‘কোথায় স্বর্গ কোথায় নরক, কে বলে তা বহুদূর; মানুষের মাঝে স্বর্গ-নরক, মানুষেতে সুরাসুর।
“সুজন মিয়া, আইজকা তো তোমার কপাল খুলছে !” জলিল সাহেবের কথা শুনে একটু অবাক হয় সুজন। জিজ্ঞাসা করে “কেন ম্যানেজার সাব কি হইসে ?” “আরে মিয়া হুনলাম আইজ চৌধুরী সাহেব সপরিবারে আইব সার্কাস দেখতে, উনি বড়ই দিলদরিয়া মানুষ, খুশি করতে পারলে একেবারে চোখ বন্ধ কইরা মোটা অংকের বখশিশ পাইবা মিয়া !” বখশিশের কথা শুনে সুজন মনে মনে খুশি হয়ে ওঠে। কারণ সুজনের জন্য বেঁচে থাকার অর্থ হচ্ছে টাকা কামাই করা, যে টাকা দিয়ে তার মায়ের অন্নসংস্থান হবে, ব্যাস। সার্কাসের জোকারদের তো আর সুন্দরী স্ত্রী আর ঘর ভর্তি বাচ্চাকাচ্চার কল্পনা করা মানায় না।
সেই জন্যই সুজনের জগতটা খুবই ছোট এবং সেই জগতের বাসিন্দা মাত্র দুইজন , সুজন আর তার মা ।
রাতে শুয়ে শুয়ে সুজন চিন্তা করে বড় একটা বাড়ি বানাবে মায়ের জন্য। সেই বাড়ির সব চাবির গোছা থাকবে মায়ের শাড়ির আঁচলে বাঁধা। মা হাঁটবে আর ঝনঝন করে শব্দ হবে। অনেকগুলো কাজের লোক থাকবে আর তারা শুধু মায়ের আদেশ পালন করবে।
মা’র নিজ হাতে কিছুই করা লাগবে না । মা শুধু খাবে, ঘুমাবে আর নামাজ পরে সুজনের জন্য দোয়া করবে। ভাবতে ভাবতে সুজনের চোখে ঘুম নেমে আসে কিন্তু সুজনের কল্পনাগুলো আর বাস্তবে নেমে আসে না। না আসুক তাতে কি ? ঐ কল্পনা করার সময় টুকুতে সুজন যে সুখে আর আনন্দে মোহাবিষ্ট হয়ে থাকে সেটা তো আর মিথ্যা না।
জন্মের দুই মাস পরেই সুজনের বাবা সুজনদের রেখে চলে যায়।
এটা অবশ্য চরাঞ্চলে মানে সুজনদের গ্রামে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। পুরুষেরা কাজের প্রয়োজনে আসে, তারপর বিয়ে করে বংশবিস্তার করে একদিন উধাও হয়ে যায়। সেজন্য সুজনের বাবা নেই এটা কোন বড় সমস্যা ছিল না। সমস্যাটা শুরু হয় যখন সুজনের বয়স সাত আট হয়। আস্তে আস্তে স্পষ্ট হতে শুরু করে সুজন সমবয়সী আর দশজনের চেয়ে উচ্চতায় বেশ ছোট ।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সুজন অন্যদের তুলনায় আরও ছোট হতে থাকে। সুজনের ভাগ্যে জোটে ‘বাটুল’ উপাধি আর গ্রামের মানুষ বলাবলি করতে থাকে সুজনের মা নিশ্চয়ই কোন আকাম কুকাম করছে এই জন্য শাস্তি হিসেবে সুজন ‘বাটুল’ হইছে।
খেলাধুলায় যে দলে সুজন থাকত সেই দল হারলে ঐ হারের পুরো কৃতিত্ব সুজনকে বহন করতে হত এবং সুজনের দল বেশিরভাগ সময় হারত বলে অল্পদিনেই সুজন ‘কুফা’ হিসেবে বেশ সুনাম(!) অর্জন করে। তাই বাল্যকালের সুখস্মৃতি বলতে সুজনের শুধু তার মায়ের কথাই মনে আসে। হালিমা বেগম এত কিছুর পরেও সবসময় তার ছেলেকে আগলে রেখেছেন।
সুজন যতদিন বাড়িতে থাকত কোনোদিনই তাকে নিজের হাতে খেতে হয় নি। সুজন একবার মাকে জিজ্ঞাসা করেছিল “মা, আল্লায় আমারে ছোট বানাইছে কেন? আমি কি দুষ করছি ?” জবাবে হালিমা বলেছিল “শোন বাপ, আল্লায় দেখছে যে আমাগোর তো বেশি টেকা পয়সা নাই, তাই তুই বড় হইয়া গেলে আবার জামা কাপড় বানাইতে হইব এই জন্য তোরে আর বড় করে নাই! বুঝছস পাগল। ” ছোট ছিল বলে সেদিন আল্লাহর উপর খুব খুশি হয়েছিল সুজন কিন্তু আজকাল আর মিথ্যা সান্ত্বনায় খুশি হতে পারে না সে, খুব অভিমান হয় স্রষ্টার উপর।
