নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা । শুদ্ধতম পরকীয়া
চতুর্থ অধ্যায় / (প্রথম অংশ)এইখানে ক্লিক করুন -
Click This Link
(পূর্ব প্রকাশনার পর )
চতুর্থ অধ্যায় / (দ্বিতীয় অংশ)
এলানো হাতখানি আমার বুকের উপর পড়ে আছে ফুল্লরার । আজ এ হাতখানিকেই খুব ভারী মনে হলো । যে হাত আমার সকাল বিকেল আর রাতের সঙ্গী ছিলো হঠাৎ হঠাৎ , যে হাত আগলে ছিলো আমার সংসার ভালোয়-মন্দোয় সে হাতখানা আজ ভারী ভারী লাগছে কেন ! আমি কি নষ্ট হয়ে গেছি ! এ কোন অধঃপাতে আমার নেমে যাওয়া ! হালকা আলোয় সে হাতখানার দিকে তাকালাম ।
প্রথম যেদিন এই হাতখানি ধরেছিলাম তার ছিলো মোমের মতো পেলব দেহখানি । উজ্জল ছিলো তার বর্ণ । আজ এই রাতে তাকে যেন আবার নতুন করে দেখতে হলো । সময়ের দাগ লেগেছে সে হাতে । তন্বী দেহে লেগেছে শিথীলতা, বর্ণ অনুজ্জল কিছুটা ।
একি তার দোষ নাকি সময়ের । সে হাতের স্পর্শ আগের মতো আমার তন্ত্রীতে তন্ত্রীতে বেহালার ছড়ের মতো টেনেটেনে সুর তোলে কি ? কে জানে ! নাকি, আমার অপরাধ যদি কোনও হয়েই থাকে আজ, তার স্বপক্ষে এ আমার অনুচিত অভিযোগ ।
ফুল্লরা আড়মোড়া ভাঙ্গলো, চমকে উঠলাম আমি । ঘুমের অতল থেকে ফুল্লরা আমার ভাবনাগুলোর সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে চৈতন্যে ফিরে এলো যেন !
“তুমি ঘুমাওনি” জড়ানো গলায় তার প্রশ্নটি এতোই আচমকা যে অন্তরাত্মা কেপে উঠলো । ধরা পড়ে গেলাম !
মিনমিন করে বলি – “নাহ, ঘুম কেটে গেছে ।
এ্যাসিডিটি’র ব্যথাটা আবার চাগিয়ে উঠলো । ঔষধ খাবো ? একটু পানি খেতে পারলে ভালো লাগতো বোধহয় । ”
ধরা পড়া চোরের মতো আত্মপক্ষ সমর্থনের কসরত করতে গিয়ে বুঝলাম, উত্তরের প্রয়োজন ছিলোনা । আবার ঘুমিয়ে গেছে ফুল্লরা । বেশ ভারিক্কি লাগছে দেখতে ।
দু’দুটো বড় হয়ে যাওয়া সন্তানধারিনীর যেমনটা হওয়া উচিৎ তেমন দেহের কাঠামো । মেদ জমেছে পেটে আর যেখানে জমার সেখানে । পঁচিশ বছর আগের ফুল্লরা আর নেই । যে দেহের ভাজে ভাজে একদিন তুমুল ঢেউয়ের ভেঙ্গে পড়া ছিলো, ছিলো তরী বাওয়া তা আজ ক্ষয়ে যাওয়া পদ্মার মতো চরে ছেয়ে গেছে । নাব্যতা গেছে কমে ।
এও কি তবে পদ্মার থেকে চোখ সরিয়ে নেয়ার আর একটা কারন আমার ! নিজের স্বপক্ষে কারন জড়ো করতে থাকি ।
ফুল্লরার হাতখানি সরানোর প্রয়োজন ছিলোনা । আড়মোড়া ভাঙ্গতে গিয়ে সেখানি আপনিই সরে গেছে । সাবধানে বিছানা থেকে নামলাম । গলা শুকিয়ে গেছে ।
জল খেতে হবে । বেডরুমে জলের গ্লাস নেই । আমিই এনে রাখি প্রতিদিন । এটা আমার কাজ । আজ এমোন ভুলটি হলো কেন ?
আজ শীলার সাথে কথা হয়েছে অনেকদিন পরে ।
“তোমাকে ছেড়ে আমি কি করে যাই বলো ?”
