বয়ে চলা সময়কে ধরে রাখার একটা প্রয়াস
প্রোফেসর আব্দুস সালামের নাম কম-বেশি সবাই শুনেছেন আশা করি। আমার লেখাটা মূলত তার ওপরই। ২০০৯ সালে একটা বই পেয়েছিলাম,বইটার নাম ছিল "One Hundred Reasons to be a Scientists",বইটা ICTP (The Abdus Salam International Center for Theoretical Physics)-র ৪০ বছর পূর্তিতে প্রকাশিত হয়েছিল। বইটা বিভিন্ন দেশের ছাত্রদের বিনামূল্যে বিতরন করা হয়। যারা ICTP সম্পর্কে জানেন না তাদের বলি,আব্দুস সালাম ইতালির ত্রিয়েস্ত শহরে ICTP র প্রতিষ্ঠা করেন যার মূল উদ্দেশ্য পিছিয়ে পড়া তৃতীয় বিশ্বের ছাত্রদের বিজ্ঞানের মূল ধারার সাথে সংযুক্ত করা।
তার সম্মানার্থে এখন একে The Abdus Salam International Center for Theoretical Physics বলা হয়। আমাদের দেশ কিংবা আমাদের দেশের মত দরিদ্র দেশের ছাত্রদের জন্য ICTP তে সারা বছর বিভিন্ন কোর্সের আয়োজন করা হয়। আমার জানা মতে আমাদের দেশের ICTP তে কাজ করেছেন এমন কয়েকজনের মধ্যে আছেন ওয়াজেদ মিয়া,ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি অধ্যাপক হারুন-আর-রশিদ । সাম্প্রতিক সময়ে আমার এক পরিচিত বড় ভাই ICTP তে আছেন,যিনি রাবি থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পড়েছেন। এবার মূল কথায় ফিরে আসি,বইটার প্রথমেই আছে আব্দুস সালামের একটি সাক্ষাতকার,যার কিছু অংশ আমি আনুবাদ করলাম।
ICTP গঠনের পেছনে তার ব্যক্তিগত অনুপ্রেরণার কারণ এখানে কিছুটা ফুটে উঠেছে।
"আমার জন্ম জং গ্রামে,তখন যাকে বলা হত ব্রিটিশ ইন্ডিয়া,এখন পাকিস্তান, -এ ১৯২৬ সালে। আমার বাবা ছিলেন শিক্ষা দপ্তরের শিক্ষা আফিসার আর আমার মা ছিলেন গৃহিনী। আমার পরিবারকে কোন আবস্থায় ধনী বলা যাবে না। বাবা আমার পড়ালেখার ব্যাপারে খুব দেখাশোনা করতেন,আমাকে নিয়ে তার অনেক স্বপ্ন ছিল।
আমাকে তিনি একজন Indian Civil Service ক্যাডার হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন,কিন্তু আমার জীবনে হয়ত অন্যকিছু লেখা ছিল।
আমার মনে পড়ে,খুব সম্ভবত ১৯৩৬ সালে,যখন আমি স্কুলে ছিলাম তখন আমার শিক্ষক মৌলিক চারটি বলের ওপর লেকচার দিচ্ছিলেন। তিনি মহাকর্ষ দিয়ে শুরু করলেন। এবং যেহেতু আমরা সবাই মহাকর্ষ সম্পর্কে জানতাম তাই তিনি বলতে থাকলেন "তড়িৎ !! তড়িৎ নামের একটা বল আছে,কিন্তু সেটাকে আমাদের জং গ্রামে পাওয়া যাবে না,সেটা থাকে লাহোরে,১০০ মাইল পূর্বে"। আগে তিনি নিউক্লিয়ার বল কী,তা জানতেন না,কিছুদিন আগে তিনি নিউক্লিয়ার বল সম্পর্কে শুনেছেন তাই বললেন "এই ধরনের বল শুধু ইউরোপে আছে"।
আমার এই অভিজ্ঞতা শুধু আমার একার না,তৃতীয় বিশ্বে অধ্যায়নরত হাজার হাজার শিক্ষার্থীর।
যখন আমার বয়স ১৪ বছর,সব সময়ের সব রেকর্ড ভেঙ্গে আমি হাইয়েস্ট মার্ক পেলাম। বৃত্তি নিয়ে পড়ালেখা শুরু করলাম লাহোরের সরকারী কলেজে। আমার বয়স যখন ১৬ বছর তখন আমার প্রথম গবেষণাপত্র বের হল গণিতের জার্নালে,তবে আসল গবেষনার শুরু ক্যাম্ব্রিজে আসার পর।
আমি খুব ভাগ্যবান যা আমি ক্যামব্রিজে যাবার সুযোগ পাই।
সেই সময় যুদ্ধের কারণে বিখ্যাত Indian Civil Service নিয়োগের পরীক্ষা হল না। যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সারা প্রদেশে যুদ্ধের সাহায্যার্থে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন। যুদ্ধ শেষ হবার পর বেঁচে যাওয়া অর্থ দিয়ে ৫ জন ছাত্রকে বিদেশে পড়তে পাঠানো হল। ভারতের স্বাধীনতের প্রাক্কালে ১৯৪৬ সালে যে সকল জাহাজগুলো ভারতে আবস্থানরত ব্রিটিশদের নিয়ে ইংল্যান্ডের উদ্দেশ্যে পাড়ি দিচ্ছিল,সেই সব জাহাজের কোন একটাতে আমি চড়ে বসলাম। সেই বছর না যাওয়া হলে হয়ত কোনদিনই আমি ক্যাম্ব্রিজে যেতে পারতাম না কারণ তার পরের বছর ভারত-পাকিস্তান ভাগাভাগী হয়ে গেল আর সেই সাথে সেই বৃত্তিও বন্ধ হয়ে গেল।
