যখন বিটিভি ছিল একমাত্র টিভি চ্যানেল, তখনকার কথা বলছি। টিভিতে বাংলা-ইংরেজী সিনেমা, এ সপ্তাহের নাটক, ধারাবাহিক নাটক আর কার্টুন ছাড়া আর যা নিয়মিত মন দিয়ে দেখতাম তা ছিল বিদেশী ধারাবাহিক। কোন তথ্য দিতে পারব না, নিজের স্মৃতিতে যা আছে তা-ই নিয়ে বক বক করব।
১. ম্যাকগাইভার
বিটিভিতে এটাই মনে হয় সবচেয়ে জনপ্রিয় বিদেশী সিরিজ ছিল। সব বয়সীর কাছে প্রিয় নাম ছিল ম্যাকগাইভার।
আমি একবার ম্যাকগাইভারের ছবিওয়ালা একটা ক্যালেন্ডারও জোগাড় করেছিলাম।
কেউ জানে কি না জানি না, ম্যাকগাইভার প্রথমে একটা সিনেমা নির্মাণ করা হয় দুই ঘন্টার। এই সিনেমাটা দেখিয়েছিল মুভি অব দ্য উইক-এ। পরে এই সিনেমাকে দুই পর্বে ভাগ করে সিরিজ হিসেবে দেখানো শুরু করা হয়, আর পরের পর্বগুলোও নির্মাণ করা হয়। ম্যাকগাইভার যেদিন সিরিজ হিসেবে প্রথম দেখানো শুরু হয়, আমি প্রথম দৃশ্যটা দেখেই বলে দিলাম, এটা তো সিনেমা, আমি দেখেছি।
বাসার কেউ বিশ্বাস করল না। পরে যখন বেশ কয়েকটা দৃশ্য আগে থেকেই বলে দিলাম আর ঠিক ঠিক মিলে গেল, তখন সবাই মানল।
ঐ সময় ম্যাকগাইভার যে কি বিশাল ক্রেজ ছিল। একটাও পর্ব যেন মিস না হয় সেজন্য বুধবার রাত নয়টার আগে স্কুলের সব হোমওয়ার্ক শেষ করে রাখতাম। পরীক্ষার সময়ও তাড়াতাড়ি পড়া শেষ করতাম, নইলে আম্মা দেখতে দিবে না।
তারপরও একবার কেন যেন আম্মা পরীক্ষার মধ্যে একটা পর্ব দেখতে দেয়নি। জোর করে পড়তে বসিয়ে রেখেছিল, আর পাশের রুমে সবাই দেখছিল। এত কষ্ট পেয়েছিলাম যে রাগের চোটে ঐ এক ঘন্টা কিছুই পড়িনি। পরের দিন পরীক্ষা শেষ করেই বান্ধবীদের কাছে ঐ পর্বের পুরো কাহিনী শুনে নিয়েছিলাম।
ম্যাকগাইভারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল খুব সামান্য জিনিস দিয়ে অনেক কিছু তৈরি করে ফেলা।
আর একটা ব্যাপারে রাগ () লাগত, প্রতিটা পর্বে নতুন নতুন অভিযানের মধ্যে একটা নতুন নায়িকা থাকবেই। আর নায়িকাগুলো ম্যাকগাইভারের প্রতিভায় মুগ্ধ হয়ে তার প্রেমে পড়বেই। ম্যাকগাইভারও সুযোগমত তাদের সাথে প্রেম করে নিত। নিজেকে জেমস বন্ড মনে করে তো!
