আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

শুদ্ধতম পরকীয়া (উপন্যাসিকা)

নিজের সম্পর্কে লেখার কিছু নেই । সাদামাটা । (পূর্ব প্রকাশনার পর ) তৃতীয় অধ্যায় / (দ্বিতীয় অংশ) আমাদের বাড়ীটা অন্য বাড়ীর মতো নয় । খোলামেলা সবাই । একমাত্র ছোট ভাইটি এই তো সেদিন বিয়ে করে আলাদা বাসায় উঠে গেছে ।

জানাশোনার বিয়ে । জেসমিনের সাথে ওর মেলামেশা অনেকদিনের, খানিকটা লুকিয়ে খানিকটা জানান দিয়ে । প্রেমের জোয়ার নাকি বেশীদিন টেকেনা । বিয়ে হয়ে গেলে নাকি ভাটার টান ধরে । ওদের দেখে এই মূহুর্তে সে রকম আগাম কিছু ভাবা ঠিক নয় ।

এখোন তো জোয়ারেই ভাসছে দু’জনে । এ নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই । বাবারও কোনও সংষ্কার নেই, আমার ও । কেবল মা’কে নিয়ে একটু আধটু অসুবিধায় পড়তে হয় । বাঙালী ঘরে জন্ম তো, সব সংস্কার ছাড়তে পারেন না ।

‘পড়েছি তোর বাবার পাল্লায় । আগে জানলে তোর বাবার সাথে বিয়েতে রাজি ই হতাম না । আর তোরা ও হয়েছিস তেমনি । একটু রাখ-ঢাক থাকবেনা তোদের’ মা’য়ের একথা শুনতে শুনতে আমাদের কান পঁচে গেছে অনেককাল আগে । আড়ালে আবডালে মা’য়ের এই মাথাব্যথা কিভাবে সারানো যায় এনিয়ে আমরা দু’টি ভাইবোন অনেক গবেষনা করেছি আর প্রতিটি গবেষনার বিষয় নিয়ে হেসে কুটি কুটি হয়েছি ।

‘কিরে তোরা হাসছিস যে বড়’ মায়ের এই বোকা বোকা প্রশ্ন আর চাহনি দেখে আবার আর একপ্রস্থ হেসে নেয়া গেছে । “মা, হাসি হলো গিয়ে স্বাস্থ্য ভালো রাখার লেটেস্ট থেরাপী । বই-পুস্তক ঘাটো না তো, জানবে কোত্থেকে ?” আমি আরো হা হা করে হাসতে হাসতে বলি আমার সরল মা’টিকে রাগিয়ে দেয়ার জন্যে । “তা হলে তোদের বাবাকে ঘরে বসে বসে হাসতে বলে দে । খামোকা সক্কালবেলা রাস্তাঘাটে দৌড়ানোর দরকার কি ?” মা মুখ ঝামটা মেরে সরে যান সামনে থেকে ।

আমার রাখ-ঢাক নেই । আমার ইচ্ছেগুলোরও সামাজিক ব্যাকরন মেনে চলার ধাত নেই । রাত গভীর, ঘুমুচ্ছে সারা পৃথিবী, ইচ্ছে করলো তো ফুল ভল্যুউমে রবীন্দ্রনাথের ঐ গানটা শুনি… “এই কথাটি মনে রেখ আমি যে গান গেয়ে ছিলেম….” । অথবা শীত-গ্রীষ্ণ যা ই হোক হয়তো কোনও গভীর রাতে ইচ্ছে হলো, স্নান করি । শাওয়ারের কল পুরোটা খুলে দিয়ে নগ্ন শরীরে দাঁড়িয়ে থাকি অনেকটা সময় ।

শরীরের কাঠামোয় জুড়ে থাকা হাত দুখানি দেখি, নিটোল । বুদ্ধদেব বসুর “একখানা হাত”এর কথা মনে পড়ে যায় । চোখ তখন শরমে লতানো দেহখানির দিকে দৃষ্টি মেলে । যেখানে যেমন থাকার আছে । কোমল জঙ্ঘার দু’ধারে স্নেহের পলিতে আদ্রতা মাখিয়ে পড়ে থাকা মোমের মতো উরু ।

মসৃন পেটের সমতল পেড়িয়ে ঈষৎ বাক নিয়ে উঠে যাওয়া স্বপ্নের পাহাড় যেন কুয়াশায় ঢাকা । উপত্যকার সুতীব্র ঢাল বেয়ে শাওয়ারের জলধারার ঝর্ণার মতো বয়ে যাওয়া দেখি । কান পাতলে ঝিরঝিরে শব্দও হয়তো শোনা যায় । মুগ্ধ হয়ে থাকি । শরীর….শরীর.. ।