ক্যাম্ব্রিজে দুই বছরের গণিতের তিনটি পেপারের প্রত্যেকটাতে আমি প্রথম হলাম। তৃতীয় বছরে আমি পদার্থবিজ্ঞানের তিনটি পেপার নেব নাকি গণিতের তিনটি পেপার নেব সেই ব্যাপারে আমার পূর্ণ স্বাধীনতা ছিল। আমার শিক্ষক ফ্রেড হয়েলের উপদেশ মতে আমি কেভেন্ডিস ল্যাবরেটরিতে কাজ করা শুরু করলাম কারণ তিনি বলেছিলেন "যদি তুমি ভবিষ্যতে তাত্ত্বীয় পদার্থবিদ হতে চাইলে তোমাকে অবশ্যই কেভেন্ডিস ল্যাবে কাজ করতে হবে,তা না হলে কখনও একজন তাত্ত্বীয় পদার্থবিদ কিভাবে কাজ করে তা দেখতে বা বুঝতে পারবে না"। এই কেভেন্ডিস ল্যাবেই রাদারফোর্ড পরমাণুর ওপর তার বিখ্যাত গবেষণা করেছিলেন।
১৯৫১ সালে আমি লাহোরে ফিরে আসলাম এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো শুরু করলাম।
কিন্তু পরে চিন্তা করে দেখলাম যে,এখানে একজন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে আমি বাইরের জগত থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। সাধারণ জার্নাল পাওয়াও এখানে কঠিন। আমি আমার বিষয়ের নতুন অগ্রগতি বা আবিস্কার সম্পর্কে কিছুই জানতে পারছিলাম না। তাই একজন পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে বেঁচে থাকার জন্যই দেশ ছাড়তে বাধ্য হলাম। বাইরের দেশের সাথে যোগাযোগের অভাবই উন্নয়নশীল দেশের বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বড় আভিশাপ।
এখানে উন্নত বিশ্বের মত সুযোগ কিংবা অর্থ কোনটাই নাই। এখানে গবেষণার ক্ষেত্রে ঐ সকল বিষয়ে চিন্তা করা বা কাজ করার মত লোকেরও অভাব আছে। আর এই সকল অসুবিধা থেকে শিক্ষা নিয়েই আমার মত যারা প্রতিবন্ধকতা নিয়ে কাজ করেছে তাদের সাহায্য করার জন্য ১৯৬৪ সালে ICTP স্থাপন করি। বিজ্ঞানীদের নিজেদের দেশে লম্বা সময় থাকার পাশাপাশি এখানে তিন মাস বা তার বেশি সময়ের গবেষনার সুবিধা পায়। এখানে একই বিষয়ে যারা কাজ করে তারা নিজেদের আইডিয়া শেয়ার করতে পারে এবং নিজ দেশে ফিরে গিয়ে দেশের বিজ্ঞান প্রযুক্তির উন্নয়নে কাজ করে।
আমার পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণাকালের সেরা সময় ছিল ১৯৭৯ সাল। এই বছর আমি শেলডন গ্ল্যাশো আর স্টেভেন ওয়াইনবার্গের সাথে নোবেল পুরস্কার পেলাম। আমরা তড়িৎচুম্বকীয় বল এবং দুর্বল নিউক্লিয় বলকে একত্রিকরণ করতে সফল হলাম যা এই শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ আবিষ্কার।
আমি বিভিন্ন সময় বলেছি যে,একটি উন্নয়নশীল দেশে গবেষণা করা কি কঠিন কাজ। আমি সবার কাছে একটা অনুরোধ করতে চাই।
উন্নয়নশীল দেশগুলোকে বুঝতে হবে যে এইসকল মানুষেরাই তাদের জাতীর মূল্যবান সম্পদ। তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ দিতে হবে,কেননা সেই দেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশের মহান দ্বায়িত্ব তাদের ওপরই বর্তায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যার যে,যারা থাকে তাদের মেধার সঠিক ব্যবহার করা হয় না। The goal must be to increase their numbers because a world divided between the haves and the have-nots of science and technology cannot endure in equilibrium.It is our duty to redress the inequity."
শেষ লাইনটা ইংরেজিতেই রেখে দিলাম কারণ এটার ভাল বাংলা মাথায় আসছে না। যাই হউক,এই মহান বিজ্ঞানী তার স্বদেশের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিকাশে অনেক কাজ করেছেন।
পরিশেষে একটা কথা না বললেই নয়। আব্দুস সালাম ছিলেন কাদিয়ানী,যাদের বেশির ভাগ মুসলমানেরাই মুসলমান বলে স্বীকার করেন না। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানে যখন কাদিয়ানীদের সরকারীভাবে অমুসলিম হিসেবে ঘোষিত করা হয় তখন তিনি এর প্রতিবাদে দেশ ছেড়ে চলে যান। পাকিস্তানে তার কবরের এপিটাফে লেখা "FIRST MUSLIM LAUREATE" থেকে MUSLIM শব্দটা মুছে ফেলা হয়। এর চেয়ে বড় দুঃখ আর কী হতে পারে ? আব্দুস সালামের ওপর রাগিব ভাইয়ের লেখা দেখতে পারেন এখানে।
তার ব্যক্তিগত জীবন এবং কিছু না জানা তথ্য পাবেন এখানে ।
ধৈর্য ধরে ব্লগটি পড়ার জন্য ধন্যবাদ।
আবুল হায়াত শিবলু
২৪ ডিসেম্বর ২০১০
ঢাকা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।