আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ইস্কুল পর্ব-১

চারপাশে আত্মমুগ্ধ আদিমতাবোধ, আর গ্রন্থিবদ্ধ চিন্তা; সেখান থেকে মুক্তির পথ খুঁজি... টিফিন প্রিয়ড। শেষমুহুর্ত। বারান্দায় দশম শ্রেনীর সামনে উল্টোদিক করা বেঞ্চে তিনজন বসে। রাসেল-রিঙকু-মৃদুল। বুদ্ধি প্রকৌশলী অফ ক্লাস টেন।

বেঞ্চটিতে লো-বেঞ্চে পা রেখে হাই-বেঞ্চে বসতে সুবিধা, ওরাই করে নিয়েছে। প্রায় ভাবলেশহীন তিনজন। তবে তিনজন যে খুব জটিল সিদ্ধান্তে পৌছেছে, ওদের যারা চেনে তারা নিশ্চিত হবে। ছাত্র-ছাত্রীদের কারো কোন দিকে লক্ষ্য নেই। রাসেল রিঙকু ও মৃদুলের দিকে তাকালো, একটু অর্থপূর্ণ দৃষ্টি।

তিনজনের দেহে টান পড়লো যেন। ক্লাস এইটের ছেলেরা মাঠে ক্রিকেট খেলছে। ওদের হৈ হল্লার আওয়াজ ভেসে আসছে। নাইন-টেনের অন্যান্য ছেলে-মেয়েরা বিভিন্ন জায়গাতে জটলা করছে। টিউবয়েলের পাড়ে মেয়েদের ভিড়টা বেশি।

মালতি পিসিকে জগ ভরে পানি নিতে দেখা গেল। বড় আপার রুম ক্লাস টেনের দক্ষিন পাশে, মাঝে ছ্টো একটা করিডোর। হঠাৎ লাইব্রেরী থেকে মফিজ স্যার বেড়িয়ে এলেন, তিনি এগিয়ে আসছেন সম্ভবত বড় আপার রুমের উদ্দেশ্যে। রিঙকু গা এলিয়ে দিল, একটু যেন হতাশ। মফিজ স্যার বড় আপার বন্ধ দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

দরজার উপরে লাল বাতিটা জ্বলছে। স্কুলে হারামের তালিকার এক নম্বর বড় আপার লালবাতি। টিফিনের বেল পড়ার কিছুক্ষন পর বড় আপার দরজার উপরে লালবাতিটা জ্বলে ওঠে। অর্থৎ ডোন্ট ডিস্টার্ব মি। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ।

মফিজ স্যার ঘুরে দাড়ালেন, তারপর পা বাড়ালেন বকুল গাছটার দিকে। তাঁর নিকোটিনের তেষ্টা পেয়েছে। আবার চারপাশ স্বভাবিক। কেউ কারোদিকে তাকানোর ফুরসত নেই। সবাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

মাঠের এক পাশে বড় আমগাছের নিচে মেয়েদের কয়েকটি গ্রুপ আড্ডা মারছে। তাদের একটু দূরে নাইন-টেনের উঠতি রোমিওরা দৃষ্টি আকর্ষনের চেষ্টা করছে নিরলস। এই মুহুর্তে মৃদুলের চোখ আরও সতর্ক, সে ঘড়ি দেখলো। খুব ভালোভাবে খেয়াল করলে বোঝা যাবে, ওদের তিনজনের উত্তেজনা এখন সর্বোচ্চ। এমনি সময়।

হঠাৎ। কেউ কিছুমাত্র তাকিয়ে দেখেনি ঘটনাটি। ওরা মাত্র তিনজনই। সাঁ-করে বেঞ্চটি বড় আপার দরজার সামনে নিয়ে গেল এবং ফিরে এলো। মাত্র কয়েক সেকেন্ড।

তারপর লালবাতিটি দেখাগেল না। *** ক্লাস টেন। টিফিন প্রিয়ড শেষে ক্লাসের ঘন্টা পড়েছে। মফিজ স্যারের ক্লাস। স্যারের আসতে দেরী হচ্ছে।