এই কথাটুকুতে যে পৃথিবীর সব মধু লুকোনো । আমি তো ভাসছি সেই থেকে । নতুন ওড়নার মতো মনখানা উড়ছে ফুরফুরে হাওয়ায় । শীলার ছোঁয়া লেগে ভেতরের নিভুনিভু প্রদীপখানি যে তার সব রোশনাই জ্বেলে আমার অন্তরাত্মার গভীরে লুকানো ভালোবাসার ঘর-গেরস্থালী আবারো উদ্ভাসিত করে দিয়ে গেল, সে খবর যে শীলা পেলোনা । সে ভালোবাসা মনে মনে ছড়িয়ে গেল সবখানে ।
আমার ঘরে, ফুল্লরার কাছে, ছেলেমেয়েদের আঙ্গিনায় । সবাইকে আবার যেন বেশী করে ভালোবাসতে ইচ্ছে হলো । আরো বেশী করে যেন সবাই জড়িয়ে গেল আমার রক্তমাংশে । সত্যিকারের ভালোবাসা বোধহয় এমোন করেই শেকড় প্রোথিত করে দেয় মাটির গহন অবধি !
খুশিতে রাস্তার মোড়ের ফুলওয়ালী মেয়েটির কাছ থেকে একগোছা রজনীগন্ধাও কিনে ফেললাম ফেরার পথে । নির্ভেজাল, কাটাবিহীন, স্নিগ্ধ ।
গোলাপ কিনিনি কারন তা ভুরভুরে গন্ধে ভরা আর কাটাওয়ালা । চোখ জুড়ানো রঙের অন্য অনেক ফুল আছে, কাটা নেই কিন্তু গন্ধবিহীন । রজনীগন্ধা রাতের নিভৃতচারী, কাটাবিহীন আর রঙহীন সাদা , রঙের ভীড়ে তার জৌলুষ নেই । সাদা সমর্পনের রঙ । আমি শীলাতে সমর্পিত বা শীলা আমাতে ।
খুচরো কিছু আলাপ ও করলাম ফুলওয়ালীর সাথে । মেয়েটি হয়তো অবাক খানিকটা ।
“ছার, আপনে কারে দেবেন ফুলগুলা ? এত্তোগুলি ফুল কেনলেন” নির্মল প্রশ্ন । উত্তরটা এই মূহুর্তে গুলিয়ে গেলো । অবচেতনে মনে হলো তাইতো, কার জন্যে ফুল কিনলাম ! শীলার জন্যে ? তা কি করে হবে, শীলার ঠিকানা যে আমার জানা নেই ।
খুব সন্তর্পনে এড়িয়ে গেছে শীলা ঠিকানার প্রশ্নটি । মনটা উদাস হয়ে গেলো মেয়েটির কথায় ।
এই মূহুর্তে কাকে উদ্দেশ্য করে ফুল কিনেছি তা চট্ করে মনে পড়লোনা । অথচ ফুল্লরার জন্যে নেয়া যেতে পারে ভেবেই আমি ফুল কিনেছি, একথাটুকুও মনে এলোনা । আমি জানি ফুল্লরা অবাক হবেনা ।
তির্যক চোখে আমাকে পড়ে নিতে চাইবে । ইদানীং ও যেন কেমন করে তাকায় আমার দিকে । সেই দিন থেকে যেদিন ফুল্লরা আমাকে গভীর রাত জেগে কম্পিয়্যুটারের সামনে বসে থাকতে দেখেছে । “এই বুড়োকালে এতো রাত জেগে কি করছো কম্পিয়্যুটারে ? দু’দুবার ডাকলাম ঘুমুতে আসতে, খবর নেই । ” শরীরে ঘাম দিয়ে যেন জ্বর এলো ।
ফুল্লরা এগিয়ে আসছে আমার ঘরের দরজা ঠেলে । একনজর চোখ বুলিয়ে ঘুরে যেতে যেতে ঝাঝালো গলায় বলে গেল – “ভীমরতি, এতো রাত্তিরে কার সাথে চ্যাট করছো ?” সেদিন থেকে, শীলার সাথে যোগাযোগের দ্বিতীয় দিন, ফুল্লরার চাহনি যেন বদলে গেল । সন্দেহ ? সন্দেহ বড়ই সংক্রামক । ভাইরাসের মতো ডরম্যান্ট আর সুযোগ পেলেই ডালপালা ছড়ানোতে জুড়ি নেই ।
ফুলের জন্যে একটা যুৎসই উত্তর খুঁজতে খুঁজতে ঘরে ঢুকতেই জিনিয়া দৌড়ে এলো ।
পরিপাটি সাজ । বাইরে যাবে কোথাও, এমোন ।
“ওম …মা, বাবা তুমি আজ ফুল কিনে এনেছ ? কি ব্যাপার বাবা , আমাদের তো কারোই জন্মদিন না আজ, তবে ?”
