নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা । (পূর্ব প্রকাশনার পর )
চতুর্থ অধ্যায় / (প্রথম অংশ)
“… পৃথিবীর সব রং নিভে গেলে পান্ডুলিপি করে আয়োজন
তখন গল্পের তরে জোনাকির রঙে ঝিলমিল;
সব পাখি ঘরে আসে – সব নদী- ফুরায় এ জীবনের সব লেনদেন …”
আজ সম্ভবত শীলার চলে যাবার কথা । অন্তত এরকম ভাবেই সে বলেছিলো সপ্তাহ দুই আগে । বোঝাপড়া করতে তাকে নাকি যেতে হবে ।
মাস দুয়েক বা তিন সে দেশে থাকবেনা এমোনটাই আমাকে ধারনা দিয়েছিলো । কিছু ঠিক না হলে আরো দেরী হতে পারে । আর একটা বিহিত হয়ে গেলে সে ফিরে আসবে তাড়াতাড়িই । আমার মুঠোফোনের ওপার থেকে তার দয়াদ্র কন্ঠে এই ক’টা দিন আমার খারাপ লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করাতে আমার গলাটা ধরে এসেছিলো । রাত তখন অনেকটা বুড়িয়ে গেছে ।
আকাশটা বুঝি অন্ধকার, চাঁদ ছিলোনা আকাশে । আমার বলার কি ই বা ছিলো, আকাশের মতোই চুপচাপ তার কথা শুনে যাওয়া ছাড়া ! দু’তিন মাস শীলার প্রতি সকালের পাঠানো অদ্ভুত শুভেচ্ছা আমার মুঠোফোনে আর দেখতে পাবোনা আমি ,যার প্রতীক্ষায় আমার রাতগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়ে যাচ্ছিলো দিনদিন, এ উপলব্ধি হতে আমার বুকের বাতাস ফুরিয়ে গেল যেন ! উদাসী বাতাস ঝড়া পাতাদের উড়িয়ে নিয়ে গেলে যেমন শুন্য উঠোন পড়ে থাকে তেমনি আমারও বুকের সুখী প্রহরগুলো শীলার অমন কথায় উড়ে গেল দুর থেকে দুরে, রেখে গেল শুধু এক বিরান প্রান্তর ।
বুঝলাম কঞ্চি ঘিরে বেড়ে ওঠা সতেজ সীম লতার মতো একটা অবলম্বন যেন এতোদিনে পেয়ে গেছে সে । আমাকে । তার হঠাৎ করে পাওয়া এই অবলম্বনের সাথে জীবন নোতুন করে জোড়া দিতে নাকি তাকে যেতেই হবে ।
এ তারই প্রস্তুতি । একটা বোঝাপড়া নাকি তাকে করতে হবে তার প্রবাসে থাকা স্বামীর সাথে । আর কতোদিন সে মুখ বুজে অবহেলা সয়ে যাবে । স্বামী পরনারী আসক্ত, এর চেয়ে একজন স্ত্রীর আর কি পরাজয় আছে । কেবল মেয়েটির মুখ চেয়েই সে সব সহ্য করে গেছে এতোদিন ।
এসব কাহিনী আমার জানা । শীলাই বলেছে আমাকে কোনও একদিন, “এই নিয়ে আমি কি করে যে বেঁচে আছি সে আমিই জানি । আমার যে কি কষ্ট তুমি বুঝবেনা । আজ আমি তোমাকে পেলাম । আমার ভয় কি ? জানি তোমার ঘর-গৃহস্থালী আছে, সমাজ আছে ।
তবুও আমি কোনও দিন তোমার কাছে আসতে চাইলে, তুমি কি আমাকে নেবেনা ? ফিরিয়ে দেবে ?”
যতো সহজে শীলা বলে গেল, ততো সহজ নয় যে উত্তরটা এটাও তার জানা । নিজে থেকেই দিলো উত্তরটা যেন আমার হয়েই বলা । না, সে কষ্ট আমি তোমাকে দেবোনা । তোমার সংসারে , তোমার জীবনে অশান্তি টেনে আনতে চাইনে আমি । আমি যে তোমাকে ভালোবাসি ।
এ ক্ষতি আমি কেমন করে করবো তোমার । আমি তোমাকে পাবোনা জানি, তারপরেও মনে হয় তোমাকে যদি আগলে রাখতে পারতাম সারাটি জীবন !
আমি শুধু একবার বলেছিলাম, যাওয়াটা কি খুবই প্রয়োজন ?
