মেহরিন সাদিয়া সুমি
মূল : ভেরোনিক তজো
অনুবাদ : রফিক-উম-মুনীর চৌধুরী
তাঁর জাদুবিদ্যার শক্তিমত্তা ও সৌন্দর্যের কাহিনী ছড়িয়ে পড়েছিল সবখানে। গুপ্তবিদ্যাসংক্রান্ত তাঁর জ্ঞানের কোনো সীমা-পরিসীমা ছিল না।
দূর-দূরান্ত থেকে সবাই ছুটে এল তাঁর সাক্ষাতের আশায়। বলা হচ্ছিল, তিনি করতে পারেন না এমন কিছু নেই। লোকজন বিশ্বাস করল, চিরন্তন সুখের সমাধান-সূত্রটা তাঁর জানা।
তিনি নিজেও দাবি করতেন, এই অলৌকিক ক্ষমতাটা তাঁর আছে। 'সুখ', তিনি বলেন, 'হলো সুখের অনুপস্থিতি।
চোখ বন্ধ করে কি তুমি হাঁটতে পারো? অনন্ত জীবনের জন্য কি তুমি ঘুম দিতে পারো? নীরবতা কি তোমার নাগালে?'
লোকজন অবাক হয়। তাঁর এসব কথাবার্তার কোনো আগামাথা খুঁজে পায় না তারা। 'সুখ হলো প্রেম, অর্থ আর ক্ষমতা' তারা জোর গলায় বলে।
তাঁর কাছে তারা আসে এই আশায় যে এ বিষয়গুলোর যেকোনো একটি তারা করায়ত্ত করতে পারবে। দুর্ভাগ্যবশত কোনোটিই মেলে না।
ফলত, বহু লোকজন হতাশ হয়। তারা তাদের নিজেদের এলাকায় ফিরে গিয়ে বন্ধুদের বলে যে লোকটা একটা শঠ। 'কল্পনা করতে পারো?' 'আমরা ১০ দিন ধরে অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত তাঁর সাক্ষাৎ পেলাম, আর ব্যাটা আমাদের খালি হাতে ফিরিয়ে দিল।
'
অন্যরা ওদিকে তাঁর কাছাকাছি পড়ে থাকে এই আশায় যে তাঁর গুপ্তবিদ্যার ব্যাপারস্যাপার তারা জানবে, বুঝবে। হয়তো এরা খুব অসুখী যে তাদের আসলে কোনো যাওয়ার জায়গা নেই। তাদের সব কিছু তাঁকে কেন্দ্র করে, তাঁর ওপর তারা পুরোপুরি নির্ভরশীল। তিনি হাত তুললেই হলো, অমনি তারা ওই হাত তোলার মারফতিটা বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করে।
নিজেদের মধ্যে তারা আলোচনাসভা বসায়, গোল হয়ে বসে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু করে।
তাঁর সব গতিবিধির পেছনে কি গূঢ় ব্যাপার আছে সেটা জানতে তারা প্রাণান্তকর চেষ্টা চালায়। তিনি মাথা চুলকালেন কি কাশি দিলেন বা হাই তুললেন কিংবা আঙুলে মটকা ফুটালেন, অমনি এই শিষ্যরা ওটা খেয়াল করেন। কেউ কেউ আবার তাঁর ছবিও আঁকেন।
তিনি কোনো প্রশ্নের উত্তর দেন না কখনোই, আর এই কারণে তাদের উত্তেজনা আরো বেশি।
তর্ক-বিতর্ক চলছে এই রকম এক সন্ধ্যায় হঠাৎ মাঝপর্যায়ে এসে হাজির হয় মেয়েটি।
জাদুকর এই মাত্র ঘুমাতে চলে গেছেন আর তাঁর শিষ্যরা গোল হয়ে বসে আছে, তাঁর হাই তোলা নিয়ে কথা হচ্ছে :
'গুরু বিশ বার হাই তুলেছেন। '
'না! একুশ বার, আমি গুনেছি!'