এই শরীরকে নিয়ে আমার বড় ভয় । এই শরীর নিয়ে আর কতোদুর যেতে হবে আমায় ! কতোদুর ! শরীরের সাথে মনটাও যে ঘুড়ির মতো নিঃসীম আকাশে লাট খেতে থাকে । অদৃশ্য কাউকে ডেকে বলতে ইচ্ছে করে - দুরে কোথাও…দুরে…দুরে । আমাকে নিযে যেতে চাও, যাবো । যতোদুর নিযে যাবে, আমি যাবো ।

আমি বলবোনা, আমার এই পথ চলাতেই আনন্দ । পথের অনেক চড়াই-উৎরাই থাকে, আমি জানি তাও । কি শেখাবে আমায় তুমি ? ফেলে যেতে চাও আধেক পথে, তাও নেবো মেনে । আরো অযুত মানব-মানবীর মতো আমিও তো এক পথভ্রান্ত । হাটছি সেই অনাদিকাল থেকে ধূসর পৃথিবীর পথে ।

এ পথের শেষ কোথায়, কোনখানে ? নিজেকে আমি অনেক সময় ঠিক বুঝে উঠতে পারিনে । ভেতরের এক মানুষ বলে, এইদিকে; অন্যজন বলে- হেথা নয় হেথা নয় অন্য কোনখানে । আমি কি পথ হারিযেছি ! আমাকে যে পথের দিশা ঠিক রাখতে হবে ! কিন্তু আমার যে উপায় নেই । তাই দিনগুলো ভরে তুলতে হয় , সুতোর বুনটে বুনটে ভরে তুলতে হয় ফাঁক-ফোকরগুলি । রীফু করতে হয় জীবন ।

অথচ দিনগুলো ফুরিয়ে যেতে চায়না যেন । কেন ফুরোয় না ! রাতটা শুধু আমার জন্যে প্রতীক্ষায় থাকে কখোন ফিরে আসি তার কাছে । যে রাত চাঁদ দেখেনা কোনওদিন, লক্ষ্য যোজন পেড়িয়ে যে অন্ধকার রাত নক্ষত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে আসে আমি তার চোখে চোখ রাখি তখোন । নিকষ অন্ধকারে দুরে দৃষ্টি ছড়িয়ে দিলে মনে হয়, “দুর হ্যায় কিনারা/ গহেরী নদীও কি ধারা / টুটি তেরী নাইয়া/ মাঝি……………” কেন যে মাঝেমাঝে মোনটা এমোন উদাস হয়ে পড়ে, ভারী হয়ে ওঠে চোখের কোন । এখোন এই ত্রিশের কাছাকাছি বয়সে এসে মনে হলো অনেকের মতো সুশান্তকেও হয়তো আমার ভুলে যাওয়া ভালো ।

এমোন নয় যে সুশান্ত দেখতে খারাপ বা তার অনেক দোষ । ওর মতো গুনধর যে আর কোনটি নেই কিম্বা ওর মতো গুছিয়ে কথা বলতে পারার ও যে কেউ নেই এটা ভাবাও হয়তো বোকামী । সে যে একজন অসাধারন পুরুষ, এমোনটি আর পাওয়া যাবেনা, তাও নয় । তাই সুশান্তকে ভুলে যাওয়াই ভালো । কিন্তু বলা যতো সহজ, করে ওঠা ততোটা নয় ।

আশ্চর্য্য, যতোই চেষ্টা করি ভুলে থাকার ততোই সে যেন আমার মনের ভেতরে ঢোকার জন্যে ছটফট করতে থাকে । তখন আমি এই সুন্দর সকাল, ঝকঝকে রোদ্দুরে ভরা দুপুরগুলি হাতে নিয়ে খেলতে থাকি । বেলা গড়িয়ে যায় রাতে, ভোলার বদলে আমি টুকরোটাকরা কথাগুলো, কাছের মুখগুলো নিয়ে আবার নতুন করে খেলা পেতে বসি । (চলবে..... অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন) ধারাবাহিকতা রক্ষার খাতিরে আপনাদের সুবিধার জন্যে তৃতীয় অধ্যায় / (প্রথম অংশ) নীচে দিয়ে দিলুম .. শুদ্ধতম পরকীয়া (উপন্যাসিকা) তৃতীয় অধ্যায় / (প্রথম অংশ ) । ।

