ভাবনাটাই একটা যন্ত্রণা "দ্য গ্রান্ড ডিজাইন" – স্টিফেন হকিং আবল্মনে
১.
আমাদের প্রত্যেকের অস্তিত্বই খুবই কম সময়ের জন্য। আর এই ক্ষণিকের অস্তিত্বে এই মহাবিশ্বের খুব কম অংশই আমাদের পক্ষে দেখা সম্ভব। কিন্তু মানুষ খুবই কৌতুহলী প্রজাতি। সে জানতে চায়, উত্তর খোঁজে। এই কোমল-কঠোর পৃথিবীর বুকে জন্ম গ্রহন করে উপরের সুবিশাল মহাকাশ আর নক্ষত্রপুঞ্জ দেখে যুগে যুগে আমাদের মত মানুষ হাজারো প্রশ্ন করে গেছে: এই যে মহাবিশ্বে আমরা আছি একে বোঝার উপায় কী? এই মহাবিশ্বের আচরণ কেমন? বাস্তবতার প্রকৃতিই বা কেমন? সবকিছু কোথা থেকে এলো? মহাবিশ্বের সৃষ্টিতে কি কোনো সৃষ্টিকর্তার প্রয়োজন আছে? আমাদের বেশির ভাগই এসব প্রশ্ন নিয়ে সারাক্ষণ মাথা ঘামায় না, কিন্তু প্রায় প্রত্যেকেই কখনো না কখনো এসব প্রশ্ন নিয়ে চিন্তা করে।
সাধারণত এ প্রশ্নগুলো ছিলো দর্শনে এখতিয়ারে, কিন্তু দর্শনের মৃত্যু ঘটেছে। দর্শন ব্যর্থ হয়েছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের আধুনিক সব উন্নয়নের সাথে তাল রাখতে । এখন বিজ্ঞানীরাই সত্যের সন্ধানে আমাদের একমাত্র আলোকবর্তিকা। এই বইয়ের উদ্দেশ্য হচ্ছে সাম্প্রতিকতম আবিষ্কার এবং তাত্ত্বিক অগ্রগতির আলোকে এসব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া। এসব বৈজ্ঞানিক অগ্রগতি আমাদের মহাবিশ্বের এবং তাতে আমাদের অবস্থানের এক নতুন চিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছে যেটা গতানুগতিক চিত্র থেকে অনেকটাই আলাদা, এমনকি দুয়েক দশক আগের চিত্র থেকেও অনেক খানিই ভিন্ন।
অবশ্য, এই নতুন ধারণার খসড়ার ইতিহাস প্রায় এক শতাব্দী পুরানো।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে গতানুগতিক ধারণা অনুযায়ী যে কোনো বস্তু সুনির্ধারিত পথে পরিভ্রমন করে এবং তার একটা সুনির্দিষ্ট অতীত থাকে। নির্দিষ্ট সময়ে আমরা তার অবস্থান পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে নির্ধারণ করতে পারি। যদিও দৈনন্দিন অনেক কাজেই এই ধারণা দারুণ কার্যকর, কিন্তু ১৯২০ র দিকে দেখা যায় এই ‘ক্লাসিক্যাল’ ধারণা দিয়ে ভৌত জগতের পারমাণবিক ও অতিপারমাণবিক স্তরে যেসব আপাত উদভট ঘটনাসমূহ ঘটে সেসবের কোনো ব্যাখ্যা মেলে না। তাই এর বদলে তখন একটা ভিন্ন তাত্ত্বিক কাঠামোর আশ্রয় নিতে হয় যার নাম কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যা।
এসব অতিপারমানবিক ঘটনাগুলোর বর্ণনায় কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অনুমানগুলো খুবই নির্ভুল এবং এদেরকে যখন বৃহত্তর বস্তুসমূহের উপর প্রয়োগ করা হয় তখন ক্লাসিকাল তত্ত্বের অনুমানসমূহের সাথে মিলে যায়। কিন্তু কোয়ান্টাম এবং ক্লাসিকাল পদার্থবিদ্যা ভৌত বাস্তবতার সম্পূর্ণ ভিন্ন দুটি ধারণার উপর অবস্থিত।
কোয়ান্টাম তত্ত্বকে বিভিন্ন ভাবেই বর্ণনা করা যায়, তবে সবচেয়ে সহজাত(ইনটুইটিভ) বর্ণনাটা দিয়েছেন রিচার্ড (ডিক) ফাইনম্যান, ক্যালিফোর্নিয়া ইন্সটিটিউট অফ টেকনলজির একজন বর্ণিল চরিত্রের অধিকারী বিজ্ঞানী যিনি কখনো কখনো কাছেরই একটা স্ট্রিপ বারে বঙ্গো ড্রাম বাজাতেন। ফাইনম্যানের মতে, একটা সিস্টেম শুধু মাত্র একটাই ঘটনা-প্রবাহ নয় বরং সম্ভাব্য সকল ঘটনা-প্রবাহের সমষ্টি। আমাদের উত্তর খোঁজার পথে আমরা ফাইনম্যানের এই পদ্ধতিকে বিশদে ব্যাখ্যা করব এবং এর প্রয়োগ করে দেখবো যে মহাবিশ্বের কোনো একক ঘটনাপ্রবাহ (ইতিহাস) নেই এমনকি এর কোনো স্বাধীন অস্তিত্বই নেই।
এমনকি অনেক পদার্থবিজ্ঞানীর কাছেও এটা বৈপ্লবিক কোনো ধারণা মনে হতে পারে। আসলেই, আধুনিক বিজ্ঞানের অন্য অনেক ধারণার মত এটাও আমাদের সাধারণ জ্ঞানের সাথে মেলে না। কিন্তু সাধারণ জ্ঞান তো তৈরি হয় দৈনন্দিন অভিজ্ঞতার আলোকে, অত্যাধুনিক প্রযুক্তির সাহায্যে দেখা পারমানবিক জগৎ বা আদি মহাবিশ্বের চিত্রের উপর ভিত্তি করে নয়।
আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের উদভবের আগে সাধারণত ভাবা হত বিশ্বের সকল জ্ঞানই সরাসরি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে লাভ করা সম্ভব অর্থাৎ কোনো একটা বস্তুকে আমাদের ইন্দ্রিয় সমূহের মাধ্যমে আমরা যেভাবে অনুভব করি বস্তুগুলি তেমনই। কিন্তু আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের চমকপ্রদ সাফল্য- যেটা আমাদের দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা নয় বরং ফাইনম্যানের ধারণার মত ধারণার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত- থেকে দেখা যায় যে বাস্তবতা তেমন নয়।
তাই বাস্তবতার প্রচলিত সরল চিত্র আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানের সাথে সুসঙ্গত নয়। এ ধরণের বিভ্রান্তি মোকাবেলা করতে আমরা যে কৌশলের আশ্রয় নিই তাকে বলে কাঠামো নির্ভর বাস্তবতা। এই কৌশলটার পিছনে মূল ধারণা হচ্ছে আমাদের মস্তিষ্ক ইন্দ্রিয়সমূহ থেকে পাওয়া প্রেসনার সাপেক্ষে বাস্তব জগতের একটি কাল্পনিক কাঠামো তৈরি করে। যখন এমন একটা কাঠামো বিভিন্ন ঘটনাকে সফল ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে তখন আমরা এই কাঠামোকে এবং এই কাঠামোর সকল গাঠনিক ও ধারণাগত উপাদানকে বাস্তবতার বৈশিষ্ট বা পরম সত্য হিসাবে গ্রহন করি। কিন্তু এই একই ভৌত ঘটনাকে হয়তো অন্য কোনো ভাবেও কাঠামোবদ্ধ করা যায়, যেখানে ভিন্নতর মৌলিক উপাদান এবং ধারণা সমূহ ব্যবহৃত হবে।
এমন দুইটি ভিন্ন কাঠামো যখন কোনো ভৌত ঘটনাকে নিখুত ভাবে অনুমান করতে পারে তখন আর এদের একটিকে অপরটিচ চেয়ে বেশি বা কম বাস্তব হিসাবে চিহ্নিত করা যায় না; বরং তখন আমরা নিজের সুবিধামত যেকোনো একটি কাঠামোকে ব্যবহার করার স্বাধীনতা পেয়ে যাই।
বিজ্ঞানের ইতিহাসে আমরা একের পর এক উন্নততর তত্ত্ব এবং ধারণা-কাঠামো আবিষ্কার হতে দেখেছি, সেই প্লেটো থেকে শুরু করে নিউটন হয়ে আধুনিক কোয়ান্টাম তত্ত্ব। এই প্রশ্ন খুবই স্বাভাবিক যে, এই ধারা কি চলতেই থাকবে নাকি একটি পরম তত্ত্বে গিয়ে থামবে, যে পরম তত্ত্বের সাহায্যে মহাবিশ্বের সকল বল, সকল পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে? নাকি আমরা একের পর এক উন্নততর তত্ত্ব আবিষ্কার করে যেতেই থাকবো, অর্থাৎ এমন কোনো পরম তত্ত্বই আবিষ্কার করা সম্ভব হবে না যেটার আর উন্নয়ন সম্ভব নয়? এই প্রশ্নের সুনির্দিষ্ট উত্তর আমাদের হাতে এখনো নেই কিন্তু আমাদের হাতে এমন একটি তত্ত্ব আছে যেটি নিজেকে সকল কিছুর পরম তত্ত্ব হিসাবে দাবী করতে পারে; যার নাম এম-তত্ত্ব। এম-তত্ত্বই এখনো পর্যন্ত একমাত্র ধারণা-কাঠামো যার সেই সব বৈশিষ্টই আছে একটি পরম তত্ত্বের যে সব বৈশিষ্ট থাকার কথা। এবং আমাদের পরবর্তিক আলোচনার অনেক অংশই পরিচালিত হবে এই তত্ত্বের উপর ভিত্তি করে।
এম-তত্ত্বকে ঠিক একক কোনো তত্ত্ব বলা যায় না। এটা অনেকটা এক গুচ্ছ তত্ত্বের একটা সমষ্টি যার প্রতিটি সদস্য তত্ত্ব ভৌত ঘটনা সমুহের কোনো নির্দিষ্ট অংশকে বর্ণনা করে। এটা অনেকটা মানচিত্রের মত। এটা সবার জানা যে কোনো একক মানচিত্রে পুরো পৃথিবীর ভূ-তল কে দেখানো সম্ভব নয়। সমতল মানচিত্র তৈরিতে যে মারক্যাটর প্রিতিবিম্ব ব্যবহার করা হয় তাতে যতই উত্তর আর দক্ষিণ মেরুর দিকে যাওয়া হয় ততই ক্ষেত্রফলগুলো বিবর্ধিত করে আঁকা হতে থাকে এবং এ ধরণের মানচিত্রে কোনো ভাবেই উত্তর আর দক্ষিন মেরুবিন্দু দেখানো সম্ভব নয়।
তাই পুরো পৃথিবীর একটি নির্ভরযোগ্য প্রতিকৃতি তৈরি করতে হলে আমাদেরকে কোনো একক মানচিত্রের বদলে একগুচ্ছ ভিন্ন ভিন্ন মানচিত্র ব্যবহার করতে হবে যেখানে একেকটি মানচিত্র পৃথিবীর একেকটি অংশকে নির্ভুল ভাবে প্রকাশ করবে। ম্যাপগুলোর কিছু অংশ একে-অপরের উপর আপতিত হবে এবং এই আপতিত অংশও ঐ এলাকার ভূচিত্রকে নির্ভুল ভাবে বর্ণনা করবে। এম-তত্ত্ব অনেকটা এমন। এম-তত্ত্বের তত্ত্বগুচ্ছের বিভিন্ন সদস্য তত্ত্ব দেখতে অনেকসময় একে অপর থেকে ভিন্ন হলেও তাদেরকে আসলে একটি অন্তর্নিহিত একক তত্ত্বের বিভিন্ন অংশ হিসাবে দেখা যায়। এরা হচ্ছে মূল তত্ত্বের বিভিন্ন রূপ যার একেকটা একেক সীমায় প্রযোজ্য, যেমন- যখন কিছু চলকের মান, যেমন শক্তির পরিমান, খুবই কম তার জন্য আছ একটি তত্ত্ব।
