আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তারিক টুকু'র শূণ্য দশক সম্পর্কীত কাব্য ভাবনার প্রতি প্রতিক্রিয়া



কবিতা কি? যদিও তা তর্কতিক্ত তবু আমরা কবিতাকে ভালবাসি অনেক বেশি। তা কি- না জেনেই। আরও মজার ব্যাপার কেউ যদি কোন একটাকে তার প্রিয় কবিতা বলে উল্লেখ করে, তখন কী ঘটে সাধারণত? সাধারণত সে তার সাথে সহমত হয় অথবা বলে এটা আসলে পুরানা ঘরানার। কিংবা বলে আপনি কবিতারুচিতে পিছিয়ে আছেন। আর সাধারণত কোন প্রিয় কবিতার কথা শুনে অন্যকে অন্তত এটা বলতে শোনা যায় না যে এটা কবিতা না।

তা হলে কি বস্তু নিহিত থাকে যে দুজনা সহমত হতে পারে এটা কবিতা, যদিও দুজনের কোন একজনের কাছে তা প্রিয় নয়? এভাবে প্রশ্নের পিঠে প্রশ্ন উত্থিত হয়, সমাধানও ঝাপসা হতে হতে সুদূরে মিলানোর পায়তারা করে কিন্তু তবু সে সমাধানের আভা বিলিয়ে অনন্ত মাতোয়ারা করে রাখে আমাদের তর্কে। কবিতার ব্যাপ্তিবোধ যত প্রসারিত ভাবে অবস্থান করে ততই ভালো লাগে এবং অধিকজন গৃহীত হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে বলে আমাদের মনে হয়, কিন্ত ব্যাপ্তিকে আমার কাছে মনে হয় সার্বিকীকরণের বা সাধারণীকরণের অন্য নাম। কিন্তু সাধারণী করণের মাত্রা যত বাড়বে ততোই তা বাস্তব বিচ্ছিন্ন হওয়ার সম্ভাবনাও ততো বেশি লালন করে বলে মনে হয় আমার। আবার সাধারণীকরণও একটি বিষয়ীগত ব্যাপার কি না তাও তো মাথায় রাখতে হয়। তা ছাড়া একটি সাধারণীকৃত পাঠবস্তু. এখানে কবিতা, আরো বেশি অস্পষ্টতায় ভোগে হয়তো।

কেননা পাঠক হয়তো তার পিছু আংশিক ভাবেই তাকায় বা পাঠক তার স্বভাবের ছাপ রেখেই চলে পাঠবস্তুটিকে ব্যাখ্যা করার পথে। তা হলে সার্বজনীনতাও আমরা যতটা কার্য়কর বা ভয়াবহ ভাবি, ততটা নয়। কোনকিছু যদি তার স্বীয় উপাদানের মাঝে সঙ্গতির অনুভব না আনে তা কি আমাদের কাছে বোধগম্য হয়? সভ্যতাকে চালাচ্ছে এমন একটা অনুভূতি যে, একটা পৃথিবী আমাদের আয়ত্বের বাইরে পড়ে আছে, এবং তা জীবনের জন্য অপরিহার্য হলেও জীবগুলোর চেতনায় একে নির্ভেজাল অনুকুল কখনোই মনে হয় না। এবং সে জন্য তাকে জীবনের অনুকুলে আনতে নিজেরমতো একে বুঝে নিতে চায় মানুষ। সে যতো ব্যার্থ হোক না কেন।

সে তা চালিয়ে যাবেই। আর এটা জীবনের মতোই সমাপ্তিহীন কিন্তু অনিবার্য এক অভিযান। আর তাই চারপাশ এবং আমাদের জীবনের অনুভূতি যতোই এলামেলো হোক আসলে নিজের সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক স্থাপনে শৃঙ্খলার অনুভূতি অজর্নই মানুষের বাসনার সার। এবং এটাই আমাদের মানবিক অর্জন। এলামেলো বিষয় আমাদের বোধে আসে না, কিন্তু আমরা একে সমাবেশ বিন্যাস ঘটিয়ে নিজেদের বস্তু সঙ্গতি অর্জনের চেষ্টায় শারীরিকভাবে বিষয়টির উপর সক্রিয়তার ছাপই রাখিনা কেবল, আমাদের মানসকে তৃপ্ত করার ভেতর দিয়ে এক অনুকূল পরিস্থিতি প্রাপ্তির অনুভূতিও আমরা ফের এর ভেতর দিয়ে অর্জন করি।