পেয়ার কে লিয়ে, চারও পল্ কম নহী থে কভী হম্ নহী থে, কভী তুম্ নহী থে । । কার কথা দিয়ে যে শুরু করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা । অনেকের কথা দিয়েই শুরু করা যায় । সুশান্তকে দিয়ে আরম্ভ করতে পারলে হয়তো ভালো হ’তো ।

কিন্তু তাহলে যে অনেক পেছন থেকে শুরু করতে হয় । সুশান্ত আমার কে, এ কথা তো উঠবেই । কেমন করেই বা ওর সাথে আমার দেখা আর তার থেকে পরিচয় এসব কথা ঘুরে ফিরে আসবেই । আমি যে আসলে গিয়েছিলাম ডাঃ ওয়াদুদ সাহেবের কাছে এ কথাও আমাকে বলতে হবে । তার’চে নিজের কথা দিয়েই শুরু করা নিরাপদ আর ভালো তো বটেই ।

আমি নভেরা । নভেরা কবির । কবির আমার বাবার নাম । নভেরা শব্দের ঠিক অর্থটি আমার জানা নেই । হাতের কাছে যে অভিধানগুলো আছে তাতে খুঁজে খুঁজে নভেরা শব্দটি পাইনি ।

কাছাকাছি যা পেয়েছি তার একটি “নবোঢ়া” অর্থাৎ নববধূ বা নতুন বৌ । আর একটি হলো “নভোরজঃ” মানে কুয়াশা । প্রথমটি হতে আমার বয়েই গেছে ! দ্বিতীয়টিই আমার পছন্দ । একটা অস্পষ্ট ভাব আছে তার, কুয়াশা বললেই একটা অস্পষ্টতা, একটা রহস্যময়তা বোঝায় যেন । এই অর্থটি আমার কাছে ভালোলাগার কারন কি, আমি নিজেই নিজের কাছে অস্পষ্ট, তাই ? এটা নিয়ে আমি অনেক ভেবেছি ।

কুলকিনারা পাইনি । তবে ধারে কাছের সবাই বলে আমাকে নাকি ঠিক বোঝা যায়না । কেন বলে বুঝিনা । দিব্যি সবার সাথে জম্পেশ করে মিশছি, আড্ডা দিচ্ছি, মুখ গোমড়া করে রাখিনি কখোনও । আমার প্রচুর বন্ধু ।

কারো সাথে বন্ধুত্ব বিলোতে আমি কার্পন্য করিনা । পৃথিবীর পথে পথে যেথায় যেটুকু আনন্দ ছড়ানো আছে আমি তা দু’হাত ভরে তুলি । ফাল্গুনে যেমন আমগাছ মুকলে মুকুলে ছেয়ে যায়, তারপর ধীরে ধীরে গর্ভবতী হয়ে নুয়ে পড়ে ভারে, আমিও তেমনি অজস্র আনন্দে ছেয়ে তুলি মনের আকাশ । সুখের গর্ভসঞ্চারে টৈ-টুম্বুর থাকি সারাক্ষন । রাতের নির্জনে একাকী নত হই গর্ভসঞ্চারের ভারে ।

তখোন একটু দুঃখও কি থাকে সেখানে । অনেক কথা একসাথে ভীড় করে আসে যা ভুলে যাওয়া দরকার । ঘটনাগুলো যে নোংরা বা বিচ্ছিরি ধরনের কিছু এমোনটা নয় । আবার তা এমোনও নয় যে ঠেলে সরিয়ে দিলেই সাফ হয়ে গেল জঞ্জাল । আমরা তো জীবনের অজস্র কথার অনেক কিছুই ভুলে যাই ।

সব কথা কি আমাদের মনে থাকে ! কিছু কিছু হয়তো থাকে যাদের তাড়াতে গেলেও আবার ঘুরে ফিরে চলে আসে না চাইতেও । কে জানে, আমার মনে কি থাকে ! তবে আমার যে একটা অসুখ আছে ! এরকম অসুখ যে আর কারো হয়না এমোন নয় । পঁচিশ বছর বয়সে এসে তাই আমার প্রথম মনে হয়েছিলো, অনেক কথাই আমার ভুলে যাওয়া উচিৎ । আমার বয়েস এখোন ত্রিশ ছুঁইছুঁই । এই যাহঃ, বয়েসের কথা বলে ফেললাম ।

মেয়েদের নাকি বয়েস বলতে নেই । আমার এক দুর সম্পর্কের ফুপু প্রায়ই নসিহৎ করতেন - “ এই মেয়ে, কাউকে তোর বয়স বলেছিস ? খবরদার কাউকে নিজের বয়স বলবিনা কখোনও । ” - “বয়স বললে কি হয়, ফুপু ? মরে যাবো তাড়াতাড়ি ?” - “তুই তো বড় ফুঁচকে মেয়ে । এতো কথায় তোর কাজ কি !” বলেছি “বলবিনা, বলবিনা – ব্যাস । “ মেয়েরা নিজেদের বয়েস কেন বলতে চায়না, আমি বুঝিনা ।