ম্যাকগাইভারের শেষ পর্বের শেষ দৃশ্য ইত্যাদিতে আগেই দেখিয়ে দিয়েছিল। তাই শেষ পর্বের উত্তেজনাটুকু আর ছিল না।
তবে কষ্ট পেয়েছিলাম সিরিজটা শেষ হয়ে যাওয়ায়।
শেষ পর্বে তার একজন পুত্র সন্তান আবিষ্কৃত হয় যার মাকে ম্যাকগাইভার নিজেও মনে রাখতে পারেনি। কেমনে রাখবে, নায়িকার তো অভাব ছিল না। পরে ছেলের কাছে ছবি দেখে জানতে পারে।
কয়েক বছর আগে দেখলাম একটা চ্যানেলে ম্যাকগাইভার দেখানো হচ্ছিল।
টেকনোলজীর ব্যাপারগুলো এখন দেখলে কেমন যেন হাস্যকর লাগে। তাই আর দেখিনি, এই সিরিজ সম্পর্কে স্মৃতিতে যে অনুভূতিটুকু আছে, তা-ই ধরে রাখতে চাই।
২. দি এ-টিম
এটাও আরেকটা জনপ্রিয় সিরিজ। এখানেও সামান্য জিনিস দিয়ে টেকনোলজীর বড় বড় জিনিস বানানোর একটা ব্যাপার ছিল। সেই সাথে একেক পর্বে একেক কেস সলভিং।
তবে একজন না, চারজনের একটা দল, যার নাম দি এ-টিম।
আমরা অবশ্য সিরিজটাকে মিস্টার টি নামেই বলতাম। তার চরিত্র এখানে অন্য সবার চেয়ে কম ছিল, কিন্তু তার গেট-আপটাই সবার নজর কাড়ত। ভারী গহনা (বাপ্পি লাহিড়ীর মত) আর মাথায় বিশেষ হেয়ারকাট, সেই সাথে অদ্ভূত নাম - সব মিলিয়ে এই টিমে তাকেই চোখে পড়ত বেশি। তার সাথে সারাক্ষণ ঝগড়া লেগে থাকত এই টিমের আরেক সদস্য মরডাকের।
মরডাক ইচ্ছা করেই মিস্টার টি-কে ক্ষেপাত। আর মিস্টার টি-র শক্তি আর সাহস যতই থাকুক, সে বিমানে চড়তে ভীষণ ভয় পেত। তাই কোন কারণে বিমানে চড়া লাগলে তাকে কৌশলে অজ্ঞান করে নেয়া হত। কোনভাবে যদি জ্ঞান ফিরে আসত, তো নিজেকে বিমানে দেখে সে নিশ্চিতভাবে ধরে নিত এটা মরডাকের ষড়যন্ত্র আর তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ত।
মাঝে মাঝে ম্যাকগাইভারের সাথে তুলনা করে আমার কাছে দি এ-টিম বেশি ভালো মনে হত।
কারণ ম্যাকগাইভার হয়তো সামান্য একটা জিনিস দিয়ে একটা নষ্ট গাড়ী ঠিক করে ফেলতে পারত, দি এ-টিমের সদস্যরা আরও সামান্য জিনিসপত্র দিয়ে একটা পুরো গাড়ীই তৈরী করে ফেলতে পারত। টিমের বাকী দুই সদস্যের নাম মনে পড়ছে না এখন। একজন ছিল বুড়ো, সাদা-চুলো, সারাক্ষণ চুরুট মুখে ঝুলত, আর আরেকজন একেবারেই নিপাট ভদ্রলোক। মরডাক মাঝে মাঝে ভদ্রলোক সাজার চেষ্টা করলেও তাকে কমেডিয়ানই মনে হত। আর মিস্টার টি-র বর্ণনা তো আগেই দিলাম।
তবে তাদের মধ্যকার টিমওয়ার্ক ছিল অসাধারণ।
কিছু দিন আগে দি এ-টিম মুভি বের হয়েছে। আমি ইচ্ছা করেই দেখিনি, কেন যেন মনে হয়েছে আগের সেই অনুভূতিটা এখন আর পাবো না। আমার ধারণা ভুলও হতে পারে।
৩. হট পারস্যুট