আর তা-ই বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে আমাদেরকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দেয় সক্রিয়তার ও সংগ্রামের; বাস্তবতার বিরুদ্ধে নয়, বাস্তবতার সাথে নিজেদের মানিয়ে নেয়ার তথা সহনীয়ভাবে বেড়ে উঠার। আমরা প্রতিটি মুহুর্তে যতোই স্বরিরোধি ভাবনা দ্বারা সক্রিয় থাকি না কেন আসলে যৌক্তিক বা ছদ্ম-যৌক্তিতভাবে হলেও বিষয়ের সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বিনিময় করি ও কোন একটি নির্দিষ্ট দিকে বা বিষয়ের সাথে জড়ানো বিষয়ীর দৃষ্টিভঙ্গির অনুকূলে তথ্য বা উপাদানকে সাজিয়ে তুলি বা তথা নব-শৃঙ্খলা আনার চেষ্টা চালাই। এই চেষ্টার ফলশ্রুতি যতদূর প্রসারিত ততদূর আমরা সুখি। এক নিরাপত্তা বোধ আমাদের মাঝে খেলা করে। ফলে এভাবে কিছু মহুর্ত এক দিকে আর কিছু মুহুর্ত বিপরীত দিকে, আমরা দুলতে থাকি।

এবং এর কম্পাঙ্ক অতিবেশি হলে বোধিসীমা অতিক্রম করে। ফলে আমরা আমাদের দোলাচলকে স্বীকার ও অস্বীকারের ভেতর দিয়ে কমিয়ে আনার চেষ্টা করি, যতোটা পারি। এটাও আমাদের মানবিক অর্জন। আলাদা করে বিশেষ জোড় দিয়ে অনির্দিষ্টিতার চর্চাও বোধের সীমা অতিক্রমী এবং অধিবিদ্যক চর্চা বলেই মনে হয়। ফলে এটাকে একটা সময়ের বৈশিষ্ট্য বলে জাহির করেও তা সমালোচকের নিজেরই আওতার বাইরে থেকে যায়।

মনে রাখা উচিত এখানেও পাঠকের চৃড়ান্ত স্বাধীনতা বলে কিছু হয় না। লেখকেরও না। ফলে একজন লেখকের লেখা যখন অনির্দিষ্টতাকে লেখার বিষয় করে তখনো তাকে যুক্তি চর্চার আশ্রয়ে নিয়েই বোধগম্য হয়ে উঠতে হয়। আমার মনে হয় মানব সভ্যতার ইতিহাস জগতকে বোধগম্য করার আত্মসঙগ্রাম। আর সেক্ষেত্রে বিশৃঙ্লা আছেই- এই বোধ আমরা লালন করি অর্থাৎ স্বীকার করি ।

এর সাপেক্ষে শৃঙ্খলা অর্জনের সিসিফাসীয় লড়াই আমরা কোনদিন এড়াতে পারবো না। তো অনির্দিষ্টতা মানবিক বোধের কাছে অনিবার্য বাস্তবতা, কিন্তু একে সহনীয় করার লড়াইই প্রাধান্য পাবে আমাদের কাছে। আমাদের শরীরে প্রতিটি সেকেন্ডের লক্ষ ভাগের একভাগে কয়েক লক্ষ তথ্য পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে প্রবেশ করছে, কিন্তু এদের সবগুলোই আমাদের সচেতন বা অবচেতন মনে সারা দিচ্ছে না, যদি দিতো আসলে আমরা অনুভূতিশূণ্য হয়ে পড়তাম এবং প্রচন্ড গতিশীলতা আমাদের গভীরতার বোধ কেড়ে নিতো এবং এই কবিতা বিষয়কে কেন্দ্র করে হয়তো এতো গুলো শব্দ সুশৃঙ্লভাবে ভাবতে ও লিখতে পারতাম না। আর সত্যি মানুষ অসহায় এখানেই যে, সব তথ্যের দিকে ইন্দ্রীয়গত সাড়া, একইসময়ে এবং ভিন্ন সময়েও, দিতে পারে না। আর বিশৃঙ্খল অনুভুতিমালা যেমন অণুভবগম্য হবে না তেমনি গভীরতা শুন্য ও চঞ্চল হয়ে উঠবে আর যাতে মানস সুস্থিরতা অর্জন করতে পারে না, দৌড়ক্লান্ত এবং বিশৃঙ্খল জগতাক্রান্ত মানুষের শ্বাস ফেলা সম্ভবও নয়।