আমার মধ্যে কোনও লুকোচুরি নেই । আমার ছোটখাটো আকারের মা’টি এজন্যে কেমন একটা ভয়ে ভয়ে থাকেন আমাকে নিয়ে । লোকে বলে আমার মায়ের মুখটি নাকি আমার মুখে বসানো । ভরন্ত মুখ, নাকের ছাঁদ গ্রীকদের মতো, ভুমধ্যসাগরের মতো নীল চোখ, নীচের ঠোটখানা খানিকটা ভারী হলেও মানিয়ে গেছে মুখের জমিনে । আমার তড়বড়ে স্বভাবের কারনে মা আমাকে তেমন পছন্দ করেন না ।

মেয়েরা থাকবে শান্ত শিষ্ট, এই তার ধারনা । ফলে আমি যা ই করি না কেন একটা দোষ ধরা পরবেই তার কাছে । তবে আমার একটা অসুখ আছে বলেই সম্ভবতঃ আমার বাবা আমার কোনকিছুতেই বাঁধ সাধেন না । বাবাকে আমি এজন্যে বেশী পছন্দ করি । শক্তসমর্থ শরীর তার, বয়েসের তুলনায় অনেক নবীন মনে হয় তাকে ।

শীলা যে ভদ্রলোকটির সাথে চুটিয়ে প্রেম প্রেম খেলা খেলছে অনেকটা তারই মতো । ওহ হো, শীলার কথা বলা হয়নি আপনাদের । শীলা আমার স্কুল জীবনের বন্ধু, বাসাও ছিলো একই পাড়াতে । সবচেয়ে কাছের । দু’টি ভিন্নবৃন্তের কুসুম হলেও, একপূজারীর হাতে একই থালায় আছি এখোন ।

হরিহর আত্মা । আমার হেন কিছু নেই যা শীলার অজানা । শীলারও কিছু বাকী নেই আমার জানার । তবে ইদানিং শীলাকে বুঝতে আমার খানিকটা কেমন কেমন যেন হয়ে যাচ্ছে । আমি গেলেই আমার দিকে খুব ঘনঘন তাকিয়ে দেখছে ।

বাদ দেন, শীলার কথা থাক্ এখোন । বলছিলাম বাবার কথা, আর কি প্রসঙ্গ তুললাম । ঐ আমার আর এক দোষ । এক কথা বলতে গিয়ে আর এক কথা বলে ফেলা । আমার বাবা নিয়মিত জগিং করেন ।

না করে উপায় নেই, ডাক্তার বলেছেন যে । প্রশস্ত কপাল, জুলফিতে শুভ্রতার উঁকিঝুকি আছে, লনের ছাঁটা ঘাসের মতো সাদাকালোয় মেশানো দাঁড়ির কারনে মুখটা ভরাট দেখায় । কালো চোখ, সাদা জমিনে হালকা লাল লাল ছোপ । বয়সের কারন আর কোলেষ্টেরল । আমি মাঝে মাঝে তার মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকি নির্বোধের মতো ।

কিছু একটা খুঁজতে চেষ্টা করি । যা দেখতে চাই তা পাইনা । বাবা আমাকে দেখলেই হাসি হাসি মুখ করে রাখেন । বলেন – কি রে মা, কিছু বলবি মনে হচ্ছে ! - নাহ, কি বলবো বাবা । - তাহলে ওমোন করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছিস কেন ? লজ্জা পেয়ে যাই ।

একথা কি বলা যায়, যা খুঁজছি বা যা তোমার মুখে থাকার কথা; তা নেই কেন ? অথচ আমার মা আবার অন্যরকম । কেমন ভাবে যে আমার দিকে তাকিয়ে থাকেন সারাক্ষন । বয়স হয়ে যাচ্ছে অথচ বিয়ে হচ্ছেনা আমার, এই চিন্তা থেকে হয়তো । পৃথিবীর সব মা’য়েরাই বোধহয় আমার মায়ের মতো । ঘরে আইবুড়ো মেয়ে থাকলেই যতো রাজ্যের দুঃশ্চিন্তা মুখের মধ্যে ঝুলিয়ে বসে থাকেন, আবার তার উপর সে মেয়ের যদি কোনও না কোনও রোগ থাকে ।

............... ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।