ক্লাসে হৈ-হল্লা। পেছন দিক থেকে একজন অপরকে বলছে, 'ওই হিটলার, আমার খাতাডা দ্যাখছোস?' 'তর খাতা! কি ক'স ব্যাটা? আমি দেখমু ক্যামনে?' 'সত্য কইতাছস তো?' 'হ-ব-ব্যাটা, সত্য' 'খাতাডা পাইতাছি না' ক্লাসের হল্লায় আরো এক কন্ঠ জোড়ে শোনা গেল। 'কিরে মনজ, আমাগো এলাকায় আহস্ না ক্যা?' 'তরাও তো আহস্ না?' 'ওই হারামী। হেই দিন না গেলাম। ' 'হ হেই কব্বে গ্যসোছ।

অহনো মনে আছে নাকি?' 'কাইল আহিস্। মজা পাবি বেটা। ' এমনি সময় সবাই একটু অন্যদিকে আগ্রহ দেখায়। মফিজ স্যার আসছে। থার্ড বেঞ্চের পন্ডিত, বাবুর সাথে সবাই ছড়াকাটে, ''কাচামরিচ ধইন্যা পাতা মফিজ স্যারের টাক্কু মাথা।

টাক্কু মাথা ফাটে না মলম দিলে সারে না। '' এর মধ্যে মফিজ স্যার কাছে চলে এসেছেন। ছাত্ররা কথা পাল্টায়। ''মফিজ স্যার যেখানে আমরা আছি সেখানে মফিজ স্যারের আগমন শুভেচ্ছা স্বাগতম। '' মফিজ স্যার হাত তুলে নেতার মতো ক্লাসে প্রবেশ করেন।

তারপর হাত নাচিয়ে বলেন, ' চোপ। চোপ। চোপ । তরা বসি ফর; বসি ফর। অক্ষনো তরা ছুডো মানহুস আছত।

বেগ্যেনে ছুডো মানহুস। বসি ফর, বসি ফর। ' হৈ-চৈয়ে একটু ভাটা পড়লো। মেয়েরা চুপচাপ। 'তরা বেগ্যেনে আছত নি।

' 'জী স্যার' 'পালাছ নাই তো' 'না স্যার। ' 'অক্ষণ আমি রোলকল করমু। ' 'করেন স্যার' মফিজ স্যার দ্বিতীয় বারের রোলকল সারলেন। চশমাটি নাকের ডগায় বসিয়ে গলা ঠিক করে নিলেন। 'রিঙকু-মনজ-বাবু' 'জী স্যার' 'ইয়েস স্যার' 'জী স্যার' 'তরা দাড়া।

হিটলার-রাসেল-মিদুল-রনি, তরাও দাড়া। ' 'ক্যান স্যার' 'কন স্যার' 'তরা জানস নি, আইজ্জা তগো বড় আফার লালবাত্তি চুরি হইগেছে। ' 'চুরি হইছে' 'লালবাত্তি' 'না স্যার। জানি না স্যার। ' 'দ্যাখ, অক্ষনো সম আছে, জানলে বলি ফেল' 'না স্যার, জানি না স্যার' 'হিটলার, হাঁচা নি' 'সত্য স্যার, জানি না।

আমরা ক্যামনে কমু' 'আমি কিন্তুক তগো বেগ্যনের ব্যাগ চেক করতাম। ' 'করেন স্যার' 'ধরা ফড়লে কইলাম রেড-টিসি' 'জী স্যার' স্যার একটু যেন দমলেন। লোলটেনে পান খাওয়ার ইচ্ছেটা যেন দমালেন। তারপর আবার বললেন, 'খালি তগো না, ম্যাডাম ফুরা কেলাসের ব্যাগগুলান চেক করতাম কইছে' 'করেন স্যার' ক্লাস নাইন। কবির স্যারের ক্লাস।

তিনি গম্ভীর মুখে ক্লাসে ঢুকলেন। এতোক্ষন যাওবা একটু ফিসফাস ছিল তাও বন্ধ। পিনপতন নিরবতা। স্যার রোলকল শুরু করলেন, 'ওয়ান...' 'ইয়েস স্যার' 'টু...' 'ইয়েস স্যার' 'থৃ...' 'ইয়েস স্যার' 'আপনি দাড়িয়ে থাকুন' 'জী স্যার?' 'ফোর... ফাইভ... সিক্স...' 'ইয়েস স্যার... ইয়েস স্যার... ইয়েস স্যার' 'টুয়েন্টি সেভেন...' 'জী স্যার' 'দাড়িয়ে থাকুন' 'ক্যান স্যার' 'থার্টি ফাইভ...' 'ইয়েস স্যার' 'দাড়ান' 'ফিফটি টু...' 'প্রেজেন্ট প্লিজ' 'স্ট্যান্ড আপ প্লিজ'। স্যার রোলকল শেষ করলেন।

