে ভালোভাবে আমার অভিনয় দেখার পর তিনি বললেন, “আরে, আপনি তো ভালো অভিনয় করেন!” এরপর ঘেটুপুত্র কমলার শুটিংয়ের সময় মজা করতে করতে বারবারই বলতেন, “আপনি এ ছবিতে অভিনয় করতে আসলেন ক্যান? ছবি মুক্তির পর সবাই তো আপনাকে ছি ছি করবে।
কেউ তো আপনার পাশে বসবেও না, হা হা হা...। ”’
৪.
গত সোমবার বনানীতে নিজের বাসায় আড্ডায় আমাদের এসব গল্প বলতে গিয়ে তারিক আনাম খান তখন স্মৃতির ঘোরে। গল্পের প্রথমটি তাঁর সঙ্গে সখ্যের পর হুমায়ূন আহমেদ নিজেই বলেছেন তাঁকে। এদিকে গল্পগুলো জানতে আমরাও তাঁকে উসকে চলেছি ক্রমাগত।
এর মধেই তারিক আনাম খানের কাছে কিছুটা বিব্রত আমরা—যানজটের কারণে তাঁর বাসায় পৌঁছানো যায়নি যথাসময়ে, দেরি প্রায় এক ঘণ্টা।
ভাবছি, তিনি তো যথেষ্ট বিরক্ত, গল্পে গল্পে যদি বিরক্তিভাব খানিকটা কাটে।
তারিক আনাম খানও পড়ে ফেলেছেন আমাদের মনের কথাটি। বললেন, ‘শোনো, ঢাকা শহরের যানজট এখন এমন হয়েছে, কাউকে সময় দিলে ধরেই নিই সময়টা এদিক-সেদিক হতে পারে। যানজটের অবস্থা দেখে এখন একটু কমই বিরক্ত হই। ’
পাঠক, ঘেটুপুত্র কমলায় নেতিবাচক চরিত্রে তারিক আনাম খানের অভিনয় দেখে কেউ ছি ছি করেছেন কি না, তা জানেন না তিনি।
কিন্তু বলেন, ‘আমার অভিনয় দেখে কেউ যদি ছি ছি করে, সেটাই তো আমার বড় প্রাপ্তি। ’
এ চলচ্চিত্রে তারিক আনাম খানের প্রাপ্তি আছে—এখানে অভিনয়ের জন্য ২০১২ সালের মেরিল-প্রথম আলো সমালোচক পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা হয়েছেন তিনি। বললেন, ‘পুরস্কার পেয়েছি, কিন্তু হুমায়ূন ভাই নেই। গত বছরের ১৯ জুলাই তিনি চলে গেছেন। দেখতে দেখতে তাঁর মৃত্যুর এক বছর হয়ে গেল।
তাঁকে খুব মনে পড়ছে। ’
তারিক আনামের বসার ঘরটি বেশ বড়। পুরোনো দিনের নকশায় বানানো আসবাবের মধ্যে বসে আছেন তিনি। পরনে লাল রঙের পাঞ্জাবি। আমাদের বিভ্রান্তি জাগে—কার সঙ্গে কথা বলছি, তারিক আনাম, না হেকমত আলী জমিদার?
একসময় অস্ত্র হাতে মুক্তিযুদ্ধ করেছেন।
ছিলেন ভারতের ন্যাশন্যাল স্কুল অব ড্রামার সেরা ছাত্র—থিয়েটার মিশে আছে অস্থিমজ্জায়। তা ছাড়া টিভিতেও খ্যাতিমান—বিটিভির বারো রকমের মানুষ ধারাবাহিকে তাঁর বিখ্যাত সংলাপ ‘থামলে ভালো লাগে’-এর কথা দর্শকের মনে পড়ে এখনো। এই সু-অভিনেতাকে হুমায়ূন আহমেদ যখন প্রথম বলেছিলেন সেই প্রথম গল্পটি—তাঁর অভিনয় ভালো না; তখন কেমন লেগেছিল তাঁর?
‘মনে হয়েছিল, ঠিকই আছে—আমার অভিনয় একজনের ভালো না-ই লাগতে পারে। অভিনেতা হিসেবে আমার দায়িত্ব হলো, আমি যে ভালো অভিনেতা, সেটা প্রমাণ করা। ’
তারিক আনাম খান যে বড় অভিনেতা এবং এ কথা যে নিছক বিনয় নয়, পরক্ষণেই তাঁর কথায় বোঝা গেল সেটি, ‘একজন অভিনয়শিল্পী আসলে টিভি বা চলচ্চিত্রের পর্দায় রহস্য তৈরি করেন—হুমায়ুন ফরীদি এটা খুব ভালো পারতেন।
কোন পরিস্থিতিতে অভিনয়শিল্পী কোন ধরনের অভিব্যক্তি করবেন, দর্শক যদি তা আগেভাগে বুঝে ফেলেন, তবে মজাটা থাকে না। অভিনয়শিল্পীকে তাই সব সময় নতুন হতে হয়। এর জন্য দরকার নিয়মিত চর্চা। ’
এরপর তারিক আনাম বলেছেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে আমাদের দেশে পুরুষ অভিনেতা সেভাবে তৈরি না হওয়ার কারণ, ‘অধিকাংশ তরুণ অভিনেতা চর্চার মধ্য দিয়ে নিজেকে গড়ে তুলছেন না, স্রোতে গা ভাসিয়ে চলছেন। যে কারও পক্ষেই এখন চট করে তারকা হওয়া মুশকিল।
কারণ, অনেক চ্যানেল, অসম প্রতিযোগিতা, মানসম্মত কাজের অভাব আর বিজ্ঞাপনের ফাঁকে ফাঁকে নাটক—এভাবে শেষাবধি কিছুই আর দেখা হয় না আমাদের। ’
এ-কথা ও-কথা পেরিয়ে বারবার আমরা দেখছি এক অভিনেতাকে—তারিক আনামের মুখ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।