আমতা আমতা করতে থাকি – “না.. এই আসছিলাম হেটে হেটে, পথের মোড়ে ঐ যে ফুলওয়ালীটা আছে না , কি যেন নাম…. । “ মুখের কথা মুখেই আটকে থাকে ।
জিনিয়া এগিয়ে আসে খুব কাছে, “খুব ভালো হয়েছে বাবা ।
ফুলগুলো আমাকে দাও, আমি এক বান্ধবীর বার্থ-ডে পার্টিতে যাচ্ছি । গিফট কিনেছি একটা মোটামুটি চলে যায়, সাথে ফুলগুলো হলে দারুন । আগেই ইচ্ছে ছিলো কেনার কিন্তু গিফট কিনতে গিয়ে দেখি অতো পয়সা হবেনা একটা ফুলের বুকে কেনার । দাও দাও । আচ্ছা ঠিক আছে, অর্ধেকটা আমি নিচ্ছি বাকীটা তোমার ।
” একনাগাড়ে কথা বলতে বলতে হাত বাড়ায় জিনিয়া । হাঁপ ছেড়ে বেঁচে যাই যেন । প্রগলভ হয়ে উঠতে চেষ্টা করি, “তাহলে বল একটা টেলিপ্যাথীর ঘটনা ঘটে গেল ? তোর মনের কথা তাহলে আমি পড়তে পারছি ?”
জিনিয়ার মুখটা একটু লাল হয়ে গেল যেন । এমনিতেই সুন্দরী আর ফর্সা মেয়েটি আমার । লালের লালিমা লাগতেই আরো সুন্দর লাগলো ।
লজ্জা পেয়েছে বোধহয় । বললাম, যেখানে যাচ্ছিস যা । আর সব ফুলগুলিই তোকে দিলাম, নিয়ে যা ।
তবুও সবগুলো নেয়নি জিনিয়া । কয়েকটা ষ্টিক রেখে গেলো পেপসির খালি বোতলে পানি দিয়ে ।
সেই থেকে যতোবারই চোখ যাচ্ছে ষ্টিকগুলোর দিকে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ছি । একটা অপরাধ বোধ হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়তে চাইছে যেন মনের দেয়াল ডিঙ্গিয়ে । আর সে কারনেই প্রতিদিনের অভ্যেস, জলের গ্লাস আর জল আনার কথা বেমালুম ভুলে বসে আছি ।
জল আনতে ডাইনিং এ যেতে হবে । যেত যেতে আবার ফুল্লরার দিকে তাকালাম ।
নিশ্চিন্তে ঘুমুচ্ছে । গেল কয়েকটা বছর ও এরকমই নিশ্চিন্ত আর নির্লিপ্ত । নিজের ভেতর নিজেকে গুটিয়ে নিচ্ছে যেন । আমার প্রতিও ওর টান আগের মতো নেই । বরং খবরদারী, হম্বি-তম্বী বেড়েছে যেন ।
সাংসারিক ঝুট ঝামেলা তো প্রতিটি সংসারে থাকেই । কোন সংসারে নেই ! আমার ঘরে আজকাল একটু বেশী বেশী হচ্ছে যেন, অহেতুক । এত্তো রাতে এগুলো নিয়ে আর ভাবতে ভালো লাগছেনা । এ যেন অনুচ্চারিত অনুযোগের পাতা উল্টে উল্টে দেখা ।
জল খেয়ে আবার ফিরে আসতে হয় নিজ ঘেরাটোপে ।
কিছু শুদ্ধ আর কিছু কিছু ভুল-ভ্রান্তির রেখা টেনে টেনে এ তো আমারই আঁকা দিনপঞ্জীর তৈলচিত্র ।
(চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।