সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে ...
পূর্বকথা :
এই গল্পটির একটি প্রথম পর্ব আছে । পাঠকগণের তালাশের সুবিধার্থে তার লিংক দিয়ে দেয়া হল Click This Link । উল্লেখ্য যে , গল্পের কাহিনী কারো জীবনের সাথে মিলে গেলে তা মোটেও অনভিপ্রেত কাকতালীয় কিছু নয় । এবং গল্প পাঠপূর্বক মেজাজ খারাপ হলে তার জন্য মাইনাস প্রদান বিপুলভাবে সমাদৃত হবে ।
১.
আমি হাঁটছিলাম এলোমেলো ।
সারাদিন অফিসের পর এ সময়টায় ভীষণ আলসেমি আসে । সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে পৃথিবীর বুকে , এক এক করে আলোগুলো জ্বলে ওঠে চারপাশে ।
ভালো লাগে আমার । দমবন্ধকরা জ্যাম আর মানুষের এই শহরে হেঁটে বাসায় ফিরতেই ভালো লাগে । মাঝে মাঝে রাস্তায় পাশে বসে পড়ি , চোখ মেলে দেখি মানুষের বয়ে চলা , নদীর মত ।
চাকরিটা আর ভালো লাগে না । যদি পারতাম , এক্ষুনি সব ছেড়েছুড়ে দূরে কোথাও চলে যেতাম । সাধারণ কেরানীর চাকরি , দিনভর পরিশ্রম , বসদের চোখরাঙানি অকারণে ... তবুও মুখবুঁজে কাজ করে যায় , কারণ কাজ করে যেতে হয় আমাকে। বাবা নেই , বাসায় মা আছেন ; তার জন্যই করা চাকরিটা ।
ভালো ছাত্র কখনোই ছিলাম না , আসলে ভালো ছাত্র হবার কোন তাগিদ কখনো বোধ করিনি ।
এক আরামদায়ক আলস্যে বাঁধা জীবন । পথচলা , উদ্দেশ্যহীনভাবে পথচলা ... গন্তব্য জানা নেই ।
এরও একটা নেশা আছে ।
মা মাঝে মাঝে বিয়ের জন্য তাগাদা দেন , বুঝেও না বোঝার ভান করেন অনেককিছু । আমি হাসি।
কিছু বলি না , বলার প্রয়োজনও পড়ে না ।
তবে এটা ঠিক , মাঝে মাঝে খুব একা লাগে । খুব মনে হয় , যদি পাশে থাকত কোন মমতাময়ী , যার হাত আঁকড়ে , যার চোখের দিকে চেয়ে ; পেরিয়ে আসা যায় জীবনের সকল অধ্যায় - তেমন কেউ যদি থাকত । মনে হয় , ভীষন ভালো লাগতো , যদি দরজার ওপাশে থাকত একজোড়া অপেক্ষমান চোখ ।
সে সব সময়ে তোমার কথা আমার অনেক মনে হয় লাবণ্য ।
মনে হয় , এ বিপুল জনরণ্যে যদি কখনো দেখা হয়ে যায় তোমার সাথে , তুমি কি জিজ্ঞাসা করবে ভালোবাসায় - ভালো আছো , মুহিন ?