এ যেন সেই মারকেটর প্রজেকশন থেকে পাওয়া পৃথিবীর মানচিত্রের বিভিন্ন অংশ, যে অংশে একাধিক মানচিত্র একে অপরের উপর আপতিত হবে সে অংশেও এই তত্ত্বসমূহের অনুমান পরস্পরের সাথে সুসংহত। আর পুরো ভূত্বকের যেমন কোনো ভালো সমতল প্রতিলিপি বা মানচিত্র নেই তেমনি তেমন কোনো একক তত্ত্ব নেই, যেটা একাই সকল অবস্থায় সব ধরণের পর্যবেক্ষণকে ব্যাখ্যা করতে পারে।
এম- তত্ত্ব কীভাবে সৃষ্টিবিষয়ক প্রশ্নসমূহের উত্তর দিতে পারে সেটা আমরা বর্ণনা করব। এই তত্ত্ব মতে আমাদের মহাবিশ্বই একমাত্র মহাবিশ্ব নয়। বরং, এম-তত্ত্ব বলছে একদম শূন্য থেকে বহু সংখ্যক মহাবিশ্বের সূচনা হয়েছে।
তাদের সৃষ্টিতে কোনো অতিপ্রাকৃত শক্তি বা ঈশ্বরের অংশগ্রহন প্রয়োজন নেই। বরং ভৌত সূত্রসমূহ থেকেই এই বহুসংখ্যক মহাবিশ্বের উদভব হয়। এদের উদভব বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই। প্রতিটি মহাবিশ্বের ঘটনা প্রবাহেরই বহুসংখ্যক ইতিহাস আছে এবং পরবর্তি কোনো নির্দিষ্ট সময়ে,(যেমন বর্তমান সময়টা হচ্ছে সৃষ্টির সূচনা থেকে শুরু করে অনেক পরের একটা সময়) এরা সম্ভাব্য অনেক অবস্থাতেই থাকতে পারে। এসব অবস্থার বেশিরভাগই আমরা যে মহাবিশ্বকে পর্যবেক্ষণ করি তার থেকে সম্পুর্ণ আলাদা এবং কোনো ধরণের ‘জীবন’-এর জন্য একদমই প্রতিকুল।
এদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকেই আমাদের মত প্রাণীর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব। তাই আমাদের অস্তিত্বই সম্ভাব্য আর সব মহাবিশ্ব থেকে শুধু মাত্র যেগুলোতে আমাদের অস্তিত্ব সম্ভব সেগুলোকেই নির্দিষ্ট করে দেয়। যদিও মহাজাগতিক স্কেলে আমরা অতিব ক্ষুদ্র এবং গুরুত্বহীন কিছু, তারপরও এই যে নির্দিষ্ট করে দেওয়ার ঘটনা, এটাই আমাদেরকে বসিয়ে দিয়েছে অনেকটা সৃষ্টির কর্তার আসনে।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে গভীরতম উপলব্ধি লাভের জন্য তাই আমাদেরকে শুধু সবকিছু ‘কীভাবে’ ঘটে জানলেই হবেনা, জানতে হবে ‘কেন’।
কেন কোনো কিছু না থাকার বদলে কিছু আছে?
কেন আমাদের অস্তিত্ব আছে?
কেন ভৌত সূত্র সমূহের ঠিক এই সেটটাই আমরা দেখছি, অন্যরকম নয় কেন?
২.
ভাইকিং পুরাণে আছে, স্কল এবং হাটি সূর্য এবং চন্দ্রকে তাড়া করে বেড়ায়।
এরা যখন কোনো একটাকে ধরে ফেলে তখনই সূর্য বা চন্দ্রগ্রহণ হয়। আর তখন পৃথিবীর মানুষ চন্দ্র-সূর্যকে উদ্ধার করার জন্য খুব জোরে হৈচৈ করতে থাকে যাতে নেকড়ে দুটো পালিয়ে যায়। অন্যান্য সংস্কৃতিতেও এধরণের পৌরাণিক কাহিনী রয়েছে। কিন্তু মানুষ নিশ্চই একসময় খেয়াল করতে শুরু করে যে তারা হৈচৈ করুক বা না করুক চন্দ্র বা সূর্য ঠিকই গ্রহণ কাটিয়ে ওঠে। এবং আরো পরে তারা নিশ্চই এটাও খেয়াল করে যে এসব গ্রহণ এলোমেলো ভাবেও ঘটে না।
বরং একটা নিয়মিত এবং পুনরাবৃত্ত ধারায় ঘটতে থাকে। চন্দ্রগ্রহণের জন্য এই ধারাটা পর্যবেক্ষণ করা বেশ সহজসাধ্য। প্রাচীন ব্যাবিলনিয়ানরা এসব পর্যবেক্ষণ থেকে চন্দ্রগ্রহণের প্রায় নিখুঁত ভবিষ্যতবাণী করতে সক্ষম হয়েছিলো। যদিও তাদের এটা জানা ছিলো না যে চন্দ্রগ্রহণ ঘটে পৃথিবী সূর্যের আলো আটকে ফেলার ফলে। সে তুলনায় সূর্যগ্রহণের সময়কাল গণনা করা ছিলো অনেক কঠিন।
কারণ এমনকি সূর্যগ্রহণ ঘটার সময়ও সেই গ্রহণ দেখা যায় পৃথিবীপৃষ্ঠের শুধু মাত্র ৩০ মাইল চওড়া কোনো একটা ফালি থেকে। তবু গ্রহণের এই ছন্দটা একবার বুঝে ফেললে এটা স্পষ্ট হয়ে যায়, যে গ্রহণ কোনো অতিপ্রাকৃত সত্তার খামখেয়ালির উপর নির্ভর করে না, বরং নির্দিষ্ট সূত্র মেনে চলে।
আদিতে আমাদের পূর্বপুরুষরা যদিও কিছু গ্রহ নক্ষত্রের গতি হিসাব করতে পেরেছিলো তারপরও প্রকৃতির বেশিরভাগ ঘটনাই ছিলো তাদের ব্যাখ্যাতীত। আগ্নেয়গিরি, ভূমিকম্প, ঝড়, মহামারি, মাংসের ভিতরে বেড়ে যাওয়া পায়ের নখ, এসবই মনে হতো যেন ঘটছে কোনো নিয়ম বা কারণ ছাড়াই। প্রাচীণকালে প্রকৃতির এসব বিধ্বংসী কর্মকান্ডকে কোনো রাগী ঈশ্বর বা ধ্বংসাত্বক দেব-দেবীর অপকান্ড বলে মনে করা হতো।
