অন্যান্য অঞ্চল থেকে সূযোগ সন্ধানীদের ক্রমঃ আগমন,জনসংখ্যা স্ফীতি,সম্পদ ও সুযোগ বন্টনে বৈষম্য এবং সভ্যতার তারতম্যে প্রতিটি এলাকার মূল আদিবাসীদের অস্তিত্ব যেমন বিপন্ন হতে চলেছে তেমনি বিলুপ্ত হতে চলেছে প্রাচীন কৃষ্ঠি ও সংস্কৃতি,সৃষ্ঠ হচ্ছে তার নব্য সংস্করন আর ইতিহাস। খোদ রাজধানী ঢাকায় নাকি মূল ঢাকার বাসিন্দা খুঁজে পাওয়া দুস্কর। বর্তমানে পার্বত্যাঞ্চলে প্রতিটি এলাকার মূল আদিবাসীদের অস্তিত্ব ঐতিহ্য ও ইতিহাস সেই রাজধানী ঢাকার মতোই বরাবর।
খুমী আদিবাসীদের অস্তিত্ব আজ আলিকদমে নেই,হারিয়ে গেছে সেই ঐতিহাসিক ডাইনোসরদের মতোই,অথচ একদা এই এলাকাটি ছিল খুমী অধ্যুষিত অঞ্চল। ২৯২ নং চাইম্প্রা মৌজার হেডম্যান ছিলেন প্রয়াত থোয়াই খুমী।
খুমী আদিবাসীদের মতো আলিকদমে তঞ্চঙ্গ্যা আদিবাসীদের অস্তিত্ব আজ বিপন্নতার পর্যায়ে রয়েছে। বদলে গেছে স্থান,কাল, পাত্র, নাম সর্বস্ব।
আলিকদম (আলেহ ক্যডং)ঃ-
আলিকদমের আদি নাম আলেহ ক্যডং। আলেহ অর্থ মধ্যম,ক্য অর্থ পাথর,ডোয়াং অর্থ গুহা,আলেহ ক্যডং অর্থ মধ্যম পাথরের গুহা। উল্লেখ্য যে,আলিকদমে তিনটি গুহা রয়েছে,মেরিনচড়, তারাবনিয়া এবং হরিণঝিরি।
এই হরিণঝিরি সুড়ঙ্গটি আলেহ সুড়ঙ্গ বা মধ্যম সুড়ঙ্গ। এই আলেহ ক্যডং নামের সাথে মেরাইংডং,কেউক্রাডং,তাজিংডং ইত্যাদি নামের সাদৃশ্য বিদ্যমান। কিন্তু সংখ্যা গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অপ-প্রচার হচ্ছে হযরত আলীর কদম পড়েছে বলেই এলাকার নামকরন আলিকদম। হযরত আলীর ঐতিহাসিক ভিক্তি বা হদিস মিলছে না বলেই তা সংশোধন করে প্রচার করা হচ্ছে হযরত আলী নয়,আলী ফকিরই এলাকায় প্রথম আগমন করেছিলেন বলেই এলাকার নামকরন আলিকদম।
মাতামুহুরী (মুরীখ্যং বা মুরীগাং)ঃ-
মাতামুহুরীর আদিনাম মুরীগাং বা মুরীখ্যং।
মাতামুহুরীর অর্থ কি তা জানা যায়নি। কিন্তু মুরীখ্যং-আরাকানী ভাষা বিশেষ। মু-অর্থ ঝড়,রী-অর্থ পানি,গাং বা খ্যং অর্থ নদী। সুতরাং মুরীগাং বা মুরীখ্যং অর্থ ঝড়ের পানিতে যে নদী।
মিড়িঞ্জা(মেরাইংডং)ঃ-
মেরাইংডং পাহাড়ের নতুন নাম মিড়িঞ্জা।
সম্প্রতি স্থাপিত হয়েছে মিড়িঞ্জা পর্যটন কমপ্লেক্স। মিড়িঞ্জার আভিধানিক অর্থ কি জানা যায়নি। কিন্তু মেরাইংডং এর অর্থ লোক কথা ও লোক মুখে প্রচলিত আছে। একদা এক মুরুং পরিবার মগ বা মার্মা শিশুকে লালন পালন করে। সেই শিশু বড় হলে তাকে এবং তার পরিবার পরিজনকে মেরাইংচা বলা হয়।
এই মেরাইংচা বংশধররা যে পাহাড়ে বসবাস করতো সেই পাহাড়ের নামকরন করা হয় মেরাইংডং।
ফতেহ ঝিরি(পাথঝিরি)ঃ-
আলিকদম উপজেলার অনতি দূরে পাথ মুরুং নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তির নামেই ঝিড়ির নামকরন করা হয় পাথঝিরি। কিন্তু সম্প্রতি এই পাথঝিড়ির নাম লেখা হচ্ছে ফতেহঝিড়ি। এই ফতেহ চট্টগ্রামের সেই ফতেহাবাদের অপসংস্কৃতির আগ্রাসন।
তৈনগাং একটি নির্ঝরিনীর নাম।