আমাকে চিনবে তো ? আমি মুহিন । সেই বখে যাওয়া ছেলেটা , যে শুধুমাত্র তোমাকে ভালোবেসেছিলো । যে কখনো তোমার ভালোবাসা প্রার্থনা করেনি , শুধু তোমাকে একমনে দেখতে চেয়েছিলো । যে তোমার পথ আগলে কখনো বসে থাকেনি , শুধুমাত্র তোমার জন্য তার পথগুলো বিছিয়ে রেখেছিলো ।
আমি তোমাকে খুঁজেছি অনেক , লাবণ্য ।
বিশ্বাস করো , গত আটটি বছর তোমার মুখটিকে খুঁজেছি সহস্র মুখের মুখোশে । তোমাদের বাসায় আর কেউ থাকে না , কেউ জানে না কোথায় গিয়েছ চলে । কোথায় তোমার রংয়ে ফুটছে বুনোফুল , আমি জানি না ।
তবু আমার জীবনে ভালোবাসা শুধুমাত্র তুমি । আমি খুঁজে বেড়াই অবচেতনভাবে , তোমাকে ... কখনো কোন লাল রংয়ের গাড়ি দেখলে মনে হয় , তুমি বসে রয়েছ পেছনে মাথা নিচু করে ; কখনো কোন স্কুল ফেরতা কিশোরীর চুলকে ভুল হয় তুমি ভেবে , কখনো কারো চাহনিতে মনে হয় আর একটি ফেলে আসা সন্ধ্যার কথা ।
আমার অন্ধকারাচ্ছন্ন জীবনে যেন তুমি রয়েছ একমাত্র বিভাবরী হয়ে ।
কখনো ভাবিনি সত্যিই কখনো তোমার সাথে দেখা হয়ে যাবে , আমার মুখের দিকে কখনো তাকাবে তুমি অবলীলায় , ক্যালেন্ডারের ধূলো পড়া পাতা থেকে সূর্যের মত হেসে উঠবে সশব্দে ।
সেদিন পর্যন্ত ।
আমি এলোমেলো হাঁটছিলাম রাস্তায় , অফিস থেকে বাড়ি ফেরার এ সময়টা ক্লান্ত লাগে খুব , ইচ্ছে হয়না হাঁটতে , মনে হয় পথে বসে পড়ি , একমনে দেখি নিদ্রাহীন এক পিশাচনগরের জেগেওঠা ... শ্বাপদের মত হিসহিস সহস্র আলোতে ।
হঠাৎ একটা ভীড় চোখে পড়ল , গুরুত্ব দিলাম না ।
হয়তো অবিসংবাদী জোঁকের তেল বা অষ্টধাতুর আংটি বিক্রি করছে কেউ ভেবে । ভীড় ভালো লাগে না আমার , মানুষ দেখতে পছন্দ করে এমন কোন দৃশ্যই আমাকে টানে না ।
হঠাৎ ভীড়ের মাঝখান থেকে কানে এল একটা পরিচিত কন্ঠ , এত পরিচিত , এতই বেশি ; যে চাইলেও আমি ভুলে যেতে পারবোনা কখনো ।
আমি তাকালাম ভীড়ের দিকে , যদিও তাকানোর আগেই আমি জানতাম , আমি তোমাকে দেখব ।
তুমি বসে ছিলে একরাশ লোকের মাঝে , পথে পড়ে থাকা সকালের বকুলের মত , তোমার কোলে তোমার মা'র মাথা , তোমার দু'চোখ বেয়ে অশ্রুধারা , কিন্তু কোন দৃষ্টি নেই ... তুমি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বললে ,
" কিছু একটা করুন প্লীজ , আমার আম্মু মারা যাচ্ছে "
২.
তিন ঘন্টা পর ।
হাসপাতালের কেবিনের বাইরে বসে ছিলাম আমি আর তুমি । তুমি কান্না থামিয়েছ একটু আগে । বলছিলে , ফেলে আসা বছরগুলোর কথা । কতখানি বদলে গিয়েছ তুমি , তোমার জীবন ।
আমার সাথে তোমার দেখা হয় ডিসেম্বর মাসে ।
এরপরেই ঢাকা ছেড়ে নিউ ইয়র্কে চলে যাও তুমি , পড়তে । ওখানে ভর্তি হও একটা কলেজে ।
