আমি সব কিছু সহজভাবে চিন্তা করতে চেষ্টা করি। একবার আমার মামার বন্ধুর খুব অসুখ হল। মামা তাকে নিয়ে কবিরাজের বাড়ি যাবেন। আমার এক খালাতো ভাইও যাবে তাদের সাথে। ভাইয়ার সাথে আমি সারাদিন ঘুরতাম, ও যেখানে যেত আমাকেও সাথে করে নিয়ে যেত।
বরাবরের মত ভাইয়া এবারও আমাকে নিয়ে যেতে বলল তাদের সাথে। মামার মুখে একবার শুনেছিলাম যে, ঐ কবিরাজের নাকি জিন আছে। কারও সমস্যা হলে জিন ডেকে নিয়ে আসে। তারপর জিন ওষুধ-পত্র এনে দেয়। আমি আবার তখন একটু ছোট তো, এজন্য জিন-ভূত একটু বেশি-ই ভয় পেতাম তাই ভাইয়া আমাকে নিয়ে যেতে চাইলেও অন্যান্যবারের মত মনে মনে আর ফুর্তি লাগছিল না, ভয় ভয় মুখ করে তাকালাম ভাইয়ার দিকে।
মামাও বলতে লাগল থাক, ছোট মানুষ, যাওয়া দরকার নেই। ভাইয়া বলল, ছোট মানুষ তো কি হয়েছে, ভয় পাবে না কোন, আমি আছি না! ভাইয়ার কাছ থেকে অভয় বাণী পেয়ে আমার মনে একটু সাহস সঞ্চয় হল, ভাব মেরে মামাকে বললাম, ধুর চলতো মামা। ভূত-তুত আমি ভয় পাই নাকি! বিকাল বেলা আমরা সেই মহান কবিরাজের বাড়িতে যাবার জন্য বের হলাম। প্রথমে নদি ঘাটে গিয়ে নৌকায় উঠলাম নদি পার হবার জন্য। নৌকায় বসে আছি আর ভাবছি অনেক কথা।
জিন দেখতে কেমন হবে, সে কি আসলেই বিশাল আকৃতির হবে, তার কি সত্যি ইয়া বড় বড় চোখ থাকবে ইত্যাদি নানান কথা। আমি তো ঠিকমত খেতাম না, দুষ্টামি করতাম দেখে আমার খালারা আমাকে বলত, ঐ বাঁশঝাড়ে ২ টা মস্ত বড় ভূত থাকে। যারা ঠিকমত খায় না, কথা শুনেনা, দুষ্টামি করে- তাদেরকে রাত্রে বেলা সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, তখন ভূত এসে নিয়ে যায়। তারপর গাছে বসে মজা করে রক্ত চুষে খায়। আমি ঐসব কথায় সব দুষ্টামি বন্ধ করে পুরাপুরি লক্ষি বাবুর মত চুপ হয়ে যেতাম।
কিন্তু রাতে ভুতের ভয়ে যখন আম্মুর কোলে মুখ লুকিয়ে ঘুমিয়ে সকালে যখন আবার আম্মুর কোলের কাছেই নিজেকে আবিস্কার করতাম, তখন ভূতের কথা ভুলে গিয়ে আবার নতুন উদ্দীপনায় দস্যিপনায় মেতে উঠতাম, আম্মুর মাইর খাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি থামতাম না। এসব কথা ভাবতে লাগলাম আর মনে মনে বলতে লাগলাম, এতদিন তো ভূত-তুত কিছু আসে নাই। এখন যদি জিন আমাকে দেখে চিনে ফেলে, আমি সেই দুষ্ট বালক, তারপর যদি আমাকে কিছু করে! আস্তে আস্তে খুব-ই ভয় পেতে লাগলাম। ভাইয়াকে ফিসফিস করে বললাম যে, ভাইয়া খুব ভয় হচ্ছে। ভাইয়া বলল, আরে পাগল ভয় কিসের, আমি আছি না! কত ভূতকে ১০০ বার কান ধরে উঠবস করিয়েছি।
আমি অবাক হলাম ভাইয়ার কথা শুনে, কিন্তু ভয় কিছুতেই কাটছিল না, তাই একদম চুপ হয়ে গিয়েছিলাম, আর জিজ্ঞাসও করিনি তখন, কিভাবে ভূতকে কানে ধরে উঠবস করাইছিল, যদিও বড় হয়ে পড়ে বুঝেছি, সেটা ছিল ডাহা মিথ্যা কথা। নৌকা থামল, আমরা আস্তে আস্তে নামলাম। ভাইয়া জিজ্ঞেস করল মামাকে, আর কত দূর? মামা বলল, এইতো আর পনের-বিশ মিনিট হাঁটা লাগবে। হাঁটতে হাঁটতে একসময় আমরা পৌঁছে গেলাম। তখন সন্ধা-রাত হয়ে গেছে প্রায়।