প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে দেখা হত দেবতাদের রাগিয়ে দেওয়ার প্রতিফল হিসাবে। উদাহরণ স্বরূপ, খৃষ্টপূর্ব ৫৬০০ বছর আগে ওরাগনের মাউন্ট মাজুমা আগ্নেওগিরিতে অগ্নুতপাত হয়, যার ফলে কয়েক বছর জ্বলন্ত কয়লা এবং আগ্নেয় শিলা বৃষ্টিপাতের মত ঝরে। এরপর বহু বছরের বৃষ্টিতে সেই জ্বালামুখ পানিপূর্ণ হয়ে ক্রেটার লেক গঠন করে। কালামাথ ইন্ডিয়ানদের পৌরাণিক কাহিনিতে এই ঘটনার যে বর্ণনা পাওয়া যায়, তার সাথে মূল ঘটনার সকল ভূতাত্বিক বর্ণনার মিল রয়েছে। সেই সঙ্গে বাড়তি নাটকিয়তা যোগ করতে তারা এই দুর্ভাগ্যের কারণ হিসাবে দায়ী করে একজন মানুষের কর্মফলকে।
আসলে মানব জাতির অপরাধবোধে ভোগার ক্ষমতাটাই এমন যে, যেকোনো কিছুতেই তারা শেষমেষ নিজের কোনো না কোনো দোষ খুঁজে নিতে পারে। কথিত আছে , ভূজগতের ঈশ্বর লাও কালামাথ সর্দারের সুন্দরী মানব কন্যার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলো। কিন্তু এই প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে প্রতিশোধ স্বরূপ লাও পুরো কালামাথকেই আগুন দিয়ে ধ্বংস করতে উদ্যত হয়। কিন্তু এও কথিত আছে, যে তখন উর্ধ্বজগতের ঈশ্বর স্কেল মানব জাতির উপর সদয় হয়ে তাদের রক্ষা করার জন্য লাও এর সাথে লড়াই করে। শেষ পর্যন্ত লাও আহত হয়ে মাউন্ট মাজামার মধ্যে পড়ে যায়, এর ফলেই সৃষ্টি হয় সেই জ্বালামুখের যেটা পরে ভরে গেছে পানিতে।
প্রকৃতির নিয়ম বিষয়ক অজ্ঞতাই সেই প্রাচীন কালের মানুষদের বিভিন্ন দেবতা উদ্ভাবন করতে উদ্যত করেছে, যারা মালিকের আসনে বশে ছড়ি ঘোরাতো মানব জীবনের সকল বিষয়াদিতে। তাদের ভালোবাসার এবং যুদ্ধের জন্য দেবতা ছিলো; ছিলো সূর্যের, পৃথিবীর এবং আকাশের জন্য; দেবতা ছিলো মহাসমূদ্রের এবং নদীর, বৃষ্টির এবং বজ্রের, এমনকি ভূমিকম্প আর আগ্নেয়গিরির জন্যও দেবতা বানিয়েছিলো তারা। দেবতারা যখন সন্তুষ্ট তখন মানবজাতিকে তারা দিত সুন্দর আবহাওয়া, শান্তি, এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও রোগবালাই থেকে মুক্তি। আর যখন তারা অসন্তুষ্ট, তখনই আসতো খরা, যুদ্ধ, মহামারী আর দুর্ভিক্ষ। যেহেতু প্রকৃতিতে বিদ্যমান ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঘটনা তাদের অজানা ছিলো তাই তাদের দেবতাদের মনে হতো অস্পষ্ট, দুর্বোধ্য, আর মানুষ ছিলো তাদের মর্জির শিকার।
কিন্তু ২৬০০ বছর আগে মিলেথাসের থালেসের (আনুমানিক, খৃপূ ৬২৪ – ca খৃপূ ) সময় থেকে এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটতে শুরু করে। তখন প্রথম এই ধারণার উদ্ভব হয়, যে প্রকৃতি কিছু সুসংহত নিয়মাবলি মেনে চলে যেগুলোর মর্মোদ্ধার করা সম্ভব। আর এখান থেকেই দেবদেবীদের রাজত্ব হটিয়ে দিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে পরিচালিত মহাবিশ্বের ধারণার যাত্রা শুরু হয়, একদিন যার নীলনকশা আমরা পড়ে ফেলতে শিখবো।
মানবেতিহাসের সময়রেখা ধরে হিসাব করলে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান একটি বেশ নবীন অভিক্ষা। আমাদের প্রজাতি, হোমো সেপিয়েন্স, এর উদ্ভব হয়েছিলো সাহারার দক্ষিণে আফ্রিকায় প্রায় দুলক্ষ বছর আগে।
সে তুলনায় লেখ্য ভাষার সৃষ্টি হয়েছে কৃষিনির্ভর সমাজে, মাত্র সাত হাজার বছর আগে। (প্রাচীনতম যেসব লিখিত দলিলের সন্ধান পাওয়া যায় তাদের কিছুর বিষয়বস্তু ছিলো প্রতি নাগরিককে কতখানি বিয়ারের ভাগ অনুমোদন করা হবে সে নিয়ে)। গ্রীক সভ্যতার যে প্রাচীনতম লিখিত দলিল পাওয়া যায় সেগুলো খৃষ্টপূর্ব নবম শতাব্দীর, কিন্তু এই সভ্যতার শিখর অর্থাৎ ‘ক্লাসিক্যাল যুগ’ এর সূচনা হয় ৫০০ খৃস্টপূর্বাবদের কিছু আগে দিয়ে। অ্যারিস্টটলের (খৃপূ৩৮৪-খৃপূ৩২২) ভাষ্য মতে এই সালের কাছাকাছি সময়ে থালেস কর্তৃক এই ধারণার সূত্রপাত হয়, যে আমাদের চারিপাশে ঘটতে থাকা জটিল ঘটনাবলিকে সরলতর নিয়মের আলোকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব, কোনো ধরণের পৌরাণিক বা ধর্মীয় ব্যাখ্যা ছাড়াই।
থালেসই খৃষ্টপূর্ব ৫৯৫ সালে সর্বপ্রথম সফল ভাবে সূর্যগ্রহনের সময় গণনা করে বের করতে সক্ষম হন।