তাঁর মুখমন্ডলের চেয়েও গম্ভীর করে বললেন, 'আজ স্কুলে একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, তোমরা তার কিছু জানো?' 'দুর্ঘটনা?' 'কিয়ের দুর্ঘটনা স্যার?' 'কি হইছে স্যার' 'তোমরা কিছু জানো না বলছো?' 'কি ঘটনা, সত্যই আমরা কিছু জানি না স্যার' স্যার দাড়িয়ে থাকা প্রতিটা ছাত্রের দিকে তাকিয়ে কৌশল নির্ধারণ করে নিলেন। একটু চুপ থেকে ঘটনার গুরুত্ব আরো বাড়িয়ে নিলেন, তার পর বললেন, 'তোমাদের বড় আপার দরজার উপরে যে লালবাতিটা ছিল, সেটা এই টিফিন প্রিয়ডে চুরি হয়ে গেছে। এবং আমরা নিশ্চিত ওটা স্কুলের ছাত্রদের মধ্যেই কেউ নিয়েছ। ' ক্লাসের সবার ভেতর এক চাপা উত্তেজনা দেখা গেল। ফিসফাস করে উঠলো সবাই একে অপরের সাথে।

আবার চুপচাপ। 'তোমরা কে কে এই ঘটনার সাথে জড়িত আছো?' 'কন কি স্যার! এই ঘটনার কিচ্ছু জানি না স্যার' 'আল্লার কিরা আমি এইমাত্র শুনলাম স্যার' 'খোদার কসম স্যার কিচ্ছু কইতে পারি না' 'আমার উপরে অবশ্য অর্ডার আছে সবার ব্যাগ চেক করতে' 'জী স্যার...চেক করেন স্যার' ক্লাস এইট। হামিদুল হক স্যারের ক্লাস। রোলকল শেষে তিনি দুহাত দুপাশে মেলে দিয়ে মামরার মতো এনার্জি নিলেন। এবং লম্বা একটা হাই তুললেন।

তারপর সবার উদ্দেশ্যে বললেন, 'এই যে বাবারা-সোনারা, আইজ তোমাদের বড় আপার দরোজার যে লালবাতিটা, ওইট্যা চুরি হইছে। বুইচ্ছাও না। ' 'জী স্যার'। ক্লাসের সবাই সমস্বরে বলে ওঠে। 'এই ব্যপারে তোমরা কি কিছু জানো?' 'না স্যার'।

ক্লাসের সবাই আবারও সমস্বরে বলে ওঠে। 'কিন্তু তোমাদের কথাতো বিশ্বাস করতে পারতিছিনা সোনারা' 'বিশ্বাস করেন স্যার আমরা কিছু কইতে পারিনা' 'স্যার বিশ্বাস করেন' 'না রে বাপু রে। তোমাদের সবার ব্যাগ চেক করা লাইগবে। ' বড় আপা করিডোর ধরে এগিয়ে এলেন ক্লাস টেনের বারান্দার সামনে। মফিজ স্যারের হুংকার শোনা যাচ্ছে।

তিনি রতনকে দিয়ে সব ব্যাগ চেক করিয়ে নিচ্ছেন, রতন হলো ক্লাস টেনের আদুভাই। অপর দিকে স্যার সবাইকে শ্বাসাচ্ছেন। 'অক্ষণো স্বীকার যা। ন-হইলে এমন ফিডা দিতাম যে, কান্দি কুল ফাইতি-ন। কি রে রতন পাইছস নি' 'না স্যার' 'দ্যাখ ভালা করি দ্যাখ' বড় আপা এমন সময় ক্লাস টেনের দরজায় দাঁড়ালেন।

'মফিজ সাহেব। কি পাওয়া গেল?' 'ন-আফা, ব্যাগ চেক কইচ্চি, বেগ্যন খুজি দেখতাম চাই' লাইব্রেরী রুম থেকে মালতি পিসি দৌড়ে আসছেন, তিনি আর্কিমিডিসের মতো উৎফুল্ল। 'পাইছি আফা। পাইছি। ' 'কি পেয়েছ?' 'লালবাত্তি' 'কোথায়?' 'এইযে আফা।