জনপ্রিয় সিরিজের পাশাপাশি একটু অপরিচিত সিরিজের কথায়ও আসি।
আমি মোটামুটি কোন সিরিজই দেখা বাদ দিতাম না। এই সিরিজটা শুরুতে বেশ ভালো লাগছিল, পরে একঘেয়ে হয়ে যায়।
কাহিনী এক দম্পতিকে নিয়ে যারা একটা ছোট শহরে থাকে। স্বামী ডাক্তার, আর স্ত্রীর পেশা মনে নেই, তবে খুব ভালো রেসিং কার চালায়। যা হোক, তাদের শহরে একটা খুন হয়, ঘটনাক্রমে এই মহিলার উপর তার দায় এসে পড়ে আর তাকে গ্রেফতার করা হয়।
তখন তার স্বামী তাকে নিয়ে শহর ছেড়ে পালায়। এরপর তারা এক শহর থেকে আরেক শহরে পালিয়ে বেড়ায় আর নানান রকম ঘটনা ঘটতে থাকে। এভাবে চললেও ভালোই ছিল, কিন্তু এক সময় দেখা গেল তারা যেখানেই যায় তাদের মত চেহারার আরও মানুষ থাকে, যাদের সাথে তাদেরকে সবাই মিলিয়ে ফেলে। একবার স্বামীর সাথে, একবার স্ত্রীর সাথে, এই ব্যাপারটাই বাড়াবাড়ি রকমের একঘেয়ে হয়ে গিয়েছিল। শেষের দিকে মনে হয় সিরিজটা দেখা বাদ দিয়েছিলাম।
৪. টুইন পিকস
এই সিরিজটার কথা বলার আগে একটু দম নিয়ে নিই।
ব্যাপার তেমন কিছু না, এই সিরিজের নায়ক ছিল আমার স্কুল জীবনের প্রথম ক্রাশ।
যাক গে, এর কাহিনী ছিল একটা ছোট পাহাড়তলীর শহর নিয়ে। এখানে সবাই নিরিবিলি থাকে, সবাই সবাইকে চেনে। হঠাৎ করে এখানকার হাইস্কুলের এক সুন্দরী ছাত্রী খুন হয়।
সেই খুনের তদন্ত করতে আসে এক এফবিআই এজেন্ট ডেল কুপার। (আবার একটু দম নিয়ে নিই। ) শহরের শেরিফ ছিল হ্যারি ট্রুম্যান। এই দুজন মিলে তদন্ত শুরু করে। ভালোই রহস্য নিয়ে আগাচ্ছিল কাহিনী।
শেষে এসে কাহিনীতে টুইস্ট আনতে গিয়ে সব গুবলেট করে দিয়েছে। যাক, শেষটুকু বাদ দিলে পুরো সিরিজে টান টান উত্তেজনা ছিল। আর কিছুতেই বাদ দিতে চাইতাম না এই সিরিজের কোন পর্ব। শুধু একবার খুব জ্বরের মধ্যে দেখতে বসে দেখলাম মারামারির দৃশ্যগুলো দেখলে মাথা ঘুরাচ্ছে, তাই এই একটা পর্ব আমি নিজে থেকেই বাদ দিয়েছিলাম।
এই সিরিজের আরেকটা আকর্ষণীয় ব্যাপার ছিল, এখানে খুন হওয়া ছাত্রীসহ আরও যত অভিনেত্রী ছিল, একেকজন একেকজনের চেয়ে সুন্দরী।
বিশেষ করে ঐ ছাত্রীর বান্ধবীরা। এর মধ্যে একজনকে অবশ্য আমি একদম সহ্য করতে পারতাম না, সে ঐ এফবিআই এজেন্ট ডেল কুপারের সাথে প্রেম করার চরম চেষ্টা চালাত। অবশ্য ভালো লাগত এই দেখে যে কুপার তার রঙ-ঢঙকে মোটেই পাত্তা দিত না।
এই সিরিজের শেষের দিকের কয়েকটা পর্বে ডেভিড ডুকোভনি যোগ দেয়। চিনেছেন তো তাকে, এক্স-ফাইলস খ্যাত ফক্স মোলডার।
