আব্দুস সামাদ আজাদ : একজন রাজনৈতিক অভিভাবকের স্মৃতিকথা
ফকির ইলিয়াস
======================================
‘এই প্রজন্ম একদিন সত্য ইতিহাস জানতে পারবে। একদিন তারাই ঢেকে দেবে সব আঁধারের কালিমা। এই প্রজন্মই একদিন বাস্তবায়ন করবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলাদেশের। ’ কথাগুলো প্রায়ই বলতেন বর্ষীয়ান জননেতা আলহাজ্ব আব্দুস সামাদ আজাদ। সেই প্রত্যয় বুকে নিয়েই তিনি আজ পরপারে।
তিনি চলে গেছেন চিরতরে। যে নিবাস থেকে কেউ কোনদিন আর ফিরে আসে না।
মনে পড়ে ১৯৭৩ সালের কথা। আমি তখন একজন কিশোর স্কুল ছাত্র। সিলেটের সারদা স্মৃতিভবনে এক সংবর্ধনা সভায় তার হাতে একগুচ্ছ ফুল তুলে দিয়েছিলাম।
সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের একজন রাজনীতিকের হাতে পুষ্পগুচ্ছ তুলে দেয়ার আনন্দ একজন কিশোরের কাছে তখন ছিল দিগ্বিজয়ের মতো। মনে হয়েছিল, একজন প্রথম সারির রাজনীতিক বোধ হয় অন্য কোন গ্রহের মানুষ।
না, জননেতা সামাদ আজাদ অন্য কোন গ্রহের মানুষ ছিলেন না। তিনি প্রায়ই বলতেন, ‘আমি গ্রাম থেকে উঠে আসা মানুষ। হাওর-বাওড় অধ্যুষিত সুনামগঞ্জ থেকে এসেছি।
গ্রামের মানুষের জীবন-প্রচলন আমার চাইতে কে ভালো বুঝবে। ’
দেশে এবং প্রবাসে অনেকবারই এই কিংবদন্তী নেতার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। কখনো জনসভায়, কখনো ঘরোয়া আড্ডায়, কখনো সাক্ষাৎকার গ্রহণে, কখনো মতবিনিময়ে। সামাদ আজাদের একটি কথা আমার বুকে খুব বাজতো। তিনি বলতেন ‘আমি তো বর্ধিত জীবন নিয়েই বেঁচে আছি।
আমি তো আমার সহযোদ্ধা তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের সহযাত্রী হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। ৩ নভেম্বর ’৭৫ই ছিল আমার মৃত্যু দিবস। কিন্তু মহান করুনাময় আমাকে জালেমদের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন। ’
সেই গণমানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা ২৭ এপ্রিল ২০০৫ তাঁর বর্ধিত জীবনেরই অবসান ঘটিয়ে চলে গিয়েছেন পরপারে। চলে গেছেন একজন রাজনৈতিক অভিভাবক।
বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের এক চরম ক্রান্তি লগ্নে হাল ধরেছিলেন আব্দুস সামাদ আজাদ। জাতির জনক হত্যাকান্ড, জেল হত্যাকান্ড, সামরিক শাসনের দাঁতাল পেশীশক্তি যখন আওয়ামী লীগকে ভীষণ দুর্বল করে তুলেছিল তখন লীগের অনেক নেতাই হয়ে পড়েছিলেন কিংকর্তব্যবিমূঢ়। সে সময়ে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন সামাদ আজাদ। তাঁর অসম ধৈর্য, প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতার ফলেই ১৯৭৮-৭৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ প্রাণ পেতে শুরু করেছিল পুরোমাত্রায়। সে সময়ে গ্রামে গ্রামান্তরে তিনি আপামর জনসাধারণকে যে সাহসটি তার বক্তব্যে দিয়ে বেড়াতেন তা হচ্ছে, আওয়ামী লীগকে কেউ ষড়যন্ত্র করে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না।
মুজিব হত্যার বিচার বাংলাদেশে হবেই। তাঁর সে স্বপ্ন যে বাস্তবতার পরশ পেয়েছে তা বাংলাদেশের জনগণ শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করবেন।
দুই.