ফলে ধাধাবাদীরা আমাদের এখনো পাঠ্যসূচির অর্ন্তভুক্ত নয়। কিন্তু এর মাঝে আপাত ব্যতিক্রমের ক্ষণ-স্বাদবহনকারী শক এফেক্ট রয়েছে যা নতুন পাঠককে চমকে দিতে পারে। কিন্তু সেখানে ফুসরত থাকে না অধিবাসের। আজকের দিনে যে সব লেখা হচ্ছে তাদের এই শকিং-ক্ষমতাও নেই, তা যতই নিজেদের অনিদির্ষ্টতা সমপন্ন বা বহৃরৈখিক বলে দাবী করুক না কেন। এই শকিং-শূন্যতাও তাদের স্বাতন্ত্র্য হতে পারে।

কিন্তু এটি খুবই সম্ভব তাদের নিজেদের অনুধ্যানকে বাজিয়ে তুলতে না পারারই এক ফল। আর যেহেতু তারা নতুন লিখছে নতুন সংবেদনের প্রতি স্পষ্ট ঝোঁক কাজ করছে আগামীতে হয়তো তারা সোনা ফলাবে। কিন্তু বলবোই যে, কবিতা তখন তাদের অনেক বেশি যুক্তিশীল, টোটালিলিটির ধারক, কবিতার দেহ, ভাষা, শব্দ এক নবীন সুশৃঙ্খলারার ধারক হবে এবং অনিদিষ্টির্তা, যুক্তিহীনতা আর স্বরিরোধ ও বহৃরৈখিকতা তাদের কবিতার আত্মা হিসেবে পাঠকের বোধে উঠে আসবে। মনে রাখতে হবে কবিতা কোন না কোনভাবে ফ্যালাসিকে লালন করে। ফলে তা জন্মগত ভাবে স্বরিরোধাক্রান্ত।

ভাষা সব সম্ভবের দেশ। আর তাই তখন অনির্দিষ্টতা, বহুরৈখিকতা ইত্যকার শব্দের ভুল বোঝাবোঝির অবসান হতে পারে কেবল ভাষায়। শুন্য দশক সেইভাবে বললে সত্যিই শুন্যের দশক, বক্তব্যশূন্য, বিষয়শূণ্য সঙবেদনশুন্য শব্দের স্তুপ। কিছু দিন পরেই পেছন দিকে তাকিয়ে তারা আজকের কবিতা নিয়ে তা-ই বলবে, আমি নিশ্চিত। দেখা যাবে, তারা অসচেতন ধাঁধাবাদের তরল সংস্করণ, আর এসবের ভেতর তারা নিজেদের মুখও আর খুঁজে পাচ্ছে না।

এটাও একটা প্রস্তাবনা হতে পারে। তো আপনি তারিক টুকু, আপনার বিবেচনা পুনর্ব্যাক্ত হোক, কী বলেন? আপনার ভাবনা অনুসারে আপনার সময়ের প্রতিনিত্ব করে এমন একটা তালিকা কবি ও কবিতা উৎস সহ উল্লেখ করুন না। আপনার জন্য স্ববিরোধী হবে হয়তো, তাই না? আরো একটা ব্যাপার আপনি নিজেও কবিতা লিখেন কিন্ত আপনার লেখার এডিটিং আপনি কি করে থাকেন কিংবা আপনার পড়ার পর নিজের বা অন্যের কবিতা এটা ভালো লাগলো বা ওটা ভালো লাগলো এমন বলেন কি? বললে তা বলার জন্য কি একেক মুর্হূতে একেকরকম ভাবনা কাজ করে? ফলে এখন যেটি আপনার ভাললাগে পর মুহুর্তে কি তা বদলে যায়, বদলানোর গতি কি আসলে আপনার এতই দ্রুত ও দৃঢ়? আর আপনি যে এই লেখাটি লিখলেন এটি কিসের চেষ্টা? কমপ্রিহেন্ড বা বোঝার চেষ্টা অর্থাৎ নিজের মাঝে অনেকগুলো কবিতাকে ঘিরে একধরনের সুশৃঙ্ল অনুভুতি অর্জনের লড়াই, তা স্বরিরোধী হলেও। আর আপনি নিজেই বলেছেন সঙ্গায়ন এটি, এবং তা এক ধরণের তারল্যে ভোগে। বুঝলেন, এই হলো নিয়তি, একে এড়াতে পারবেন না।