যদিও ধারণা করা হয় তিনি যে সূক্ষ্ণতার সাথে অনুমানটি করতে পেরেছিলেন তাতে ভাগ্যের অনেক সহায়তা পেয়েছেন। তিনি ছিলেন একজন অন্তরালের মানুষ যিনি নিজের হাতে কোনো লেখা রেখে যান নি। আয়োনিয়া নামক যে অঞ্চলে তিনি থাকতেন সেখানে তার বাড়িটি ছিলো একটি অন্যতম জ্ঞানকেন্দ্র। গ্রীকরা আয়োনিয়াতে উপনিবেশ গঠন করার পরে থালেসের প্রভাব তূরষ্ক থেকে সুদূর ইটালি পর্যন্ত বিস্তৃত হয়। আয়োনীয় বিজ্ঞান- যার মূল অভিক্ষা ছিলো মৌলিক সূত্রাবলীর উন্মোচনের মাধ্যমে প্রাকৃতিক ঘটনাসমূহের ব্যাখ্যা করা- ছিলো মানুষের ধারণার জগতে অগ্রগতির ইতিহাসে এক বৈপ্লবিক মাইলফলক।
তাদের বিশ্লেষণ পদ্ধতি ছিলো যুক্তিনির্ভর এবং অনেক বিষয়েই তারা এমন সব উপসংহারে পৌছাতে পেরেছিলো যেগুলো আমাদের অত্যাধুনিক বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে পাওয়া ফলাফলের সমতুল। এটা ছিলো একটা বিশাল সূচনা। কিন্তু এরপর কয়েক শতাব্দীব্যাপি সময়ের প্রবাহে আয়োনীয় বিজ্ঞানের অনেক কিছুই হারিয়ে যায় এবং পরবর্তীতে একাধিকবার পুনরাবিষ্কৃত ও পুনরুদ্ভাবিত হয়।
কিংবদন্তি মতে, প্রথম যে গাণিতিক সূত্র প্রকৃতির একটা নিয়মকে সূত্রবদ্ধ করতে পেরেছিলো সেটা পিথাগোরাস (আনুমানিক. খৃপূ ৫৮০ – খৃপূ ৪৯০)নামক একজন আয়োনীয় আবিষ্কার করেন, সূত্রটি পিথাগোরাসের উপপাদ্য নামে পরিচিত। এ উপপাদ্য বলে: একটি সমকোনী ত্রিভূজের অতিভুজের বর্গ, সমকোণ সংলগ্ন বাহুদ্বয়ের বর্গের সমষ্টির সমান।
বলা হয়ে থাকে পিথাগোরাস বাদ্যযন্ত্রের টানা তারের দৈর্ঘ্য এবং যন্ত্রটি সে অনুযায়ী যে সুরসঙ্গতি সৃষ্টি করে তার মধ্যকার গাণিতিক সম্পর্ক নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। এখনকার ভাষায় বললে সম্পর্কটা হচ্ছে: একটি নির্দিষ্ট টানে টানা তারের কম্পাঙ্ক- প্রতি সেকেন্ডে তারটি কতবার কাঁপে-তারটির দৈর্ঘ্যের বিপরীত অনুপাতে পরিবর্তিত হয়। এখান থেকেই বলা যায় বেজ গিটারের তারের দৈর্ঘ্য কেন সাধারণ গিটারের চেয়ে বেশি হবে। হয়তো এই সম্পর্কটা পিথাগোরাস নিজে আবিষ্কার করেন নি- তার নামে যে উপপাদ্য, হয়তো সেটিও তার নিজের আবিষ্কার নয়- কিন্তু এই প্রমাণ পাওয়া যায় যে টানা তারের দৈর্ঘ্য আর তার কম্পাঙ্কের মধ্যকার সম্পর্ক তার সময়ে মানুষের জানা ছিলো। তাই যদি হয়ে থাকে তাহলে এই অতি সাধারণ গাণিতিক সূত্রকেই আমরা তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম নিদর্শন বলতে পারি।
পিথাগোরাসের এই তারের সূত্র ছাড়া আর যে কয়েকটি মাত্র ভৌতবিধি প্রাচীন কালে সঠিক ভাবে জানা ছিলো সেগুলোর আবিষ্কারক আর্কিমিডিস (আনুমানিক খৃপূ ২৮৭- খৃপূ ২১২), প্রাচীন যুগের উজ্জ্বলতম পদার্থবিজ্ঞানী। আধুনিক বিজ্ঞানের ভাষায়, লিভারের সূত্র আমাদের বলে, যে খুব ক্ষীণ বলও অনেক বড় ওজন তুলতে পারে কারণ লিভার তার স্থিরবিন্দুর থেকে বলপ্রয়োগ বিন্দু দ্বয়ের দূরত্বের অনুপাতে বলকে বিবর্ধিত করে দেয়। ভাসমান বস্তুর সূত্র আমাদের বলে, যে কোনো একটা ভাসমান বস্তু সেই পরিমান উর্ধমূখী বল অনুভব করবে যতটুকু ওজনের তরল সে অপসারণ করেছে। এবং প্রতিফলনের সূত্র বলে, যে আপতিত আলোর সাথে আয়না যে কোণ সৃষ্টি করে প্রতিফলিত আলোর সাথেও আয়নাটি একই কোণ সৃষ্টি করে। কিন্তু আর্কিমিডিস এগুলোকে সূত্র বা বিধি আখ্যা দেন নি।
এমনকি কোনো পর্যবেক্ষণ ও পরিমাপের সাপেক্ষেও সেগুলোকে ব্যাখ্যা করেন নি। বদলে তিনি এগুলোকে গাণিতিক স্বতসিদ্ধের মত করে ধরে নিয়েছেন, ঠিক যেভাবে ইউক্লিড তার জ্যামিতি সৃষ্টির জন্য স্বতসিদ্ধগুলো ধরে নিয়েছিলো।
এভাবে আয়োনীয় প্রভাব যখন বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে যেতে লাগলো তখন দেখা গেল অন্য অনেকেই খেয়াল করছে যে মহাবিশ্বের মধ্যে এক ধরণের অন্তর্নিহিত সুবিন্যস্ততা আছে, যেটাকে পর্যবেক্ষণ ও যুক্তির সাহায্যে অনুধাবন করা সম্ভব। আনাক্সিমান্ডার,(আনুমানিক. খৃপূ ৬১০- খৃপূ ৫৪০) যিনি ছিলেন থালেসের বন্ধু, এবং সম্ভবত ছাত্র, যুক্তি দেখান, যেহেতু মানব শিশু জন্মের পর একদম অসহায় অবস্থায় থাকে, তাই পৃথিবীর বুকে প্রথম মানুষ যদি শিশু অবস্থায় হাজির হতো তাহলে সে টিকতো না। এটা হয়তো মানবেতিহাসে বিবর্তনের ধারণার প্রাচীনতম চিহ্ন।