আমি তন্ময় হয়ে শুনতে লাগলাম তোমার কথা , কিভাবে বন্ধুদের সাথে মিশতে মিশতে একসময় শখের বশে হেরোইন নিলে , কিভাবে হেরোইন পরিণত হল নেশায় , কিভাবে একটা নেশা , সাদা কিছু গুড়োঁ কিভাবে গুঁড়ো করে দেয় অনেক স্বপ্নকে , শুনছিলাম । আমি এক সত্যি গল্প শুনছিলাম ।
নিউ ইয়র্কে তোমার রুমমেট ছিলো বারবারা, বারবারা ও'জামা ।
নাইজেরিয়ার মেয়ে , অনেকটা ওর অনুরোধেই একবার হেরোইনের স্বাদ নেবার লোভ সামলাতে পারোনি । আর সেটাই কাল হয় তোমার জীবনে ।
তুমি কাঁদছিলে , " জানো , প্রতিমাসে বাবাকে বলতাম আরো বেশি টাকা পাঠাতে ; তবু্ও প্রয়োজন ফুরাত না । বাসায় কেউ কিছুই জানত না , যখন একটা ড্রাগ গ্যাং এর চেইন হিসেবে নিউ ইয়র্ক পুলিশ আমাকে আইডেন্টিফাই করল তার আগ পর্যন্ত । "
দেশে চলে আসলে তুমি , ভর্তি হলে একটা রিহ্যাবি্টেশন সেন্টারে ... সেখানে বিছানায় তীব্র কষ্টের মাঝে শুনলে বাবার মৃত্যুর খবর ।
" প্রচন্ড কষ্ট হত , যখন নেশা উঠত ... মনে হত যেন শরীরের সকল রক্তবিন্দু বেরিয়ে আসতে চাইছে । বাবার কথা মনে পড়তে নিজেকে সামলাতে পারতাম না , দুবার আত্নহত্যা করতে চেয়েছিলাম , পারিনি "
"এরপর ? " আলতো করে জিজ্ঞেস করলাম আমি ।
" একসময় সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরলাম , কিন্তু হারিয়ে গেছে আমার চেনা পৃথিবীটা । বন্ধুরা বদলে গেছে , আমি তাদের কাছে শুধু একজন মানসিক রোগী । কেউ কেউ ফোন করে সমবেদনার কথা বলে , অসহ্য লাগে শুনতে ।
কখনো কখনো দূরে কোথাও চলে যেতে ইচ্ছা করে , মা'র জন্য পারিনা । "
" বিয়ে করেছ ? " আমার চোখে ভয় ।
" এমন একজন নেশাসক্ত , বখে যাওয়া মেয়েকে কে বিয়ে করবে বলো ? বিয়ে আর করা হয়নি , ইচ্ছা করেনি কখনো করতে । একা থাকি , একা থাকতেই ভালো লাগে । কারো করুণা পেতে ইচ্ছে করে না একদম।
"
জলে চোখ ভরে আসে আমার ।
বলে চলে লাবণ্য -" জীবনে কখনো কারো অপকার করিনি মুহিন । কখনো কারো কাছে মিথ্যা বলিনি অকারণে । তবু মাঝে মাঝে মনে হয় স্রষ্টা আমাকে কেন এই শাস্তি দিল । তখন আমার তোমার কথা মনে হত ।
তোমাকে হয়তো না বুঝে , বিনা কারণে রাস্তায় অপমান করেছিলাম । তুমি প্লীজ আমায় ক্ষমা করো । "
" আমি কিছু মনে রাখিনি , লাবণ্য । " অবলীলায় মিথ্যাটা বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে । " বাদ দাও ওসব কথা ।
আন্টির কি হয়েছিল ? "
" আজ মার সকাল থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না । গত কদিন ধরেই মা'র অফিসে কাজের চাপ যাচ্ছিল প্রচন্ড । কিন্তু , বাসায় বাজার করাটা জরুরী হয়ে পড়েছিলো । আমি বাসা থেকে বেরোই না খুব একটা , আজ জোর করেই আসলাম মায়ের সাথে । হঠাৎ মার বুকে ব্যাথা শুরু হল , তারপর তো জানোই ।
"
" ভয় পোয়ো না , ডাক্তার বলেছেন - মাইল্ড স্ট্রোক , ঠিক হয়ে যাবেন । " আমি বললাম ।