সে এই সিরিজে একজন গোয়েন্দা হিসেবে আসে, যে ডেল কুপারের সহকর্মী। তবে সে একজন হিজড়া। মেয়েদের পোশাক পরে, মেয়েদের মত চুল-মেকআপ, মেয়েদের মতই হাঁটা-চলা। একেবারে শেষে আবার সে একটা পর্বে পুরুষের পোশাক পড়ে আসে। দেখুন তো চেনা যায় কি না।
যা হোক, এই সিরিজটার শেষটুকু এমন না করলেও পারত। একটা গোয়েন্দা কাহিনীকে মোড় নিয়ে একেবারে অন্যদিকে হরর কাহিনীর দিকে নিয়ে গেল, আর শেষ পর্যন্ত আমার নায়ককেই ভিলেইন বানিয়ে ছাড়ল। সবই গভীর ষড়যন্ত্র।
৫. ই এন টি
এই ইএনটি মানে নাক-কান-গলা না। এর বিস্তারিত হল, ইলেক্ট্রনিক নিউজ ট্রান্সমিশন।
এই সিরিজটাও আমার বেশ ভালো লেগেছিল। একটা নিউজ চ্যানেল নিয়ে করা সিরিজ। (এই একটা সিরিজের কোন ছবি পেলাম না মামুর কাছে। )
নিউজ চ্যানেলের প্রতিটি সদস্যই এর একেকটি চরিত্র। তাদের ব্যক্তিগত জীবনের পাশাপাশি পেশাগত জীবন নিয়ে এই সিরিজের কাহিনী এগিয়ে গিয়েছিল।
সেই সাথে তারা যে নিউজগুলো কাভার করে সেগুলোই ছিল এই সিরিজের মূল বিষয়।
নিউজ চ্যানেলের একেকটা স্টোরির পিছনে রিপোর্টারদের কত পরিশ্রম, আর কিভাবে একেকটা নিউজ স্টোরি দাঁড় করানো হয়, এগুলো সবই জানা যেত।
পাশাপাশি তাদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়েও দেখানো হত। চ্যানেলের ভাইস চেয়ারম্যানের সাথে এক সামান্য ক্যামেরাম্যানের গোপন প্রেম, আবার নতুন যোগ দেয়া চেয়ারম্যানেরও ভাইস চেয়ারম্যানের উপর ক্রাশ খাওয়া, এইসব আর কি। একটা ব্যাপার খুব ভালো লাগত, এখানে পদমর্যাদা যাই হোক, কেউ কাউকে স্যার/ম্যাডাম ডাকত না।
সবাই সবাইকে নাম ধরে ডাকত আর একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। আবার জানের দোস্তের মধ্যেও ঝগড়া-ঝাটি, আবার মিল-মহব্বত, কিংবা খুনসুটি, সবই সুন্দর করে দেখানো হয়েছে।
এই সিরিজের শেষটুকু ঠিক মনে পড়ছে না। তবে শেষের দিকে ভাইস চেয়ারম্যান তার ক্যামেরাম্যানের সাথে গোপন প্রেমের কথা ফাঁস করে দেয় নিজেই, সেটা নিয়ে সবার মধ্যে সম্পর্কের একটা টানা-পোড়েন শুরু হয়। তারপর কি কি যেন হয়।
যাক, আসল ব্যাপার ছিল নিউজ স্টোরিগুলো। অনেক সময় অনেক গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যেত, কিংবা কোন এক্সক্লুসিভ নিউজ কাভার করতে গিয়ে নানান রকম সমস্যা হত। কয়েকটা তো হৃদয়বিদারকও ছিল। এগুলোই মনে দাগ কেটে যেত।
আমার সমস্যা হল স্মৃতিচারণ করতে বসলে বক বক আর শেষ হতে চায় না।
এখনও আরও অনেক সিরিজের কথা বলা বাকী। পরে বলি ধীরে-সুস্থে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।