সুজনের বয়স যখন চৌদ্দ পনের তখন প্রথম সুজন একটা চায়ের দোকানে কাজ করতে যায়। দোকানের মালিক সুজনকে অতিরিক্ত ‘স্নেহ’ করতেন।
একটা চায়ের কাপ ভাঙ্গলে অন্যদের জন্য একটা আর সুজনের জন্য অন্তত চারটা চড় বরাদ্দ ছিল ! সুতরাং খুব বেশিদিন সুজন সেখানে কাজ করতে পারল না। এরপর আরও দুই তিন জায়গায় সুজনের একই রকম বা তার চেয়েও খারাপ অভিজ্ঞতা হল। অবশেষে সুজন ‘দি নিউ নুরজাহান সার্কাস’ এর মালিক জলিল মিয়ার নজরে পড়ল। কিছুদিন আগেই ঐ সার্কাসের জোকার মানিক মারা যাওয়ায় জলিল মিয়া মনে মনে সুজনের মতই কাউকে খুঁজছিলেন। প্রথম প্রথম হালিমা বেগম ছেলেকে ছাড়া থাকতে রাজি ছিল না ।
কিন্তু সবার উপরে পেট তাই হালিমা বেগমের হাতে তেমন বিকল্পও ছিল না। শুরু হল সুজনের জোকার জীবন।
জোকার হিসেবে অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সুজন বেশ নাম কামিয়ে ফেলল। কারণ সুজন এমন একটা ‘হাউমাউ কান্না’ রপ্ত করেছে যে যেটা দেখে হাসি চাপিয়ে রাখতে পারবে এমন সাধ্য কার? ধীরে ধীরে ‘দি নিউ নুরজাহান সার্কাস’ আর সুজনের ‘হাউমাউ কান্না’ সমার্থক হয়ে উঠল। সার্কাসের বাঘ, বানর বা হাতি ছাড়া হয়ত শো চললেও চলতে পারে কিন্তু সুজনকে ছাড়া সার্কাস অসম্ভব।
দুধের শিশু, ঘরের গৃহবধূ , মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধ সকলের কাছেই সুজন সমান জনপ্রিয়। আর জলিল মিয়া পাকা ব্যবসায়ী , সার্কাসের জন্য সুজন কতটা দরকারি সেটা তিনি জানতেন বলেই সুজনকে একটু আলাদা নজরেই দেখতেন তিনি।
চৌধুরী সাহেবের বখশিশের কথা চিন্তা করে সুজন একটু বাড়তি উৎসাহ নিয়েই জোকারের মেকআপ নিতে থাকে আর মনে মনে চিন্তা করতে থাকে বখশিশ পেলে মায়ের জন্য একটা দামি দেখে জামদানি শাড়ি কিনবে সে। সুজনের মন আনন্দে বিভোর হয়। ইতিমধ্যে সার্কাস শুরু হয়ে গেছে ,দর্শকদের হর্ষ ধ্বনি ভেসে আসে সুজনের কানে।
সে মনে মনে ঠিক করে নেয় আজকে এমন কান্নাকাটি করবে যেন হাসতে হাসতে চৌধুরী সাহেবের নাড়ীভুঁড়ি উল্টে আসে।
সুজন যখন তার মায়ের মৃত্যু সংবাদটা পায় তখন মাইকে তার নাম ঘোষণা করা হয়ে গেছে। অনুভুতিশুন্য সুজন আস্তে আস্তে মঞ্চের মাঝখানে যেয়ে দাঁড়ায়। নিস্পলক চোখে দর্শকদের দিকে ঘুরে ঘুরে তাকায়। জামদানী শাড়ি কেনার কথা ছিল কিন্তু এখন কাফনের সাদা কাপড় কিনতে হবে ভেবে মা’র উপর খুব অভিমান হয় সুজনের।
মা’র সাথে টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি ভেসে ওঠে সুজনের মনে । তারপর জমাট বাঁধা কষ্টগুলো হঠাৎ করে হাউমাউ কান্না হয়ে বেরিয়ে আসে। সেই বিখ্যাত ‘হাউমাউ কান্না’ । সুজনের কান্নার শব্দের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে দর্শকদের হাসির শব্দ। সুজনের হাউমাউ কান্নায় মুগ্ধ চৌধুরী সাহেব হাসতে হাসতে বলে ওঠেন “শালা, কত বড় জোকার !”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।