" তোমাকে কি বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছিনা মুহিন । কতদিন আগের চেনা , তবুও তুমি বিপদে ঠিকই এগিয়ে আসলে মুহিন । আমাকে যে ভুলে যাওনি এরজন্য অনেক অনেক থ্যাংকস্ ।
"
আমি উঠে দাঁড়ালাম । এধরনের পরিস্থিতিতে কি বলা উচিৎ আমার জানা ছিল না । আমি চোখের জল লুকোতে তাকিয়ে রইলাম অন্যদিকে ।
আমরা দুজনেই এরপর অনেকক্ষণ চুপ করে থাকলাম । বদ্ধ করিডোরে , অনেক জোরে বাজছিলো ঘড়ির কাঁটার শব্দ ।
হঠাৎ আমার কি হল আমি জানিনা । আমি তোমার দিকে তাকলাম , তোমার চোখে জল মুছিয়ে দিলাম আমার আঙ্গুল দিয়ে . তারপর তোমার চোখে চোখ রেখে বললাম , বললাম আমার না বলা কথাগুলি ... যেগুলো তোমাকে আমি কখনোই বলতে পারিনি -
" তোমাদের গাড়ির রং ছিলো লাল , নাম্বার ছিলো ঢাকা মেট্রো - ২৩৭৬০৬ । তোমার একটা পোষা কুকুর ছিলো , নাম ছিলো হান্টার । তোমাদের বাসার নাম ছিলো পান্থনীড় , বাসার সামনে একটা ফোয়ারা ছিলো আর ছিলো বাগান বিলাসের ঝাড় , তোমার জন্মদিন ২০ শে নভেম্বর , তোমার প্রিয় রং মেরুণ , প্রিয় ঋতু বসন্ত ।
আমি কিছুই ভুলিনি , লাবন্য ।
কিছুই ভুলিনি আমি । ভুলে যাবার জন্য আমার হাতে অফুরন্ত সময় ছিলো , কিন্তু কখনোই আমি ভুলিনি । তার কারণ এই নয় যে আমি ভুলতে চাইনি । তার কারণ এই , আমি ভুলতে পারিনি । একটি রাতও ঘুমুতে পারিনি তোমাকে না ভেবে ।
"
আমি দেখছিলাম জলে আর বিস্ময়ে ভরে যাচ্ছে তোমার চোখজোড়া , তুমি যদি নিজেকে দেখতে , জানতে , তোমাকে কতখানি সুন্দর লাগছিলো সেই সময়ে ।
৩.
তিন বছর পরে , আজ আমি এই ব্লগ লিখছি । সেই হাসপাতালের বারান্দায় বসে , যেখানে তিন বছর আগে আমরা দুজনে বসেছিলাম ।
কিছুক্ষণ আগে আমাদের একটা বাবু হয়েছে । ডাক্তার অভয় দিয়েছেন , আমি তবুও খুব ভয় পাচ্ছি ।
বারবার দেখে আসছি তোমাকে আর আমাদের ছোট্ট পুতুলটিকে ।
পৃথিবী গোলাকার , তার মানেই এই নয় যে সকল মুহিন খুঁজে পাবে তার গন্তব্য । কিন্তু জীবন সম্বন্ধে একটা কথা খুব জোর দিয়ে বলা যায় , তার সম্বন্ধে কোন কথাই বলা যায় না ।
আজ আমি আর ধূসর চোখে রাস্তায় বসে আলো দেখি না । আমি জানি , এখন একজোড়া চোখ আমার অপেক্ষায় বসে আছে ।
আমি জানি , এখন আমার সবগুলো দুঃখ ভাগ করে নেবার প্রতীক্ষায় দিন কাটে তার ... আমি জানি জীবনে আর কখনোই আমি একা হবো না , পৃথিবীর সমান ভালোবাসায় সে আমায় জড়িয়ে থাকবে , সারাজীবন ।
জনৈক মুহিন , এই পৃথিবীর এক সাধারণ মানুষ , তার সাধারণ গল্প এখানেই শেষ করছে ।
উৎসর্গ : প্রিয় বন্ধু সিফাত'কে , যার প্রেরণায় ( তাগাদায় ) এ গল্প লেখা । যার যন্ত্রণায় আমি মোটামুটি অনেক বিরক্ত কিন্তু একদিন কথা না হলেই আমি বুঝতে পারি আমি তাকে অনেক ভালোবাসি । এবং সে অনেক পচা একটা বিড়াল ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।