আবার হৈচৈ, নতুন করে আবার তর্ক-বিতর্ক।
মেয়েটি এক জাদুকর পরিবারের সন্তান। তার বাবা ছিল জাদুকর আর তার মায়ের অসাধারণ অলৌকিক ক্ষমতা। ঘরের পেছনটায় বসে এক এক করে সবার কথা সে শুনল, এরপর সে সুযোগটা নেবে বলে সিদ্ধান্ত নিল।
পরদিন সকালে, মেঝের মাঝখানটায় পা দুটো আড়াআড়ি রেখে বসে, তার সব জীবন-শক্তিকে সে নিজের মধ্যে নিয়ে এল। চোখ বন্ধ করল সে। যখন সে অনুভব করল যে সে তৈরি, হঠাৎ চোখ খুলে সে তাকাল। জাদুকরটি ঠিক তার সামনে দাঁড়ান, তাকে দেখছে। মেয়েটি অপেক্ষা করল।
জাদুকর হাত বাড়ায়। 'তুমি কী চাও?' তিনি মেয়েটিকে জিজ্ঞাসা করেন। 'তুমি এখানে কী করছ?'
'আমি জানি না, আমি ঠিক বলতে পারব না। '
'তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি সুখী। তোমার মুখটা উজ্জ্বল আর তোমার শক্তি মানুষকে টানে।
যদি তুমি না পারো, তাহলে তোমার যা আছে তা হারাবে। '
'আমি চেষ্টা করতে চাই। আমার আনন্দের প্রকৃতি আমার জানা নেই। এটা আসে আর চলে যায়। কিছুই মনে হয় থাকে না।
সব বদলে যায় আর আমি কেমন একটা ঘূর্ণির মধ্যে আটকে পড়ি। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে ফারাকটুকু আমি ধরতে পারি না। '
কিছুক্ষণ সব চুপচাপ। এরপর জাদুকর মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হেসে বলে : 'আমি বুঝি। আমাকে অনুসরণ করো, কিন্তু কোনো প্রশ্ন নয়।
'
তারা একটা ভুলভুলাইয়ায় প্রবেশ করে। মেয়েটা জাদুকরের পাশে। মেয়েটা জানে না তারা কোথায় যাচ্ছে এবং এটা হলফ করেই বলা যায়, একা একা এই পথে সে কোনো দিনই ফিরতে পারবে না। ওর একটু ভয় করে।
ভারী পর্দা দিয়ে ঢাকা একটা ঘরে তারা পৌঁছায়।
পর্দাগুলোর পেছনে আদৌ কোনো জানালা আছে কি না, সে কথাই ভাবছিল মেয়েটি। নির্জন শান্ত একটা ভাব ঘরটা জুড়ে। কেমন খালি খালি। আসবাবপত্র বলতে কিছু নেই।
জাদুকর তার কাছে আসে, তার কাঁধের ওপর হাত রাখে এবং চুমু খায়।
পরে লোকটির নগ্ন গায়ে মেয়েটি আঙুল দিয়ে পরশ বুলায়, যে লোকটি তার সঙ্গে একটু আগে সঙ্গম করেছে এমনভাবে যেন জাদু। মেয়েটি লোকটির গলার পেছনটায়, শরীরের বাঁক খাওয়া পেছনের অংশে, উরুতে আদর করে। সে অনুভব করে তার শরীরের প্রতিটি কোষ, প্রতিটি অণু-পরমাণু কাঁপছে। লোকটি চুপচাপ ঘুমাচ্ছিল।
মেয়েটি তাঁর পাশ থেকে সরে যায়, কপালে হাত রাখে এবং মাথার খুলিটি খোলে।
ভেতরে তাকিয়ে সে ভয়ে শিউরে ওঠে।
দুঃখ আর নিঃসঙ্গতায় পরিপূর্ণ এক মরুভূমি। দেখে মনে হয় যেন এক যুদ্ধক্ষেত্র। ওখানটায় আছে পরিখা আর বাক্সভর্তি কার্তুজ। মাটিতে পড়ে আছে অগুনতি লাশ।
সে কেন এল এই কথা ভেবে অনুতপ্ত হয় এবং ভারাক্রান্ত মনে বের হয়ে যেতে শুরু করে, যখন দূরে একটা হ্রদ দেখতে পায় সে এবং হ্রদ ছাড়িয়ে একটা সমভূমি যেখানটায় ঘাস যেন দুরন্ত সবুজ আর হাসছে। সমৃদ্ধ এক পৃথিবী ওখানটায়।
মেয়েটি খুলি বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ে।
