চমৎকার রোদ ভড়া সকালে রেডক্লিফ জেটিতে গিয়ে যখন দাড়ালাম আমরা তখনও চেকইনের আধা ঘন্টা বাকি। উত্তেজনায় ক্লিফ সাত সকালে উঠে রেডি হয়ে বসে আছে। কি আর করা সকাল ৯। ৩০শে চেকইন হলেও ৯টায় গিয়ে পৌছালাম জেটিতে।
বোটের পাশে দাড়িয়ে দাড়িয়ে সময় মারতে গিয়ে সাগর থেকে আসা ঠান্ডা বাতাসে জমে যাচ্ছিলাম আমরা।
যদিও শীত কমে এসেছে তবু সকালের সাগড়ের ঠান্ডা বাতাস হাড়ে কঁাপন ধরিয়ে দিল।
ক্লিফ ঠান্ডা কাটাতে চ্যানেল নাইনের টুডে মর্নিং শোর টি হয়ে পোজ দিতে থাকল আমাকে
জীবনে প্রথম তিমি দেখব....উত্তেজনা আমারও কম কিছু নয়। ৯। ৩০শে বোটে চেকইন করেই ক্যমেরা নিয়ে যা খুশি তাই তুলতে থাকলাম। জিবন্ত তিমি না পেয়ে বোটে রাখা সফ্ট টয়ের ছবি তুললাম
মনে মনে ছটফট করি আর ভাবি সত্যই কি তিমি গুলো আমাদের কাছে এসে নাচা নাচি করবে যেমন বিঙ্গাপনে বলা আছে? ভাবতেই গা রিনরিন করে সত্যিকারে তিমি দেখব, টেলিভিশনে নয় একেবারে সত্যি!
জুন থেকে নভেম্বর পর্যন্ত এখানে তিমি দেখবার সময়।
আটলান্টিক থেকে তিমিরা উষ্ণ স্রোতে গা ভাসিয়ে সঙ্গি খুজে প্রেম করতে আর বাচ্চা পাড়তে আসে উষ্ণ পানির দেশে। বাচ্চা প্রসব করতে আর নিউবর্ন দের জিইয়ে রেখে একটু বড় করে তুলতে ওদের উষ্ণতার দরকার হয়, আর তাই এত দুরদেশে মাইগ্রেট করে আসে বছরের এই সময়টায়। বাচ্চারা একটু বড় হলেই আবার ফিরে যায় ঠান্ডা পানির দেশে।
রেডক্লিফ থেকে ঘন্টা দেড়েকের পানি পথ খোলা সাগরে পৌছুতে। আমার সি সিকনেস নেই বলেই জানি।
আগে একবার সমুদ্র অভিজানে যাবার অভিঙ্গতা আছে ৪ দিনের জন্য। তবে অনেক বড় শিপ ছিল ওটা। ৪,০০০ প্যাসেঞ্জার কেবিন ছিল ওটায়। ছিল মুভি থিয়েটার থেকে ওয়াটার থীম পার্ক পর্যন্ত অনেক কিছুই। সেবার কোন সিকনেস ফিল করিনি তাই খুবই কনফিডেন্ট ছিলাম এবারের সাগর সফরের ব্যপারে , তাই যখন ক্রুরা সি সিকনেস মেডিসিন বিক্রি করতে এল গর্ব করে হেসে বললাম আমার সি সিকনেস নেই।
এবারের এটা তে আমালাদা কোন কেবিন নেই, প্যাসেন্জার সিটিং এ্যরেন্জমেন্ট তিন লেভেলের তিন/চার তলার ছোট্ট বোটে।
খোলা সাগরেরর পথে রওনা দিয়ে উত্তেজনায় তিমি না পেয়ে সি-গালের সাগর ছুয়ে মাছ ধরা,
পেলিক্যানের রোদ পোহানো আর কিছু কার্গো শিপের ছবি তুলে সময় কাটাচ্ছিলাম।