শীলা কি করে ভাবলো, আমি বুঝি ভয় পেয়ে যাবো সে আমার কাছে চলে আসবে শুনে ? হায়রে মানুষ ! এতো সহজেই কারো সম্পর্কে সিদ্ধান্তে পৌঁছে যেতে তার সময় লাগেনা । সবাই জানে, এ জাতীয় পরিস্থিতিতে মানুষের মেকী সম্মান, সামাজিক অবস্থান ঠিক রাখতে হলে মানুষকে বিসর্জনের পথটাই বেছে নিতে হয় । সারাদিন খেটেখুটে মনের মাধুরী মিশিয়ে যে প্রতিমা গড়া হলো, যে প্রতিমার কাছে পুঁজোর অর্ঘ্য তুলে দিলাম দু’হাত ভরে, তাকেই এক নির্মম সকালে এই হাতেই বিসর্জন দিতে হবে অথৈ জলে । মানুষ জানে এটাই নিয়ম ।
সমাজের টেনে দেয়া দাগ পেরিয়ে দুটি গৃহী নারী-পুরুষের কাছে আসার গল্পের এটাই পরিনতি ! পেরিয়ে চলে যে আসে তাকে যে স্খলনের দাগ নিয়ে চলতে হয় আজীবন, জীবনের ঘাটে ঘাটে দিতে হয় অগ্নিপরীক্ষা । সবাই তা মেনে নিতে পারেনা । তাই কোনও এক পক্ষকে সমস্ত দায় সত্বেও সে দায়কে অস্বীকার করতেই হয় । তার ভালোবাসার চুড়ান্ত পরীক্ষার আভাস পেলেই বা তার ছোঁয়া লাগলেই তাকে নিঃশব্দে সরে পড়তে হয় । এ মানুষের আরেক রূপ ।
মানুষ বুঝি বহুরূপী এক প্রানী । তার স্নায়ু কোষের পরতে পরতে যে চাল-কূটচালের খেলা চলে নিয়ত তাকে এড়াতে পারেনা কেন সে ! সব মানুষেরই হয় কি ! মানুষের ও যে রকমফের হয়, হয় চেতনা আর নিজাত্মার কাছে দায় স্বীকারের বোধ থেকে জন্ম নেয়া একজন ক্রুশবিদ্ধ যীশুর ; যে নিজ করতলে তুলে নিতে চায় কুষ্ঠগ্রস্থ মানুষের দায়, একথা অনেকেই জানেনা । হয়তো শীলাও ।
সেদিনের পর থেকেই ডুব । শীলা যেন হারিয়ে গেল দুর সমুদ্রে পাল তোলা নাওয়ের মতো ।
তার ফেলে যাওয়া তিরতির হয়ে আসা ঢেউগুলোর দিকে চেয়ে চেয়ে দেখলাম শুধু ।
দুদিন তার সাড়া না পেয়ে আমি তাকে হেমন্তের একখানা গান মেইল করে পাঠিয়েছিলাম – “যাবার আগে কিছু বলে গেলেনা.. নিরবে শুধু…” এই গানখানা ।
শীলা এখোন কোথায় ?
না যাবার আগে শীলা আমাকে কিছু বলে যায়নি । অফিসে বসে কাজ করতে করতে আনমনা হয়ে ভাবছিলাম কতোদিন আমার ম্যাসেঞ্জারটি নিশ্চুপ বসে থাকবে কারো লেখা স্ক্রীনে ফুটে ওঠার অপেক্ষায় ! মুঠোফোন নিরব হয়ে থাকবে কতোদিন ! কতোদিন আমি বাসায় ফিরে যাবো কারো উৎকন্ঠা ছাড়াই ! মন বসছিলো না কাজে । কাগজ কলম টেনে ছবি আঁকছিলাম এলোমেলো ।
ছঁবি আকা আমার খুব শখের । নিজের মনে নিজেই আঁকি । ফুল্লরা, আমার স্ত্রী ; আমার ছবি বেশ পছন্দ করে । প্রেমের অনুরাগ পর্বে তার মুখের একটি ছবি আমি এঁকেছিলাম নেগেটিভ ফর্মে । এ ছবি নিয়ে তার বন্ধু মহলে দারুন কাড়াকাড়ি ।
সে থেকেই আমি যা আঁকি তাতেই ফুল্লরা উৎফুল্ল । সমালোচনা যে করেনা তা নয় । মেয়েদের ন্যুড আঁকলেই তার কন্ঠে ঝরে বিরাগ, ছিঃ ছিঃ কি সব অসভ্য জিনিষ আঁকো । রুচি-টুচি সব গেছে ?
সে আমিই ছবি আঁকছিলাম । কার মুখ আঁকছিলাম জানিনে ।
মুঠোফোনের স্ক্রীন উজ্জল হয়ে উঠলো । মাত্র দুটি অক্ষর ভেসে উঠলো তাতে । শীলার সাংকেতিক নাম । বুকের ভেতর বিষ্ফোরন হলো যেন । একটা বীট মিস হয়ে গেল বোধহয় ।
শীলা যায়নি তাহলে !
“না গেলাম না” , ওপাড় থেকে ভেসে এলো শীলার গলা । শরীরের প্রতিটি রন্দ্রে রন্দ্রে যেন খেলে গেল বিদ্যুতের ঝলকানি ।
“কেন গেলেনা, কোনও অসুবিধে ?শরীর ঠিক আছে তো ?” উৎকন্ঠা ঝরে পরে আমার গলায় । শীলাকে নিয়ে আমার যে উৎকন্টা্ আমি তা কাকে বোঝাবো !
“গেলাম না, তোমাকে ছেড়ে যেতে ইচ্ছে করেনি । তোমাকে ছেড়ে আমি কি করে যাই বলো ?”
টিনের ছাতে বৃষ্টির শব্দের মতো ঝমঝম করে সুর বেজে উঠলো আমার রক্তে, আকন্ঠ তৃষ্ণায় শুকিয়ে যাওয়া ধমনীতে বইলো তার স্রোত ।
“আমার জন্যে তুমি গেলেনা ? শীলা, তুমি কি আমাকে পাগল করে দেবে ?”
“পাগল আমার !” আহ্লাদী গলা শীলার, ভাঙা ভাঙা ।
এ নিয়ে এ কথাটি কতোবার বললো শীলা আমাকে ?
গুনে দেখতে হবে ।
(চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন) ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।