এটি মুরীখ্যং বা মাতামুহুরী নদীতে পতিত একটি উপ-নদী বা খাল এবং বান্দরবান পার্বত্য জেলার অর্ন্তগত আলিকদম উপজেলায় অসংখ্য ঝর্ণা বা নির্ঝরের ভীড়ে অতি পরিচিত একটি উপনদী বা খালের নাম এই তৈনগাং। অতীতে এর নাম ছিল তৈনছড়ি। এটি ছড়া বা ঝর্না নয় এবং গাং বা খাল হওয়াতে “তৈনগাং” হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। রাজা তৈন সুরেশ্বরীর নামানুসারে তৈনছড়ী নামকরন করা হয়। মায়ানমার সীমান্ত অদ্রি হতে উৎপন্ন হয়ে অজস্র গিরি উপত্যকা ভেদ করে শত প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়ে উরগের ন্যায় এঁকে বেঁকে প্রবাহিত হয়ে মুরীখ্যং বা মাতামুহুরী নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।
দৈর্ঘ্য প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এই তৈনগাং কে কেন্দ্র করে সেকালে সূচীত হয়েছিল আদিম জীবনযাত্রা,সভ্যতার পদযাত্রা। অনেকের মতে তন্যা গছা এবং তৈনচংগ্যা নামের উৎপত্তি এই তৈনগাং থেকে। রাজা তৈন সুরেশ্বরীর নেতৃত্বে যে সকল প্রজা এই তৈনগাং অববাহিকায় জুম চাষ করতো তাদেরকে তৈনতংগ্যা বলা হতো। তৈন অর্থ রাজা তৈন সুরেশ্বরী,তং অর্থ পাহাড়,য়া বা গ্যা অর্থ প্রজা বা বাসিন্দা।
তৈনতংগ্যা অর্থ রাজা তৈনসুরেশ্বরীর পাহাড়ী বাসিন্দা। তৈনগাং এর মোহনায় রাজা তৈনসুরেশ্বরী প্রাসাদ নির্মান ও দীঘি খনন করেন। এই রাজা তৈন সুরেশ্বরীকে ঘিরে তৎকালে যে সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার প্রতœতাত্তিক হদিস আজো পাওয়া যায়। আলীকদম প্রেস কাবের কতিপয় সাংবাদিক এক অনুসন্ধান চালিয়ে নয়া পাড়া থেকে “প্রাচীন ইট” সংগ্রহ করে আলীকদম প্রেস কাবে সংরক্ষন করে রেখেছেন। তৈনখালের মোহনার বাঁকে হরিণ ঝিড়ি সুড়ঙ্গ গুলো(যা আলী সুড়ঙ্গ হিসেবে পরিচিত)সেকালে আদিম মানুষের জীবন যাত্রার কীর্তি সাক্ষ্য বহন করে।
এই সুড়ঙ্গকে কেন্দ্র করে প্রচলিত রয়েছে নানা কিংবদন্তী লোককথা।
তৈনগাং থেকে তন্যাগছা,তঞ্চঙ্গ্যা নামের উৎপত্তি এবং চাকমা ও তঞ্চঙ্গ্যার বিভক্তি সৃষ্টি হয় বলে অনেকের ধারনা। পরবর্তীতে রাজা তৈন সুরেশ্বরীর মৃত্যুর পর তার জামাতা সেনাপতি সাতুয়া বড়–য়া ওরফে পাগলারাজা রাজত্ব এবং তার মৃত্যু হলে এই তৈনগাং অঞ্চলের আদিবাসীরা সমগ্র পার্বত্যাঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। (তথ্য সূত্র বিরাজ মোহন দেওয়ানের “চাকমা জাতীর ইতিবৃক্ত”)।
আলীকদম একদা দূর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় প্রকৃতি ও হিংস্র প্রাণীর সাথে বৈরীতার মাঝে সেকালে আদিম মানুষ বা আদিবাসীরা।
জীবিকা নির্বাহে জুম চাষই ছিল সেকালে আদিবাসীদের প্রধান অবলম্বন। সেই বেশী দিন পুরানো তথা নয়। এখানে তঞ্চঙ্গ্যা আদিবাসীদের কথায় প্রাধান্য দেয়া হলো। ক্যাডেষ্ট্রল সার্ভে চলছে। রাংগামাটি থেকে কতিপয় চাকমা বাবু কানুনগো সার্ভেয়ার আলিকদমে আসে সার্ভের জন্য।
তারা তঞ্চঙ্গ্যা আদিবাসীদেরকে জমি বন্ধোবস্তি নেয়ার জন্য পরামর্শ দেয়। তখন নাকি ১টাকা ৬আনা দিলে কয়েক যোজন ব্যাপী জমি বন্ধোবস্তি নেয়া যেত কানুনগো সাহেবের কাটা কম্পাসের মাধ্যমে। তখনকার তঞ্চঙ্গ্যা বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা প্রত্যেক পাড়ায় খবর পাঠিয়ে শলা পরামর্শ করে যে,এমনিতে জুমের খাজনা দেয়ার সামর্থ নেই তার উপড় ভ’ঁই চাষের জন্য উপযোগী করা পতিত জমি খাজনা দিতে না পারলে সরকার জেলে ডাল ভাত খাওয়াবে সুতরাং ভ’মি বন্ধোবস্তি নেয়া যাবে না। এই সিদ্ধান্তে পাড়ার প্রায় সব পুরুষ প্রত্যেহ ভোরে ভাতের মোচা নিয়ে জঙ্গলে পালাতো কানুনগো সার্ভেয়ারদের ভয়ে। সারাদিন তৈনগাঙের মোহনায় মাছকুমে বড়শী দিয়ে মাছ ধরে বনভোজন করতো এবং সময় অতিবাহিত করতো।