থালেসের যুক্তিতে মানুষ তাহলে নিশ্চই অন্য কোনো প্রাণী থেকে বিবর্তিত হয়েছে যাদের শিশুরা মানবশিশুর চেয়ে শক্তপোক্ত। সিসিলিতে, এম্পেডোক্লেস (আনুমানিক. খৃপূ ৪৯০- খৃপূ ৪৩০) ক্লেপ্সিড্রা নামক এক যন্ত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করেন। যন্ত্রটি দেখতে অনেকটা ডালের চামচের মত। এতে লাঠির মাথায় একটি গোলকের মত থাকে যে গোলকের উপরের অংশ ফাঁকা এবং নিচে একটি ছোট্টো ছিদ্র আছে। গোলকটিকে পানিতে ডুবালে ভিতরটি পানিপূর্ণ হয়ে যায় এর পরে উপরের ফাকা অংশটা আটকে ক্লেপ্সিড্রাটি তুলে ফেললেও নিচের ছিদ্র দিয়ে পানি পড়ে যায় না।
সে চিন্তা করে দেখেছিলো, যে অদৃশ্য কিছু নিশ্চই পানিকে নিচের ছিদ্রদিয়ে পড়ে যেতে বাধা দিচ্ছে- এভাবেই সে বায়ু নামক জড় পদার্থটি আবিষ্কার করে।
প্রায় একই সময়ে উত্তর গ্রীসের একটি আয়োনীয় কলোনিতে ডেমোক্রিটাস (আনুমানিক, খৃপূ ৪৬০ – খৃপূ ৩৭০)কোনো বস্তুকে বারবার ভাঙতে বা কাটতে থাকলে কী হবে সেটা নিয়ে চিন্তা করছিলেন। তার যুক্তি মতে যে কোনো বস্তুকে এভাবে অসীম সংখ্যক বার ভাগ করা যাবে না। বরং তিনি একটি স্বতসিদ্ধ প্রস্তাব করেছিলেন যে সবকিছু এমনকি সকল জীবিত সত্ত্বাও এমন কিছু মৌলিক কণিকার সমন্বয়ে গঠিত যাদেরকে আর ভাগ করা যাবে না। তিনি এই পরমতম কণিকার নাম দিয়েছিলেন ‘অ্যাটম’ বা ‘পরমাণু’ গ্রীক ভাষায় যার অর্থ ‘অকর্তনীয়’।
ডেমোক্রিটাস বিশ্বাস করতেন সকল ভৌত ঘটনা এসব পরমাণুর সংঘর্ষের ফলে ঘটে। এ মতবাদকে ‘পরমাণুবাদ’ আখ্যা দেওয়া হয়। এ মতবাদ অনুযায়ী, সকল অ্যাটম শূন্যে চলাফেরা করে এবং তাদেরকে যদি বাহ্যিকভাবে প্রভাবিত করা না হয় তাহলে তারা চিরকাল একই দিকে চলতেই থাকবে। আধুনিক কালে এই ধারণাকে আমরা বলি জড়তার সূত্র।
আমরা যে মহাবিশ্বের কেন্দ্রে বসবাসরত কোনো বিশেষ সত্ত্বা নই বরং মহাবিশ্বের অতি নগন্য একদল বাসিন্দা এই যুগান্তকারী ধারণাটিতে প্রথম পৌঁছান অ্যারিস্টার্কাস(আনুমানিক খৃপূ ৩১০ –খৃপূ ২৩০) যিনি ছিলেন অন্যতম শেষ আয়োনীয় বিজ্ঞানী।
তার করা শুধুমাত্র একটি গাণিতিক হিসাবই কালের প্রবাহে টিকে আছে, যেখানে তিনি জটিল জ্যামিতিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চন্দ্রগ্রহণের সময় চাঁদের উপর পৃথিবীর ছায়ার আকার নির্ণয় করতে পেরেছিলেন। তিনি তার প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে এই উপসংহারে পৌঁছান যে সূর্যের আকার নিশ্চই পৃথিবীর থেকে বহুগুণে বড়। আর যেহেতু ক্ষুদ্র বস্তুকেই বৃহৎ বস্তুর চারিদিকে আবর্তিত হতে হবে উলটোটা নয়,তাই তিনি প্রথম বলেন যে পৃথিবী সৌরজগতের কেন্দ্র নয় বরং এটা সহ অন্যান্য গ্রহ গুলোও সূর্যের চারিদিকে ঘুরছে। পৃথিবী যে স্রেফ মামুলি আরেকটা গ্রহ, এই উপলব্ধি থেকে শুরু করে পরে সূর্যও যে বিশেষ কিছু নয়, এই ধারণায় পৌঁছানো বরং বেশ ছোট একটা ধাপ। অ্যারিস্টার্কাসও এটাই সন্দেহ করেছিলেন এবং তিনি বিশ্বাস করতেন তারাগুলো দূরবর্তী সূর্য ছাড়া আর কিছুই নয়।
প্রাচীন গ্রীক দর্শনে অনেক রকম ধ্যান-ধারণাই প্রচলিত ছিলো, যাদের আবার কোনো-কোনোটার একে অপরের সাথে ছিলো প্রথাগত বিরোধ। আয়োনীয়রা ছিলো এদের মধ্যেই আরো একটি দল। দুর্ভাগ্যক্রমে, প্রকৃতির আয়নীয় ধারণা- যে প্রকৃতিকে কিছু সাধারণ সূত্রের সাহায্যে ব্যাখ্যা করা এবং এর কার্যকরণ অল্প কিছু মৌলিক নীতিতে নামিয়ে আনা সম্ভব- শক্তিশালী প্রভাব রাখতে পেরেছিলো মাত্র কয়েক শতাব্দী। এর একটা কারণ হচ্ছে আয়োনীয় তত্ত্বে স্বাধীন ইচ্ছা বা উদ্দেশ্যের কোনো স্থান ছিলো না, আর এই তত্ত্ব মতে বিশ্বের পরিচালনায় ঈশ্বরদের হস্তক্ষেপের কোনো অবকাশ নেই। এসব জিনিষের এই আকস্মিক অনুপস্থিতি তখনকার গ্রীক চিন্তাবিদদেরকে ততটাই গভীর ভাবে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিলো যতটা উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে এখনকার অনেক মানুষও।
