আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জাদুকর (গল্প)



আমার সবকিছু খুবই সাধারণ। আমি সাধারণ মানের ছাত্র, উচ্চতা সাধারণ, চেহারা মোটামুটি চলনসই, কোনো বিশেষত্ব নেই; এমনকী আমার চলাফেরা, পোশাক সবকিছুই খুবই সাধারণ। একটু অসাধারণত্ব অর্জনের জন্য, সবার থেকে একটু আলাদা হওয়ার জন্য, সবার নজরে আসার জন্য কত কিছুই যে আমার করতে ইচ্ছে হতো! কিন্তু আর সবকিছুর মতো আমার মনটাও ছিল সাধারণ, তাই মনে মনে অনেক কিছু করার ইচ্ছে থাকলেও উদ্যোগের অভাবে শেষ পর্যন্ত কিছুই করা হয়ে উঠেনি। অথচ এই্ আমিই যে একদিন এতোটা অসাধারণ হয়ে উঠবো তা কী দু:সপ্নেও ভেবেছিলাম! এখন আমি এতোটাই অসাধারণ যে একেবারেই সবার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এতোটা অসাধারণ হতে আমি চাইনি।

একেবারেই চাইনি। মফস্বলের কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ পেলাম তখন নিজেকে রীতিমতো কেউকেটা মনে হচ্ছিলো। আমাদের ছোট শহরে আমি ছিলাম নামকরা ভালোছাত্র। অথচ, ঢাকায় এসে দেখলাম এখানে আমি একেবারেই সাধারণ মানের একজন। শুধু তাই নয়, মাত্র দুটি প্যান্ট আর তিনটি সার্ট সম্বল করে হলে উঠার পর দেখলাম অন্যান্য ছাত্ররা কেমন ঝলমলে পোশাক পরে ক্লাশে যায়, বিকেল বেলা টিএসসিতে আড্ডা দেয়।

নিজেকে নিয়ে বিব্রত আমি সব সময়ই লজ্জায় কুঁকড়ে থাকি। এর মধ্যেই ডিপার্টমেন্ট এবং হলে কিছু বন্ধু জুটে যায়। আমার মতোই ঢাকার বাইরে থেকে আসা, সাধারণ পরিবারের ছেলে। ক্লাশ চলতে থাকে; দূর থেকে সুন্দরী মেয়েদের দিকে তাকাই। ঝা চকচকে গাড়িতে সাবরিনা আমাকে লিফট দিচ্ছে-এমন একটা স্বপ্ন মাঝেমধ্যেই দেখি।

এসবের মাঝেও একটা কাজ নিয়মিত করে যাই, মন দিয়ে লেখা-পড়া। ফাস্টইয়ার ফাইনালের আগে লাইব্রেরিতে প্রচুর সময় কাটাতে থাকি। ইচ্ছে, ভালো রেজাল্ট করে সবার নজরে পড়া। কিন্তু ফল প্রকাশের পর বুঝতে পারি, ইউনিভার্সিটিতে ভালো ফল করতে হলে পাড়াশোনার পাশাপাশি টিচারদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে চলাটা অত্যন্ত জরুরী। মুখচোরা আমাকে দিয়ে তা কোনোভাবেই সম্ভব না।

শেষ অস্ত্রটিও হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পর রীতিমতো অসহায় বোধ করি। হলে প্রায় সবারই পিসি, ল্যাপটপ, আইপড এমনকী সেলফোনেও গান শোনা-ছবি দেখাসহ নানা ধরণের বিনোদনের ব্যাবস্থা আছে আজকাল। আমার একমাত্র বিনোদন বই পড়া। নীলক্ষেত থেকে কমদামে পুরান বই কিনে এনে হলে শুয়ে শুয়ে গোগ্রাসে গিলি। একদিন বই কিনতে গিয়ে দেখলাম অদ্ভুত এক জিনিস।

জাদুকর মজনু মিয়া রাস্তার পাশে ফুটপাতে জাদু দেখাচ্ছে। দর্শকদের বেশিরভাই খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের মানুষ। ম্যাজিকের উপর কিছু পড়াশোনা ছিল বলে আমি বুঝতে পারি মজনু মিয়া একজন প্রথম শ্রেণীর জাদুকর। এরকম গুণী লোকের রাস্তায় রাস্তায় জাদু দেখানোর কথা না। পামিংয়ে রীতিমতো উস্তাদ মজনু মিয়া।