কানুনগো সার্ভেয়াররা নাকি অভিশাপ দিতো,এই মাটির জন্য একদিন হায় হায় করবে। সন্ধ্যার দিকে একজন পাড়ার কাছে এসে উঁকি ঝুকি দিয়ে মহিলাদের ডাকতো চুপিসারে,কানুনগো বাবু চলে গেছে কিনা। মহিলারা হ্যাঁ সূচক ইঙ্গিত করলে সবাই ডাকাডাকি করে জঙ্গল হতে পাড়ায চলে আসতো। কানুনগো সার্ভেয়াররা যাদের বাড়ীতে অবস্থান করতো কিংবা যাদেরকে জোড় পূর্বক কম্পাসে দাগ দিয়ে জমি দিয়ে যায় পরবর্তীতে তারা এক একজন জমিদার হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
গোলাভরা ধান,পুকুর ভরা মাছ,গোয়াল ভরা গরু।
গ্রাম বাংলার এই প্রবাদটির উজ্জল দৃষ্টান্ত ছিল আদিবাসীদের গ্রাম। কাঁঠাল আম্র কাননে ঘেরা খুঁটির উপর কাঠ আর টিনের কারুকার্যের বাড়ী গুলো ঐতিহ্যের শোভা বর্ধন করতো। জেহপোয়ে,পাখুং,গেঙ্গুলীগীত,বিভিন্ন পুজা পার্বন ও ধর্ম্মীয় উৎসবে আনন্দ মুখর ছিল আদিবাসীদের গ্রাম। তারা অতি সহজ সরল ও অসাম্প্রদায়িক ভালবাসার মুর্ত প্রতীক ছিলো। চাকমা,মার্মা,তঞ্চঙ্গ্যা,খুমী,ত্রিপুরা ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোন বৈষম্য-প্রভেদ ছিল না।
১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধে প্রতিবেশী দেশ মায়ানমার বিদ্রোহী একদল প্রক্যা ইদ্রিস মোল্লার নেতৃত্বে আলিকদমে এসে আদিবাসীদের গ্রামে লুটরাজ চালায়। রাতে অন্ধকারে হামলা চালিয়ে সোনা,রুপা,ধন দৌলত লুটে নিয়ে যায়। জমিদার ধনী ব্যক্তিরা জীবন নিয়ে বনে জঙ্গলে পালাতে বাধ্য হয়। স্বাধীনতার পর নতুন প্রশাসন,প্রশাসনিক বিকেন্দ্রীয়করন ইত্যকার কারনে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় অন্যান্য এলাকা থেকে বহিরাগতদের ক্রমঃ আহমন সুচীত হয়। শুরু হয় ব্যবসা বাণিজ্য দখল,মহাজনী প্রথা,আফিম,মদের অবাদ প্রচলন এবং জুয়া খেলার আড্ডা।
প্রশাসন, উন্নয়ন এবং সভ্যতার কিরনে তখনকার সহজ সরল আদিবাসীরা অন্ধ হয়ে যায়। অন্ধকারে গাঁজা,আফিম, মদে ডুবে তালমাতাল বেসামাল হয়ে পড়ে। মহাজনের খপ্পরে পড়ে হারিয়ে ফেলে জায়গা ভিটে মাটি সব।
স্বাধীনতার পঁয়ত্রিশ বছরে বিগত ইতিহাস পরখ করলে দেখা যায়,জনসংখ্যার চাপে অধিকাংশ আদিবাসীর জায়গা জমি ভিটে মাটি হারিয়ে আরো দূর্গম ও প্রত্যন্ত এলাকায় চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ফলে চম্পট পাড়া,চন্দ্রমোহন পাড়া,মালীপ্রু পাড়া,সুরেন্দ্রলাল পাড়া সহ অসংখ্য আদিবাসী গ্রামের অস্তিত্ব আজ নেই।
সেকালে জমিদার,ধর্নাঢ্য ব্যক্তিদের অস্তিত্ব আজ বিলীন হয়ে গেছে। অনেকের অস্তিত্ব আজ বিপন্নের দিকে।
( ৯ই আগষ্ঠ,২০১০ ইং আন্তরজাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ব বিদ্যালয়ের অধ্যায়নরত ছাত্র/ছাত্রী এবং তঞ্চঙ্গ্যা স্টুডেন্ট লিটারেসার ফোরাম কর্তৃক “তৈনগাং” এ প্রকাশিত। লেখাটি ব্লকে পূর্ণ মুদ্রিত).
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।