এরপর থেকে, উপত্যকায় পৌঁছানোর একটা উপায় বের করার চেষ্টায় মেয়েটির দিন কাটে- যেটা তার মনের দিগন্তে ছড়িয়ে আছে। সে ঘাসে ডিগবাজি খেতে চায়, ভেজা, উষ্ণ আর ভরসা-জাগানো মাটির তীব্র গন্ধ নিতে চায়।
সে মরিয়া হয়ে ওঠে।
জাদুকরের সঙ্গে সে সকাল-সন্ধ্যা কাটায়, থাকে। জাদুকরের বিরামহীন হাই তোলা এড়ানোর জন্য সে তাকে গল্প শোনায়। গল্পগুলো মেয়েটি বেশির ভাগ সময়ই তাৎক্ষণিকভাবে ফাঁদে। জাদুকর জোরে হেসে ওঠেন তার গল্প শুনে আর মেয়েটি মজা পায়, হাসতে হাসতে মাথা পেছনে হেলে পড়ে।
গলাটা মনে হয় ছিটকে পড়ে যাবে পেছনে, এই ভেবে মেয়েটির ভয়ও হয়; কিন্তু তার সবচেয়ে বেশি ভয় জাদুকরের ভারবহ অতল নীরবতা নিয়ে, যা তার মাথার মধ্যে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হয় বন্য ঘোড়ার হুড়োহুড়ির আওয়াজের মতন।
মেয়েটি আবার খুলির ভেতর ঢোকার কথা ভাবে। শেষবারের ভ্রমণের আগে, নিজেকে সে সতর্কভাবে প্রস্তুত করে। তাকে সাবধান হতে হচ্ছে। তার সব ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে তাকে।
তাই মেয়েটি একটি ডিম ভাঙে, তিনবার মুখ ধোয় এবং ঘুমন্ত লোকটির কাছে যায়। তার কপালে হাত রেখে তার খুলিটা খোলে।
সে খুব সযত্নে হাঁটে; কিন্তু কাঁটা লেগে তার কাপড় ছিঁড়ে যায় এবং একটা খাদে পড়ে গিয়ে ব্যথা পায়। কিন্তু মাটিতে পুঁতে থাকা কার্তুজগুলো সে সাবধানে এড়িয়ে যেতে পারে এবং লাশের পচা গন্ধে নাক-মুখ চেপে এগোয়। অবশেষে হ্রদটায় পৌঁছায়।
এরই মধ্যে প্রচণ্ড গরমে পানির পিপাসা পেয়েছে তার।
হ্রদের পাড়ে বসে দুই আঁজলা স্বচ্ছ পানি পান করে। হালকা একটা বাতাস বইছে। অন্যদিকে যত দূর চোখ যায় কেবল উপত্যকার বিস্তার।
একটু একটু করে শক্তি ফিরে পাওয়ার পর মেয়েটি একটা লম্বা শ্বাস নিয়ে ডুব দেয়।
বিছানায় জাদুকরের শরীর দুলে ওঠে। ঘুমের মধ্যে সে এপাশ-ওপাশ করে এবং খানিকটা চোখ খোলে। ঘরের চারদিকে তাকায় এবং কয়েক মুহূর্ত পর লাফ দিয়ে বিছানা ছেড়ে ওঠে। মেয়েটি উধাও। ভুলভুলাইয়ার প্রবেশমুখে গিয়ে সে মেয়েটিকে ডাকতে থাকে।
এক অপার্থিব শক্তি হ্রদের একেবারে তলায় মেয়েটিকে টেনে নিয়ে যায়। গভীর থেকে গভীর তলদেশে যে সে ডুবে যাচ্ছে মেয়েটি সেটা টের পায়। তার মুখ, কান, নাকের মধ্যে পানি ঢুকে যাচ্ছে অনরবত। শৈবালের নাচ দেখতে পায় সে। সে চিৎকার করে ডাক দিতে পারে না।
সে শুধু তটের কথা ভাবতে পারে।
[লেখক : আইভরি কোস্টের দেশটির ভাষা ফরাসি। লেখিকা ভেরোনিক তজো'র জন্ম ১৯৫৫ সালে। প্যারিসে জন্ম নিলেও বড় হয়েছেন নিজ দেশের আবিদজানে। লেখাপড়া এখানেই।
ইংরেজি সাহিত্যে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে পড়াশোনা আবিদজানে, এরপর প্যারিসের সরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি। সমকালীন আফ্রিকান সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ লেখিকার সাড়া জাগানো উপন্যাসটির নাম অ্যাজ দ্য ক্রো ফ্লাইস। অনূদিত গল্পটি তাঁর নিজের করা ইংরেজি অনুবাদ অবলম্বনে। ]
উৎস: http://www.bangladeshinfo.com/golpo.php
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।