এ ছাড়া ও হাতসাফাই এবং সম্মোহনের কৌশলে রয়েছে তার অসাধারণ দক্ষতা। মজনু মিয়ার সঙ্গে কথা বলার জন্য প্রচন্ড আগ্রহ অনুভব করি। খেলা শেষে দর্শকদের কাছ থেকে সংগ্রহকরা টাকা বাক্সে ভরছিলো মজনু মিয়া। গিয়ে সামনে দাঁড়াই। -ভাই কিছু মনে না করলে আপনার সঙ্গে দুটো কথা বলতাম।

ফুটপাতের ফ্লাস্কের চায়ে চুমুক দিয়ে মজনু জিজ্ঞেস করে -কী কথা? -এই মানে জাদু নিয়ে। আজকে আপনি যে খেলা দেখালেন। অনেক উস্তাদ জাদুকরও এমনটি পারবে না। আমাকে জাদু শেখাবেন? শেষের বাক্যটি নিজের অজান্তেই মুখ ফসকে বেড়িয়ে পড়ে। কথাটি বলেই আমি চমকে উঠি।

আরে, তাইতো! যদিু দিয়েইতো সবাইকে মাত করে দেওয়া যাবে। মজনু মিয়ার দশ ভাগের একভাগ কৌশল আয়ত্বে আসলেও নাম-ডাক হতে সময় লাগবে না। এ ছাড়া সৌখিন শো করে বেশ দু-পয়সা আয় করা যবে! আমি যখন এসব সাত-পাঁচ ভাবছি, তাকিয়ে দেখি মজনু আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হাসছে। যেন আমার ভাবনাগুলো পড়তে পারছে। তাহলে কী সে থট রিডিংও জানে! চমকে উঠি।

কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মজনু বলে উঠে, -থট রিডিং কিনা জানিনা, তবে আমি চেষ্টা করলে মনের কথা পড়তে পারি। আর হ্যাঁ জাদু শেখার ব্যপারে যেটা বলছিলেন, ভুলে যান। আমি কাউকে শেখাই না। আর কথা না বাড়িয়ে চায়ের দাম দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মজনু। আমি দ্রুত এগিয়ে যাই।

নাছোড়বান্দার মতো বলি, -মজনু ভাই আমাকে শেখাতেই হবে। কোনো কথা শুনবো না। আমার দিকে ঠান্ডা দৃষ্টি দিয়ে কাঠের বাক্সটা হাতে নিয়ে পা বাড়ায় মজনু, যেন সব কথা এখানেই শেষ। কিন্তু আমি ছাড়ার পাত্র নই। সেদিন অনেক ঝামেলা করে তার পিছু নিয়ে আস্তানাটা চিনে আসি।

এর পর থেকে জাদু শেখার নেশা আমাকে পেয়ে বসে। সায়দাবাদে মজনুর ভাড়া করা ঘুপচি ঘরে সকাল-বিকেল ধর্না দিতে থাকি। কিন্তু ফলাফল শূণ্য। মজনুর মন গলে না। এভাবেই আবিষ্কার করি রাস্তায় রাস্তায় জাদু দেখিয়ে বেড়ানো মজনু বেশ শিক্ষিত।

তার ঘর ভর্তি বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় লেখা জাদুর বই। কৌতুহল নিয়ে দু-একটি ইংরেজি বই ঘেটে দেখেছি। পাতার মার্জিনে গোটা গোটা হরফে ইংরেজিতে কমেন্ট লিখে রেখেছে মজনু। শিক্ষিত একজন লোক কেন এভাবে খেয়ে না খেয়ে প্রচন্ড অর্থকষ্টে ভুগে রাস্তায় রাস্তায় জাদু দেখায়, এটা আমার কাছে বিরাট রহস্য। মজনুর বাড়িতে আমার আসা যাওয়াটা এতোটাই স্বাভাবিক হয়ে গেছে যে মাঝে মধ্যে আমাকে ঘরে রেখেই কাজে বেড়িয়ে যায় মজনু।