প্রবাদপ্রতিম এই জননেতাকে ঘিরে অনেক কথাই আজ মনে পড়ছে। ১৯৮৯ এর ঘটনা। বাংলাদেশে স্বৈরশাসক এরশাদ শাহীর শাসনের টালমাটাল সময়।
যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসীরা বাংলাদেশে স্বৈরশাসন অবসানের লক্ষ্যে তীব্র আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। সামাদ আজাদ তখন যুক্তরাষ্ট্র সফরে এসেছেন। নিউইয়র্কের কার্ডিনাল স্পেলম্যান সেন্টারে তিনি প্রবাসীদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হয়েছিলেন। সে সভায় তিনি স্পষ্ট বলে ছিলেন ছাত্রজনতার গণঅভ্যূথানেই এরশাদ সরকারের পতন হবে শীঘ্রই। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু এরশাদ তো বলেই যাচ্ছেন তাকে কোন শক্তিই সরাতে পারবে না।
সামাদ আজাদ বলেছিলেন, কোন শক্তি তাকে সরাবে- তা সময় এলেই তিনি দেখতে পারবেন। ৯০এর গণঅভ্যূথানে এরশাদ সরকারের শোচনীয় পতন ঘটেছিল।
আব্দুস সামাদ আজাদ সিদ্ধান্ত নিতেন অত্যন্ত বিচক্ষণতার সাথে। একজন সফল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে কিংবা ৯৬ পরবর্তী সময়ে তিনি যে আন্তর্জাতিক দক্ষতা দেখিয়েছিলেন তা ছিল প্রণিধানযোগ্য। তাঁর পররাষ্ট্রমন্ত্রীকালীন সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, চীন, ইংল্যান্ড, ফন্সান্স, জার্মানীসহ বিভিন্ন দেশগুলোর সাথে যে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল- তা বিদেশের এসব দেশে রাজনীতিকরাও স্বীকার করেছেন অকপটে।
আজো স্মরণ করছেন শ্রদ্ধার সাথে।
তিনি বলতেন, চলমান বিশ্ব হচ্ছে কুট-কৌশলের ক্ষেত্র। আর তাই বাংলাদেশকে এগিয়ে যেতে হলে সেই কুটনৈতিক বিচক্ষণতাকে সামনে রেখেই। মডার্ণ গ্লোবাল ভিলেজের সাথে সঙ্গতি রাখতে হবে।
১৯৯৪ সালের কথা।
আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সিলেটের এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা দিয়ে সন্ধ্যায় সিলেট সার্কিট হাউসে সাংবাদিকদের সাথে এক মতবিনিময় সভায় মিলিত হন। সে মতবিনিময় সভায় আমার উপস্খিত থাকার সুযোগ হয়েছিল। আমি জননেত্রী শেখ হাসিনাকে একটি প্রশ্ন করতেই ছাত্রলীগের কিছু তরুণকর্মী আমাকে থামিয়ে দেবার চেষ্টা করেন। কারণ প্রশ্নটি ছিল আওয়ামী লীগের আভ্যন্তরীন কোন্দল ও সংস্কার বিষয়ে। মনে পড়ছে, সামাদ আজাদ সাথে সাথেই ঐসব তরুণ কর্মীদের কে হাত উঠিয়ে থামতে বলেছিলেন।
তিনি জোর গলায় বলেছিলেন ‘ফকির ইলিয়াস-কে প্রশ্ন করতে দাও। ’ সাথে সাথে দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনাও বলেছিলেন- হ্যাঁ আপনি প্রশ্ন করুন। আমি সব কথা শুনতে চাই এবং জবাব দিতে চাই। ’ সামাদ আজাদের মুক্ত মানসিকতা ছিল অত্যন্ত বিশাল। তিনি বলতেন পাহাড় সমান সমস্যা আসবেই।
তা মোকাবেলা করে এগিয়ে যাওয়ার নামই তো জীবন। আর রাজনীতিতে সৃজনশীল ভিন্নমতকে গুরুত্ব দিয়েই এগিয়ে যেতে হবে।
তিন.