সাগরের সাদা ফেনার খেলা দেখতে দেখতে যখন পেটে বড় রকমের একটা দোলা অনুভব করলাম জানলাম আমরা খোলা সাগরে পরতে চলেছি।
মর্টন আইল্যান্ড কে পাশ কাটিয়ে চলেছি আমরা। এই মর্টন আইল্যান্ডটি বালুর তৈরি।
কোথাও সাদা বালু কোথাও লালবালু চমৎকার কন্ট্রাস্ট তৈরি করেছে সবুজে লতা আর গাছের মাঝ দিয়ে, চমৎকার আইল্যান্ড ক্যাম্পিং এর জন্য।
মর্টন আইল্যান্ড পেরিয়ে অল্পক্ষনেই আমরা ঝপাত করেই খোলা সাগরে এসে পরলাম। এখানে সাগরের দোলায় আমাদের ছোট্ট বোট টা অথই সাগরে কলার মোচার খোলার মতন উথাল পাথাল দুলতে থাকলো তা'থই তা'থই করে। আমরা অবশেষে খোলা প্যাসিফিক সিতে পৌছালাম....সাগরে রোদের আলো পরে চমৎকার এক দেখবার মতন ব্যপার হয়েছে। দিগন্ত ছুয়ে কোন থই নেই কোথাও।
মনে শুধু একটাই শব্দ এলো - "অসাধারন"!
কোন কিছু ধরেও সোজা দাড়িয়ে থাকা দায় হয়ে দাড়াল ঢেউয়ের দোলায়। আমরা দুরে দেখতে পালাম তিমিরা পানি ছিটিয়ে খেলা করছে।
সবাইকে উপরের খোলা ডেকে যাবার ডাক পরল। এটা সেটা ধরে দুলতে দুলতে আমরা ডেকে গিয়ে দাড়ালাম।
হঠাৎ করেই যেন আমাদের সামনে পিছনে ডাইনে বায়ে যেদিকে তাকাই শুধুই তিমিদের জলকেলি চোখে পরতে থাকল।
পুরুষ তিমি মেয়ে তিমিকে পানি ছিটিয়ে প্রেম নিবেদন করে পটাবার বিরামহীন চেষ্টা চালাচ্ছে।
দুজন মিলে হুটোপুটি করছে, হুস করে ভেসে উঠেই আবার সাথে সাথেই ডাইভ দিয়ে গভিরে তলিয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষনের জন্য, আবারও ভেসে উঠে পুরুষ পানি ছিটিয়ে মেয়েটিকে টিজ করছে । কি অপরুপ দৃশ্য!
ধুসর পিঠ, নিলচে সাদা পেটের আর সাদা ডানার তিমিরা চারিদিকে প্রেম-উৎসবে মত্ত।
এর মাঝে আমরা যখন আরো গভির সাগরের পথে রওনা দেব তখনই এক দম্পতি হুস
করে বিশাল বিশাল দেহ নিয়ে একদম বোটের ১০ হাতের ভেতর ভেসে উঠে ডানা নেরে আমাদের যেন বিদায় জানাল আর লেজ ঝাপটিয়ে চলে গেল গভিরে।
আমরা যতই খোলা সাগরে যেতে থাকলাম ততই আমাদের বোট টা যেন আরো জোড়া দোলা দিতে থাকলো।
ডেকে দাড়িয়ে আমার মনে হলো আমার সারা পেট দোলায় দোলায় বেরিয়ে আসবে যেকোন সময়। মনে মনে ভাবি এত গর্ব করে সি সিকনেস মেডিসিন ফিরিয়ে দিলাম , বমি করার অদম্য ও আকুল ইচ্ছেটাকে সমস্ত শরীর দিয়ে দমানোর চেষ্টা চালাতে থাকলাম। এর মাঝে আমাদের লাঞ্চের ডাক পরল নিচে। সাগরের পানির নাচানাচির সাথে সাথে আমার পেটের নাচানাচিতে আমার তখন এই সেই অবস্থা । যে কোন মুহুর্তে সব বেড়িয়ে আসার আসংকা ।