যেমন, দার্শনিক এপিকুরাস (খৃপূ ৩৪১- খৃপূ ২৭০) পরমাণুবাদের ধারণাকে বর্জন করেছিলেন এই ভিত্তিতে যে “প্রাকৃতিক দার্শনিকদের ভাগ্যের ‘দাস’ হবার চেয়ে পৌরাণিক দেবদেবীকে অনুসরণ করা শ্রেয়। ” আরিস্টটলও পরমাণুর ধারণাকে পরিত্যাগ করেন, কারণ তার পক্ষে মানুষ যে পরমাণুর মত আত্মাহীন জড়বস্তুর দিয়ে গঠিত এটা মেনে নেওয়া সম্ভব ছিলো না। মহাবিশ্ব যে মানব কেন্দ্রিক নয় এই আয়োনীয় ধারণা ছিলো আমাদের মহাজাগতিক উপলব্ধির একটি মাইলফলক। কিন্তু এই ধারণাকে বাতিল গণ্য করার পরে সেভাবেই ছিলো প্রায় বারো শতাব্দী, গ্যালিলিওর আগ পর্যন্ত সর্বজনগ্রাহ্য হয়নি।
প্রকৃতি সম্পর্কে গ্রীকদের কিছু অনুমান যতই অন্তর্দৃষ্টি সম্পন্ন হোক না কেন, তাদের বেশিরভাগ ধারণাই এখনকার বিজ্ঞানের মানদন্ডে ধোপে টিকবে না।
এর একটা কারণ, গ্রীকরা বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির আবিষ্কারক নয়, তাদের তত্ত্বগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে যাচাই করার লক্ষ্যে গঠিত হতো না। তাই যদি একজন পণ্ডিত দাবি করতেন যে, একটা কণিকা সরল পথে চলতেই থাকবে যতক্ষণ না এর সাথে অন্য আরেকটি কণিকার সংঘর্ষ হচ্ছে, আর আরেক পণ্ডিত যদি দাবি করতেন একটি কণিকা সরল পথে চলতে থাকবে যতক্ষণ না সেটি একটি সাইক্লপ্স এর গায়ে গোত্তা খায়; তাদের এই বিবাদ মেটানোর কোনো ব্যবহারিক পদ্ধতি তাদের জানা ছিলো না। এবং তাদের ধারণায় মানব সৃষ্ট বিধি এবং ভৌতবিধির মধ্যে কোনো সুস্পষ্ট পার্থক্য ছিলো না। যেমন, খৃষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীতে আনাক্সিমান্ডার লিখেছেন যে সব কিছুরই সৃষ্টি হয় একটি প্রাথমিক সারবস্তু থেকে, এবং পরে তাতেই ফিরে যায়, যদি না “তারা তাদের অসমতার জন্য জরিমানা পরিশোধ করে”। এবং আয়োনীয় দার্শনিক হেরাক্লিটাসের (আনুমানিক খৃপূ ৫৩৫- খৃপূ ৪৭৬) মতে সূর্য তার নির্দিষ্ট আচরণ করে কারণ এর অন্যথা হলে বিচারের দেবী তাকে পাকড়াও করবে।
এর কয়েক শতাব্দী পরে খৃষ্টপূর্ব তৃতীয় শতকের দিকে স্টয়িক্স নামক একদল গ্রিক দার্শনিক মানব সৃষ্টবিধি আর প্রকৃতির ভৌতবিধির মধ্যে পার্থক্য করতে সক্ষম হন। কিন্তু তারা কিছু মানব আচরণবিধি, যেগুলোকে তারা স্বার্বিক জ্ঞান করত্, যেমন- ঈশ্বরের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা এবং পিতা-মাতার প্রতি আনুগত্যকে প্রাকৃতিক নিয়মের তালিকায় ফেলেছিলো। এমনকি তারা প্রায়ই ভৌত ঘটনাবলির বর্ণনায় আইনি পরিভাষা প্রয়োগ করতো এবং বিশ্বাস করত জড়বস্তুগুলো যাতে ভৌতবিধিগুলো ঠিকঠাক মত ‘মেনে চলে’ তার জন্য ভৌতবিধিগুলো এভাবে জোর দিয়ে বলার প্রয়োজন রয়েছে। মানুষকে ট্রাফিক আইন মানাতেই আমরা হিমসিম খেয়ে যাই, চিন্তা করুন তো গ্রহানূদেরও যদি আইন করে করে উপবৃত্তাকার পথে চলতে বাধ্য করতে হতো, তাহলে কী অবস্থাটা দাঁড়াতো।
এই মতবাদ গ্রিকদের উত্তরসুরী চিন্তাবিদদের মধ্যেও বহু শতাব্দী ধরে প্রচলিত ছিলো।
ত্রয়োদশ শতকে খৃষ্টান দার্শনিক থমাস আকুইনাস(আনুমানিক ১২২৫-১২৭৪) এই মতবাদ গ্রহন করেছিলেন এবং ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণে যুক্তি দেখিয়ে ছিলেন এই লিখে, “এটা সুস্পষ্ট যে জড়বস্তুমূহ তাদের গতিপথের শেষে পৌছায় দৈবক্রমে নয় বরং স্বেচ্ছায়… তাই নিশ্চই এমন কোনো ব্যক্তিসত্ত্বা আছে যিনি প্রকৃতির সবকিছুকে তার গতিপথের শেষে পৌঁছানোর আদেশ দিয়েছেন”। এমনকি এই ষোড়শ শতাব্দীর স্রেষ্ট জার্মান জ্যোতির্বিজ্ঞানী জোহানেস কেপলার (১৫৭১-১৬৩০) বিশ্বাস করতেন যে গ্রহগুলোর অনুভব করার মত চেতনা আছে এবং তারা সচেতন ভাবেই গতির সূত্রসমূহ মেনে চলে যেগুলো তাদের “মন” অনুধাবন করতে সক্ষম।
এই যে ধারণা, যে প্রকৃতির নিয়মগুলোও সচেতন ভাবে মেনে চলতে হয়, এ থেকে বোঝা যায় যে প্রাচীন চিন্তাবিদের প্রশ্ন ‘কীভাবে’ প্রকৃতি আচরণ করে এর চেয়ে, ‘কেন’ প্রকৃতি এমন আচরণ করে, এতে বেশি নিবদ্ধ ছিলো। অ্যারিস্টটল ছিলেন এই ধারণার একজন নেতৃস্থানীয় প্রবক্তা যিনি পর্যবেক্ষণনির্ভর বিজ্ঞানের ধারণাকে বাতিল গণ্য করেন। অবশ্য সূক্ষ্ণ পরিমাপ এবং গাণিতিক হিসাব নিকাশ সেই প্রাচীন কালে সহজসাধ্যও ছিলো না।