মাটির একটি বড় ঘরের দরজা ঠেলে আমরা ভিতরে ঢুকলাম। ভিতরে ঢুকে দেখি, রুমের জানালা সব বন্ধ, অন্ধকার রুমে আলো ছড়াচ্ছে ফিলিপ্সের ১ টা ১০০ পাওয়ারের বাল্ব(সম্ভবত, কারন বাল্ব বলতে শুধু তখন টিভিতে বাত্তির রাজা ফিলিপ্সের অ্যাড দেখে শুধু ঐ বাল্ব-ই মনে করতাম)। মাদুরে বসে আছে গালভর্তি দাড়ি, পাঞ্জাবি-টুপি পরিহিত একজন মানুষ, আর তার সামনে অনেক মানুষ তার দিকে ফিরে বসে আছে। মামা আস্তে আস্তে আমাদের বলল, মাদুরে বসা লোকটিই হল কবিরাজ, আর তার সামনে বসা মানুষরা আমাদের মতই বিভিন্ন সমস্যায় পড়ে তার কাছে এসেছে। মামা আর তার বন্ধু হুজুর সম্বোধন করে সেই কবিরাজকে সালাম দিল।
তাদের দেখাদেখি ভাইয়া আর আমিও সালাম দিলাম। হুজুর আমাদের বসতে বললেন। এরপর হুজুর একেকজনের কাছ থেকে সমস্যাগুলা শুনতে থাকলেন। সবার সমস্যা শুনার পর উনি প্রায় এক মিনিটের মত ভ্যাবলার মত একদম চুপটি করে বসে রইলেন। আমি মামাকে জিজ্ঞেস করলাম, হুজুর এভাবে বসে আছে কেন? মামা বলল যে, উনি ধ্যান ধরেছেন।
আমি জিজ্ঞেস করলাম ধ্যান ধরা কি? মামা বললেন আহ থামত, এত কিছু বুঝায়ে বলার সময় নাই এখন, পরে বলব নে। আমি তারপরও বলতে থাকলাম, বলনা...বলনা, ধ্যান ধরা মানে কি? এবার মামার বন্ধুটা মনে হয় একটু বিরক্ত হয়ে বলল, ধ...ের বি...িতে জোরে টিপ দিলে কিছুক্ষন চিৎকার করার পর মানুষ যে স্তব্ধা লাইগা বইসা থাকে, ওইটাকেই ধ্যান ধরা বলে। আমি আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে নিছিলাম, কিন্তু মামা ধমক দিয়ে বলে উঠলেন, বেশি কথা বললে কিন্তু জিন এসে ভয় দেখাবে। এ কথা শুনার পর আবার চুপ হয়ে গেলাম। কিন্তু আরও কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছা হচ্ছিল খুব।
এই যেমন হয়ত জিজ্ঞেস করতাম, ধ... কি? আমি তখন খুব ছোট তো, তাই শুধুমাত্র একটি নাম ছাড়া আর কোন নামে চিনতাম না । কিছুক্ষণ পরে ধ্যান ভাঙ্গার পর হুজুর বলতে লাগলেন, "আপনারা কোন চিন্তা কইরেন না। সবার সমস্যাই ঠিক হয়ে যাবে। এখন জিন আসবে। আপনারা কেউ কোন শব্দ কইরেন না।
চুপচাপ বসে থাকেন। " সবাই একদম গুটি-শুটি হয়ে বসে রইল। হুজুর আবার বলল, "ভয় পায়েন না কেউ। আচ্ছা, আপনাদের যাতে ভয় কম লাগে, এজন্য জিনের দেয়া মিষ্টি আপনাদের খেতে দিচ্ছি। " এই বলে তিনি উঠে গিয়ে টেবিলের উপর থেকে একটা হাঁড়ি নিয়ে আসলেন।
তারপর সেই হাঁড়ি থেকে সবাইকে মিষ্টি খেতে দিলেন। সবাই মিষ্টি খেতে লাগল। আমিও খেতে লাগলাম। স্বাদ একটু অন্যরকম লাগল। আমি ভাইয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, মিষ্টি টক টক লাগছে কেন!? ভাইয়া মুচকি হেসে বলল, এটাতো জিনের বানানো মিষ্টি, রক্ত দিয়ে ভেজে ঠাণ্ডা করে বানানো মিষ্টি কি মিষ্টি হবে নাকি! এসব কথা শুনে আমিতো ভয়েই শেষ।
কোনমতে মিষ্টি খেয়ে এক গ্লাস পানি খেয়ে নিলাম। সবার খাওয়া শেষ, এরপর হুজুর বলে উঠল, "এখনি জিন আসবে। কেউ একজন গিয়ে লাইটের সুইচ বন্ধ করে দেন। আলো থাকলে জিন আসবে না। " মামা ভাইয়াকে বলল যাও তো, সুইচটা অফ করে আস।
ভাইয়া উঠল, আমি ভয় পেতে থাকলাম, ভাইয়ার হাত ছাড়ি না। ভাইয়া হাসি দিয়ে আমাকে কোলে উথাল, তারপর আমাকে নিয়েই গেল সুইচ অফ করতে। সুইচের সামনে ভাইয়া গেল,অফ করার জন্য হাত দিল, ঠিক এমন সময় হঠাৎ করে কারেন্ট চলে গেল। সমস্ত ঘর জুরে অন্ধকার নেমে আসল। অন্ধকারে ভাইয়া আর সুইচ ধরতেই পারেনি কোন।