২০০০ সালে নিউইয়র্কের এস্টোরিয়া ওয়ার্ল্ড ম্যানরের বিলাসবহুল বলরুমে তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদকে এক বর্ণাঢ্য নাগরিক সংবর্ধনা প্রদান করেছিলেন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী বাঙালীরা। সেই সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘সত্যই হচ্ছে একজন মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় শক্তি। আমি আজীবন সত্যের পক্ষেই গণমানুষের স্বার্থের জন্য সংগ্রাম করে গেছি।
’ সেই সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে একান্ত আলাপচারিতায় তাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম একজন রাজনৈতিক হিসেবে আপনার এই অগ্রজ সময়ে একান্ত ভাবনাগুলো কি? সহাস্যে জবাব দিয়েছিলেন, আমি একজন জনপ্রতিনিধি হিসেবেই মৃত্যুবরণ করতে চাই। অবসরে গিয়ে জনবিচ্ছিন্ন হতে চাই না। মহান সর্বশক্তিমান তাঁর ইচ্ছে পূরণ করেছেন। জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব পালন কালেই তিনি মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছেন। দেশ ও জনগণের দেয়া পবিত্র আমানতী দায়িত্ব পালনকালেই তিনি চলে গেছেন পরপারে।
সামাদ আজাদ যখনই যুক্তরাষ্ট্রে কোন সফরে এসেছেন তখন ম্যারিয়ট, প্লাজা কিংবা গ্র্যান্ড হায়াট হোটেলের কনফারেন্স রুমে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়েছেন। আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘ফকির ইলিয়াস তো বেশি বেশি প্রশ্ন করবে। তাই তার প্রশ্ন উত্তর দিয়েই সাংবাদিক সম্মেলন শেষ করবো। ’ তাঁর উত্তরে যেমন যুক্তি থাকতো-তেমনি থাকতো ঐতিহাসিক উদাহরণ। প্রশ্ন করলে পাশ কাটিয়ে যেতেন না তিনি।
জবাব দিতেন সরাসরি। যা একজন বরেণ্য রাজনীতিক দ্বারাই সব সময় সম্ভব হয়। সম্ভব হয় সেই রাজনীতিকের প্রাজ্ঞতার চেতনার আলোকে।
তাঁর ৬৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনে ৫১ বছরই তিনি ছিলেন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি। তাঁর এই সংগ্রামী জীবনের গৌরবোজ্জ্বল অবসান হয়েছে।
কিন্তু থেকে গেছে তাঁর কর্ম। তাঁর চেতনা। তাঁর আদর্শ। আজ যারা তরুণ রাজনীতিক- তারা সামাদ আজাদের ত্যাগী রাজনৈতিক আদর্শ অনুসরণ করলে উপকৃত হবেন, সন্দেহ নেই। তাঁর মহত্বই হতে পারে একজন অনুসারী রাজনীতিকের পাথেয়।
শেষ সাক্ষাৎকালে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, এখনো আপনাকে মিছিলের অগ্রভাগে শক্ত হাতে সারিবদ্ধ দেখা যায়। এতো শক্তি পান কিভাবে? উচ্চ হেসে জবাব দিয়েছিলেন, আমার বাহুতে হাত দিয়ে দেখো- এই শক্তি বাংলার কৃষক-শ্রমিক-মজলুম জনতার।
হ্যাঁ, সেই অসীম শক্তির অধিকারী ছিলেন সামাদ আজাদ। বীর সেনানীর মতোই তিনি চলে গেছেন- বাংলার মানুষকে কাঁদিয়ে, বাঙালী জাতির হৃদয় শূন্য করে। তাঁর ঐতিহাসিক কর্মজীবন ব্যাপকভাবে আলোচিত হোক।
তাঁর কর্মযজ্ঞ ধারণ করা হোক রাজনীতি, সাহিত্য, সংস্কৃতি, শিল্পের বড় বড় ক্যানভাসে। তিনি অমর হয়ে থাকবেন। যতোদিন থাকবে এই বাংলা, এই বাঙালি জাতি। #
---------------------------------------------------------------------
দৈনিক উত্তরপূর্ব / সিলেট / ২৭ এপ্রিল ২০১০
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।