দশভিত্তিক যে সংখ্যাব্যবস্থা এখন আমরা হিসাবের কাজে বহুলভাবে ব্যবহার করি তার যাত্রা হয়েছিলো ৭০০ সালের দিকে হিন্দুদের হাত ধরে। যারা সংখ্যাতত্ত্বকে একটি শক্তিশালী হাতিয়ারে পরিণত করেছিলো। যোগ এবং বিয়োগ চিহ্নের ব্যবহার পঞ্চদশ শতকের আগে চালু হয়নি। এমনকি ষোড়শ শতকের আগে সমতার চিহ্ন এবং সেকেন্ড ব্যবধানে সময় মাপতে পারে এমন ঘড়িরও অস্তিত্ব ছিলো না।
আরিস্টটল পরিমাপ ও হিসাবের এই বাধাকে, পরিমানগত অনুমান করতে পারে, তেমন পদার্থবিজ্ঞানের উন্নয়নে কোনো বাধা মনে করেন নি।
বরং, তিনি মনে করতেন এসব হিসাব নিকাশের কোনো দরকারই নেই। এর বদলে আরিস্টটল তার পদার্থবিজ্ঞানকে দাঁড়া করিয়েছিলেন সেইসব নীতির উপর ভিত্তি করে যেগুলো তার কাছে বৌদ্ধিক আবেদন সৃষ্টি করতে পারতো। তিনি সেসব তথ্য আবেদনহীন মনে করতেন সেগুলো চেপে যেতেন এবং নিজের প্রচেষ্টাকে পুরোপুরি নিবদ্ধ করেছিলেন ‘কেন’ কোনোকিছু ঘটে এ প্রশ্নের প্রতি, ‘কীভাবে’ কিছু একটা ঘটে তার পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণে তিনি খুব কম শক্তিই ব্যয় করেছেন। অবশ্য যখন নিজের গণনার ফলাফল এতটাই বাস্তবতাবিবর্জিত হত, যে সেগুলো না পালটে আর উপায় থাকতো না, তখন তিনি হিসাবে কিছু পরিবর্তণ আনতেন। কিন্তু এইসব পরিবর্তন ছিলো অনেকটা জোড়াতালি দেওয়ার মত আপাতত ভুলচুক ঢেকে ফেলা ছাড়া যার আর কোনো দাম নেই।
এভাবে তার তত্ত্বের সাথে বাস্তবতার যত অমিলই থাকুক না কেন তিনি ঠিকই টুকটাক পরিবর্তন করে এসব সংঘাত মিটিয়ে নিতেন। যেমন তার তত্ত্বে তিনি বলেছিলেন ভারী বস্তু তার নিজের ওজন অনুযায়ী স্থির গতিতে নিচে পতিত হয়। কিন্তু এটা স্পষ্ট দেখা যায় যে কোনো বস্তু যত পড়তে থাকে ততই তার গতি বাড়তে থাকে, তখন তিনি নতুন এক নীতি হাজির করেন, যে বস্তুসমূহ যতই তার নিজের লক্ষ্যের কাছে পৌছে যায় ততই সে খুশি হয়ে ওঠে এবং আরো জোরে লক্ষ্যের দিকে ছুটতে থাকে, এ নীতির সাহায্যে এক ধরণের মানুষের আচরণকে বর্ণনা করা গেলেও জড় বস্তুর আচরণ ব্যাখ্যায় এটা একদম অচল। যদিও অ্যারিস্টটলের তত্ত্বসমূহের তেমন কোনো অনুমান ক্ষমতা ছিলো না তারপরও তার চিন্তাপদ্ধতির প্রভাব পশ্চিমা চিন্তাবিদদের মধ্যে প্রায় দুই হাজার বছর আধিপত্য বিস্তার করেছে।
গ্রিকদের খৃষ্টান উত্তরসুরীরা, মহাবিশ্ব যে চেতনাহীন প্রাকৃতিক নিয়ম দ্বারা পরিচালিত হ্য়, এই ধারণাকে বর্জন করেছিলো।
তারা এই ধারণাকেও বর্জন করে যে মহাবিশ্ব মানুষের কোনো বিশেষ আসন নেই। এবং যদিও মধ্যযুগের দার্শনিক ধারণাগুলোতে কোনো সামঞ্জস্য ছিলো না, তবে তাদের সবার একটা মূলভাব ছিলো, যে মহাবিশ্ব হচ্ছে ঈশ্বরের খেলাঘর, এবং প্রাকৃতিক ঘটনা নিয়ে গবেষণা করার চেয়ে ধর্মচর্চা করা বহুগুণে শ্রেয়। এমনকি ১২৭৭ সালে প্যারিসের বিশপ ট্যাম্পিয়ার পোপ জন XXI এর পক্ষ থেকে ২১৯ টি ভুলের বা নাফরমানির একটি তালিকা প্রকাশ করেন যেগুলোকে শাস্তিযোগ্য ঘোষণা করা হয়। এসব নাফরমানির মধ্যে একটা ছিলো, এটা বিশ্বাস করা যে প্রকৃতি শুধু প্রাকৃতিক নিয়ম মেনে চলে, কারণ এ ধারণা সর্বময়ক্ষতার অধিকারী ঈশ্বরের সঙ্গে সংঘাতপূর্ণ। মজার ব্যাপার হলো, এর কয়েক মাস পরে পোপ জন নিহত হন মধ্যাকর্ষণ সূত্রের প্রভাবেই, যখন তার প্রাসাদের ছাদ ভেঙ্গে পড়ে তার উপর।
প্রাকৃতিক নিয়মগুলো সম্পর্কে আধুনিক ধারণার সূত্রপাত হয় সপ্তদশ শতকের দিকে। কেপলারই মনে হয় প্রথম ব্যক্তি যিনি আধুনিক বৈজ্ঞানিক ধারণার আলোকে এই নিয়মগুলো বুঝতে সক্ষম হন, যদিও আমরা আগেই বলেছি যে তিনি জড়বস্তুকে একধরণের সত্ত্বাজ্ঞান করতেন। গ্যালিলিও(১৫৬৪-১৬৪২) তার বেশিরভাগ বৈজ্ঞানিক লেখনিতেই ‘নিয়ম’ বা ‘বিধি’ শব্দটি ব্যবহার করেননি (যদিও তার লেখার অনুবাদে এই শব্দটি পাওয়া যায়)। শব্দটি তিনি ব্যবহার করুন বা না করুন তিনি প্রচুর প্রাকৃতিক নিয়ম আবিষ্কার করতে সক্ষম হন, এবং এই ধারণার প্রসার ঘটান, যে পর্যবেক্ষণই হচ্ছে বিজ্ঞানের ভিত্তি আর বিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন ভৌত ঘটনাবলির মধ্যক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।