আমি বললাম, ভাইয়া চল, মামার কাছে যাই। ভাইয়া আস্তে আস্তে বলল, এখন তো কিছুই দেখতে পাচ্ছি না, জিনেরও আসার সময় হয়ে গেছে। এখন আন্তাজে নাড়াচারা না করাই মনে হয় ভাল। আমি ভয়ে ভয়ে বললাম, এখনি এসে পড়বে!!? ভাইয়া বলল, হ্যাঁ এখনি, দেখলা না, আমার সুইচ নেভাতে দেরি হচ্ছিল, তাই জিন মনে হয় নিজেই কারেন্ট অফ করে দিছে বাইরে থেকে। এখনি এসে পড়বে, বেশি জোরে কথা বইল না আর শব্দ কইরো না কোন।
আমি চুপ করে রইলাম। হুজুর বেশ জোরে কি কি জানি বকবক করলেন একা একা, কিছুই বুঝলাম না। হঠাৎ দেখি শো শো কি জানি আওয়াজ হচ্ছে। ক্রমেই শব্দটা বাড়তে থাকল, আমি তো ভয়ে শেষ। মনে হচ্ছে বাইরে থেকে ঝড়ের বেগে জিন গাছপালা, দরজা-জানালা সব ভেঙ্গে-চুরে আসছে! হঠাৎ অনুভব করলাম ভাইয়াও থর থর করে কাপছে, এটা দেখে তো আমি আরও শেষ! যে আমাকে এত অভয় দিল, সে নিজেই ভয়ে শেষ।
আমার এখন কি হবে! জিন তো নিশ্চিত আমাকে চিনে ফেলবে, তারপর ধরে নিয়ে যাবে, আমাকে কে বাঁচাবে!! ভাইয়াকে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললাম, ভাইয়া খুব ভয় হচ্ছে। ভাইয়া বলল, লা ইলাহা পড়। ভাইয়া দেখি সমানে সুরা পরতেসে। আমিও লা ইলাহা...., লা ইলাহা.... পরতে থাকলাম। হঠাৎ হুজুর চেঁচিয়ে উঠলেন, দরজা খুলে ভিতরে আস, জিনের সর্দার।
ভয়ে আমি আর ভাইয়া দুইজন-দুইজনকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে আছি। শো শো আর ঝন ঝন শব্দ বুকের মধ্যে কাপুনি বাড়ায়ে দিচ্ছে আমার। দড়াম করে দরজা খুলে গেল। ভাইয়া আর আমি ছোটখাটো একটা চিৎকুর দিয়ে ফেলেছি। হঠাৎ করে দেখলাম, চারদিক আলোয় ভরে গেছে।
অবাক দৃষ্টিতে আমরা সবাই হুযুরের দিকে তাকিয়ে দেখি, তার দুই হাত দুইটি শিকলের এক প্রান্ত ধরা, শিকলের আরেক প্রান্তগুলা সবার মাথার উপর দিয়ে দরজার সাথে বাঁধা। হুজুর দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সেই শিকল দুটি-ই এতক্ষন জোরে জোরে টানছিলেন, আর দরজায় এতে প্রচণ্ড জোরে শব্দ হচ্ছিল, জোরে টানতে টানতেই দরজার সিটকিনি একসময় খুলে গিয়েছে! ঢুকার সময় আমরা সবাই মাথার উপরে দুইটি শিকলের লাইন যেতে দেখসিলাম, কিন্তু ঐটা দিয়ে যে এই কাজ করবে সেটা কেউই ভাবতে পারেনি! হঠাৎ করে লাইট জ্বলে যাওয়াতে হুজুর কতখন টাস্কি খেয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন। টাস্কি খাবার-ই কথা, উনি তো আর দেখেন নি যে, সুইচের কাছে যাওয়ার পর-ই কারেন্ট চলে যাওয়াতে ভাইয়া সুইচ আর অফ করতে পারেনি!!! কিছুক্ষণ ভ্যাবলার মত চেয়ে থেকে উনি হঠাৎ করে দিলেন দৌড়। সব উত্তেজিত জনতাও তখন তার পিছনে দৌড়ান আরম্ভ করল। তারপর একসময় সবাই ধরে ফেলল তাকে।
তারপর আর কি, সবাই মিলে বদমাইশটাকে ইয়া ঢিসুমাইত.. ইয়া ঢিসুমাইত.. দিতে থাকল । ভাগ্যিস কারেন্ট এসে পরেছিল, নাহলে আরও কত দিন যে বদমাইশটা কবিরাজ সেজে ভণ্ডামি করে যেত গ্রামের সহজ-সরল মানুষগুলার সাথে!!! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।