কবিতা অবচেতনের হোক আর সচেতনের কিছু অনুভব কিছু বক্তব্যকেন্দ্রিকতা বা থিম নির্ভরতা বা কেবলই আমাদের মানস অবস্থার অবাধ প্রবহন যাইহোক আমাদের উপস্থাপন করতে হবে যুক্তির হাত ধরে, যুক্তিবিরোধীতায়ও। অতএব পাগলামীর সুযোগ নাই। নতুন চেতনা মানে নতুন শব্দ-সম্পর্ক নির্মাণ। এটা অবশ্য সৃজনশীল ব্যক্তিমাত্রই অর্জন করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু বিশৃঙ্লা নয়, কিন্তু অনিদিষ্টিতা নয়।

বহু রৈখিকতা মানে শব্দের খেপামো নয়, বোধগম্যতাকে গ্রাহ্য করেই এটা কেবল সম্ভব হতে পারে। অন্যভাবে নয় বলেই আমার মনে হয়। বহুরৈখিকতা মানে একাধিক অর্থে বা ইঙ্গিতে কবিতাটি বোধের আয়ত্বে আসা। একই পাঠকে এটি ঘটতে পারে বা পাঠক ভেদেও। আবার এর অর্থ আংশিখভাবে অবশ্যই নয়, পাঠকের নিজের কাছে।

আবার একটি কবিতাকে ঘিরে এক পাঠকের অনুভব অন্যের কাছে আংশিকও মনে হতে পারে, সাধারত হয়ও। আবার একটি কবিতা বলতে আসলে আমরা কি বুঝি, এমনও হয় অনেকগুলো কবিতাকে একটি মনে হতে পারে। আবার একটি কবিতাকে কিন্তু অনেক কবিতা হিসেবে আমরা পড়ি না। এটা কুসংস্কারও হতে পারে। আর অনিদিষ্টতা যখন বিষয় তখন এর উদাহরণ যোগ্য কবিতার শরীরও আর আগের চেহারায় থাকবে না এটাই স্বাভাবিক।

কিন্তু কোনভাবে বিশৃঙ্খল শব্দ সম্পর্ক ও ধান ভানতে শীবের গীত নয়। তবে শীবের গীত যদি শীবের অলসতা কাটিয়ে দিয়ে ধান ভানায় জোয়ার আনে অসুবিধা কি? বড় কথা হলো এক ধরণের সঙ্গতি বোধকে এড়ানো মুশকিল। তা নতুন ধরণের হতে হবে এটাই সৃজন শীলতার এক পূর্বাপর বা অপূর্ব শর্ত। কী বলেন? ক্লীশে লাগার কথা বললেন তো, তা বোধ হয় শুন্যের দশকেই সবচেয়ে প্রবল। আর যুক্তি অতিক্রমী নতুন বিশ্ব, তা কি অধিবিদ্যক উচ্চারণ নয়? নতুন কবিতার নতুন পাঠক চাই।

চাই যুক্তি অতিক্রমী নয়, বরং যুক্তিকে সুসম্পূর্ণভাবে ধারণ করতে পারে তেমন এক নব বিন্যাসিত কবিতাশরীর। কী বলেন? আর যুক্তিশীলতাই কেবল বোধগম্য করতে পারে কোন কিছু. সে অনিদিষ্টতা জ্ঞাপক বা বহুরৈখিকতা জ্ঞাপক কিছু হোক। কী বলেন? তো জন্মান্ধতা বা দুর্ঘটনায় অন্ধ হওয়া অবশ্যই নিন্দনীয় নয়, দূরের বিশাল বস্তুকে চোখ ছোট দেখে বলে আকষ্মিক সিদ্ধান্তে চোখ বিসর্জন মনে হয় নিন্দনীয়, কী বলেন? আজ এ পর্যন্তই। অভিমতের আশায় সাঈদ জুবেরী।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.