অনিশ্চয়তার পথে একাকী হেঁটে চলা চুপচাপ টাইপ একটা ছেলে...আমার বন্ধু সৈকতের সাথে একদিন সন্ধানীতে এল। নাম আশরাফুল ইমাম শাকিল।
সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজের ৪৬ তম ব্যাচের ছাত্র।
কম কথা আর নিরলস কাজের এই মানুষটা অল্প কয়েকদিনেই সন্ধানী সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ ইউনিটের প্রতিটি মানুষের অতি আপন হয়ে ওঠে।
স্বেচ্ছায় রক্তদান অনুষ্ঠানের মোটিভেশনে নিয়ে গিয়েছিলাম বেশ কয়েকবার...অনেক সুন্দর করে মানুষকে বুঝিয়ে বলত সে।
ওষধ কালেকশনে পাঠাতাম...ঘন্টার পর ঘন্টা স্যারদের চেম্বারের বাইরে অপেক্ষা করে দরিদ্র মানুষের জন্য নিয়ে আসত ওষুধ।
সন্ধানীর কালেকশনে কারো প্রয়োজনীয় ওষুধ না থাকলে কিনে আনারও ব্যবস্থা করেছে কখনও কখনও।
রাত বিরাতে অসহায় মানুষের জরুরী রক্তের প্রয়োজনে যোগাড় করে দিতে ছুটে এসেছে হোস্টেল থেকে!
ছোট ছোট বাচ্চাদের রক্তের গ্রুপিং করানোর সময় মজার মজার গল্প বলত আর আস্তে করে ৩ ফোঁটা রক্ত বের করে নিত...বাচ্চাগুলো কাঁদত না!!!
কিভাবে মানুষকে ভুলিয়ে রাখত ও এখনও আমি বুঝিনা।
অসংখ্য মানুষের কাছে পৌছে দিয়েছে নানা ভয়ংকর রোগের ভ্যাক্সিন সন্ধানীর পক্ষ থেকে।
প্রথমবার কার্যকরী পরিষদে সে ছিল যুগ্ম ছাত্র কল্যান সম্পাদক।
অসাধারন পারফরম্যান্স ছিল তার।
পরবর্তীতে সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব কাঁধে পড়লে বলেছিল, "ভাই এতবড় দায়িত্ব আমাকে দিয়েন না...আমিতো ছোট মানুষ...এত বড় কাজ আমাকে দিয়ে হবেনা। "
যেখানে মানুষ বিভিন্ন জায়গায় পোস্টের জন্য মারামারি করে, সেখানে ও নিতেই চায় না!!!
পারবি ইনশাল্লাহ বলে বুঝিয়ে সুঝিয়ে দায়িত্ব দিয়ে ভেগে গিয়েছিলাম স্বার্থপরের মত।
ও কথা রেখেছিল...ঠিকমতই দায়িত্ব পালন করেছে ছেলেটা।
কয়েকদিন হয় দ্বিতীয় পেশাগত পরীক্ষা চলছিল ওদের।
গত পরশুর ভাইবাটা অনেক ভাল দিয়েছিল...স্বভাবসুলভ কর্মনিষ্ঠা নিয়ে গতকাল(শুক্রবার) ও অনেকের রক্ত যোগাড় ও সরবরাহ করেছে।
সন্ধানীর অফিসের ঈদের ছুটির নোটিশটা নিজের হাতে লিখে লাগিয়েছে।
ঈদের পর আরো দুটো ভাইবা...শনিবার সিলেট থেকে ঢাকা হয়ে কুমিল্লা বাড়ির পথ ধরেছিল ও আর নাফিস।
শেরপুরের কাছে আরেকটা বাসকে ওভারটেক করতে গিয়ে বিপরীত দিক থেকে আসা ট্রাকটার ধাক্কায় ট্রায় দুটুকরো হয়ে যাবার অবস্থা ইউনিক পরিবহনের বাসটার।
আমাদের শাকিল নিথর হয়ে গেল।
সারাটা বাসের একটা মাত্র হৃদয় চিরদিনের জন্য থেমে গেল...যে হৃদয় নিঃস্বার্থভাবে ভালবাসত মানুষকে।
অনেকে মারাত্মক আহত হল।
হারিয়ে গেল শুধু আমাদের শাকিল!!!
আমি তখন ফেনী থেকে ফিরছি...ভয়ংকর রাস্তার ঝাঁকুনি, কোথাও অল্পের জন্য জানে বেঁচে যাওয়া...একের পর এক ফোন...আমাদের শাকিলটা নাকি আর নেই!!!
আর কোনদিন আমার ফোনটা সে রিসিভ করে বলবে না,"ভাই আপনাদের কথা খুব মনে পড়ে...একবার সিলেট আসেন,ঘুরে যান...আমাদের দেখে যান। "
চারমাস হয় শেষ গিয়েছিলাম সিলেট।
ফেনীতে আমার বাড়িতে ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে প্রথমবার যেতে পারেনি বলে খুব আফসোস করছিল...বলেছি পরীক্ষা আগে...পরেরবার নেবো...গত ফেব্রুয়ারীতে ও যখন মেডিকেল ক্যাম্পে এল...সারাটাদিন ক্লান্তিহীন কাজ করল...বিদায়ের সময় আবার দাবী...এরপরেরবার না আনলেও চইলা আসমু...
আমাদের শাকিল আর কোন ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পে যাবে না!!
কারো জরুরী বক্তের প্রয়োজনে ছুটে আসবেনা।
।
অনেক কিছুই মনে আসছে...খুব কান্না পাচ্ছে...আর লিখতে পারছি না।
দুই ড্রাইভার পালিয়ে গিয়েছে অ্যাক্সিডেন্টের পরপরই...আশ্রয় নিয়েছে নিশ্চয় তাদের দুই আব্বা আবুল আর শাহজাহানের কোলে।
আইন তো ওদের কিছুই করবে না!!!
ধিক্কার এইসব ইতরগুলোকে, মন্ত্রীরূপী পিশাচগুলোকে।
পুরোটা সিলেট মেডিকেল শোকে স্তব্ধ...শিক্ষার্থী-শিক্ষক-কর্মচারী...সবাই।
শোকে মুহ্যমান পুরো সন্ধানী পরিবার।
আর বসে থাকব না...এবার নেমে এসে চিৎকার করার সময় এসেছে।
আসুন সবাই একসাথে হই, রাজনীতি-সাম্প্রদায়িকতা-বর্ন-শ্রেনী-পেশা সব ভুলে।
আমাদের শাকিল, তারেক-মিশুক আর নাম না জানা সহস্র অকালে হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলোর কাছে দায়বদ্ধতা থেকে একসাথে হই...সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করি। ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।