মফিজ স্যারের ব্যাগে। ' তিনি মফিজ স্যারের চেন লাগানো চটের ব্যাগটা খুলে দেখালেন। লালবাতিটা তার ভেতর দেখা যাচ্ছে। সবাই কয়েক মুহুর্ত ওটার দিকে তাকিয়ে কল্পনাতীত এক বস্তু দেখলো। তারপর মফিজ স্যার চিৎকার করে উঠলেন, 'এইডা একটা ষড়যন্ত্র।

ষড়যন্ত্র। আফা বিশ্বাস করেন, এইডা একটা ষড়যন্ত্র। ' 'ঠিক আছে মফিজ সাহেব। আপনি ক্লাস নেন। পরে আমরা খুঁজে দেখবো আসলে কি হয়েছে।

' বড় আপা লালবাতিসহ তাঁর রুমে চলে গেলেন। পিছেপিছে মালতি পিসি। ছাত্রছাত্রীদের উত্তেজনা এখন তুঙ্গে উঠেছে। তারা ইতোমধ্যে ঘটনার ব্যবচ্ছেদ শুরু করেছে। মফিজ স্যার উত্তেজিত ভাবে ক্লাসে এলেন।

তাঁর সামনে পড়লো রতন, এতো বড় ঘটনাও তার মধ্যে কোন বোধের জন্ম দেয়নি, সে স্যারকে জিজ্ঞাস করলো, 'ব্যাগ চেক করমু স্যার' 'যা। আর লাক্তো না। ' ধমকে উঠেন স্যার। তিনি বারবার করে বলতে থাকেন, 'ষড়যন্ত্র। আমারে ফাসাইয়া দিছে।

ষড়যন্ত্র। ' বড় আপার রুম। স্কুল ছুটির পর শিক্ষকদের মিটিং ডেকেছেন বড় আপা। একপাশে স্কুলের আয়া মালতি ও পিয়ন খালেক রয়েছে দাড়িয়ে। সবাই চুপচাপ।

মফিজ স্যার স্বাভাবিক ভাবে উত্তেজিত; কারণ তাঁর ব্যাগ থেকেই লালবাতিটা পাওয়া গেছে। তিনি উত্তেজনা দমাতে ব্যর্থ হচ্ছেন বারবার, তার কন্ঠেও সেটা প্রকাশ পাচ্ছে, 'ন-আফা, ছাড়ি দিলে হইতো না-একটা বিহিত করনই লাইগতো। ' 'বিষয়টা বেশ স্পর্শকাতর। এর রহস্য খুঁজে বেড় করতে হবেই। ' কবির স্যার তার মন্তব্য করলেন।

তাঁর উত্তরে বড়আপা বললেন, 'হ্যা কবির ভাই, আমার তেইশ বৎসরের টিচিং প্রফেশনে এ রকম ঘটনা এই প্রথম' 'কিন্তু কে করতে পারে এই কাজ?' 'মফিজ সাহেব আপনি কি শিওর, টিফিন শেষ হওয়ার দশ মিনিট আগেও বাতিটা দেখেছেন?' 'শিউর আফা, দস-পনরো মিনিট আগই দেঁইকচি ' 'তাহলে আমরা এমন একজনকে খুঁজছি যে এই সময়টুকুর ভেতরেই কাজ সেরে লাইব্রেরী রুমেও ঢুকেছিল'। সবাই চুপচাপ। বড় আপা মালতি ও খালেকের দিকে তাকিয়ে বললেন, 'তোমরা বলতে পারো কে এই ব্যক্তি?' খালেক বলল, 'জ্বে না আফা'। মালতি বেশ কিছুক্ষন চুপ থেকে সেই সময়ের চিত্র কল্পনায় দেখে নিয়ে বললেন, 'হ্য কইতে পারতেয়াছি না আফা, হেই সময় আমি আমার পোলা মৃদুলের লগে কতা কইতে আছিলাম। ' 'তাহলে অন্তত আমরা এইটুকু সূত্র পেলাম যে, ঘটনাটি ঘটেছে টিফিন প্রিয়ডের শেষ দশ থেকে পনের মিনিটের মধ্যেই।

আমরা তাকে নিশ্চই খুঁজে পাবো কারণ সে অদৃশ্য কেউ নয়। ' মিটিং এখানেই শেষ হলো। আগামী কালের তদন্তের উপর অগ্রগতি নির্ভর করছে। [চলবে..............] ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.