এর উপর খাওয়া পেটে ঢোকাবো কি করে সেই চিন্তায় পরলাম, এদিকে পেটে খিদের চোটে ছুচোও ছুটছে। খাবার নিলাম কম করেই কিন্তু খিদের চোটে আবারও নিলাম। আরো খোলা সাগরে চলে যাওয়ায় দুলুনি আরো বেড়ে গেছে, মনে হচ্ছিল যা খেলাম সব এখনই বেরিয়ে আসবে । আবারও ডাক পড়ল উপরের ডেকে আরো তিমি দেখতে। আমি বমি থামানোর চেষ্টা করতে করতে উপরে গেলাম এই অপুর্ব দৃশ্য মিস না করার জন্য।
এবার আরো জোরে আমার পেট মোচর দিয়ে আপত্তি জানালো কঠিন ভাবে। মনে হলো মানুষ জনের গায়ের উপরই বমিটা হয়ে যাবে। এর মাঝে আরো একঝাক তিমি দেখে মনটা অন্য দিকে গেল। হঠাৎ কোথা থেকে এক ঝাক ডলফিন লুটোপুটি করতে করতে তিমিদের মাঝে এসে পরল। এদিক সেদিক লাফিয়ে ঝাপিয়ে দুষ্টুমি করতে করতে ওরা আরেক দিকে চলে গেল,
সেই সাথে ছেলে তিমিটা দুবার ভুষভুষ করে পানি ছিটিয়ে সঙ্গিনী কে ইম্প্রেস করতে উল্টিয়ে পাল্টিয়ে দু তিনটে ডিগবাজি দিয়ে ফেলল ।
ওদের এই নাচানাচি আর প্রেমলীলা দেখে আমার এযাত্রা বমি করারা প্রবল চাপটা বন্ধ হলো কোন রকমে বাবা কি বাঁচা বাঁচলাম
ফেরার জন্য নিচে নামতেই এক ক্রু এসে দেড় কেজির মতন টাইগার প্রন দিয়ে গেল আমাদের টেবিলে। পেটে তখনও আমার খিদে, আমি আর ক্লিফ পাশের জানালা দিয়ে তিমির নাচা নাচি দেখতে দেখতে দেড় কেজি টাইগার প্রন সবার করে দিলাম
ফিরতি পথে আবারও সাগর আর দু একটা বড় শিপ দেখতে দেখতে দুরে ব্রিসবেন পোর্ট চোখে পরলো আর তা পেরিয়েই ব্রিসবেন সিটি আর আমাদের রেড ক্লিফ বিচের রেখা চোখের আয়তায় এল, দেখতে পেলাম আমাদের বিলডিংটা।
ফেরার সময় বার বার মনে হলো আমি সেই ক'জন ভাগ্যবানদের একজন যারা নিজের চোখে সত্যিকারের তিমির প্রেম, বিয়ে, বাচ্চা কাহিনি দেখবার সুযোগ পেয়েছে এই পৃথিবীতে। কৃতঙ্গতা সৃস্টিকর্তাকে এত বড় অভিঙ্গতা পাবার সুযোগ করে দেবার জন্য জীবনে, তাই আপনারা যারা দেখেন নাই এখনও তাদের সাথে শেয়ার করলাম আমার এই দুর্লভ অভিঙ্গতা।
বাড়ি ফিরেই আবারও খিদে পেয়ে গেল সাগরের বাতাসের ছোয়ায়, যদিও আমি থাকিই সাগরের পাড়ে তাই সব সময় খিদে পেয়েই থাকে।
বানালাম স্টেক উইথ ভেজিটেবল। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।