এমই একদিন আবিষ্কার করি সুদৃশ্য বাক্সটা। কাঠের তৈরি ছেট্টা বাক্সটার প্রায় পুরোটাই কারুকাজ করা পেতলে মোড়ানো। খুব নজর দিয়ে দেখলে বোঝা যায় পেতলের গাড়ে ছোট ছোট হরফে অজানা কোনো ভাষাতে কিছু লেখা আছে। অনেক চেষ্টা করে একবর্ণেরও মর্ম উদ্ধার করা গেল না। বাক্সটা হাতে নিতেই সেটা আমাকে চুম্বকের মতো আকর্ষণ করতে থাকে।

আমার কেবলই মনে হয় এক্ষুণি এটা খুলে দেখা দরকার। বাক্সের মধ্যে কী আছে তা জানার জন্য তীব্র এক নিষিদ্ধ কৌতুল আমাকে পেয়ে বসে। ঘরের এদিক সেদিক হাতড়াতে থাকি চাবির জন্য। সেদিন বোধহয় সব কিছুই আমার অনুকুলে ছিল। নয়তো এতো সহজেই চাবিটও পেয়ে যাবো কেন? যাই হোক, কাঁপা কাঁপা হাতে বাক্সটা খুলি।

ভেতরে হলদেটে হয়ে যাওয়া অতি পুরাতন একটি বই। উপরের প্রচ্ছদসহ ভেতরের লেখাগুলো সবই হাতে লেখা। বইয়ের মধ্যে বেশ কিছু ছবিও রয়েছে, এগুলোও হাতে আঁকা। প্রচন্ড কৌতুহল নিয়ে ভূমিকাটি পড়তে শুরু করি। অতি প্রাচীন ভাষায় টানা হাতে লেখা।

বেশ কষ্ট হয় পড়তে, যেটুকু মর্ম উদ্ধার করতে পারি তা হচ্ছে, "...পূর্বানুমতি ব্যতিরেকে এই পুস্তক পঠন গুরুতর অপরাধ বলিয়া গণ্য হইবেক। ইহার মর্ম উদ্ধারে অকৃতকার্যতা সমূহ বিপর্যয় ঘটাইবার আশঙ্কা রাখে...." এটুকু পড়ে কৌতুহল আরো বেড়ে যায়। সাবধানে বইটি বের করে হাতে নিয়ে খালি বাক্সটি তালা দিয়ে আগের জায়গায় রেখে বেড়িয়ে পড়ি। গভীর রাতে হলে সবাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর সন্তর্পণে বইটি বের করে পড়তে শুরু করি। অদ্ভুত ভাষায় লেখা তুলটে কাগজের এই বইটির পাঠোদ্ধারে বেশ বেগ পেতে হয়।

কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই বুঝতে পারি আমার হাতে স্বর্ণের খনি এসে গেছে। এই বইটিই মজনুর যাবতীয় সাফল্যের চাবিকঠি। ভোররাতের দিকে বইটি রেখে ঘুমাতে যাই। আদ্ভুত স্বপ্ন দেখে ঘুম ভেঙ্গে যায়। মজনু ক্রোধউন্মত্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

কিছুই বলছে না, কিন্তু সেই দৃষ্টি কতোটা নির্মম, নিষ্ঠুর বলে বোঝানো যাবে না। ঢক ঢক করে এক গ্লাস পানি খেয়ে ধাতস্ত হই। পরদিন রুমমেটরা বেরিয়ে গেলে আবার বইটি নিয়ে বসি। এতে অনেকগুলো জাদুর কৌশল দেওয়া আছে। আপাত দৃষ্টিত অদ্ভুত এবং আজগুবি মনে হলেও আমার মন বলছে এগুলো অব্যর্থ।

প্রথমেই আমি পরীক্ষার জন্য বেছে নেই অদৃশ্য হওয়ার জাদু। কিন্তু এই জাদু পরীক্ষার জন্য উপকরণের তালিকা দেখে মনটা দমে যায়। এসব উপকরণ কিনতে হলে এই মাসের পুরো বাজেট শেষ হয়ে যাব। কিন্তু কৌতুহল তখন আমাকে এতোটাই পেয়ে বসেছে, আগে-পিছে কিছুই চিন্তা না করে ঝাঁপিয়ে পড়ি। নাওয়া-খাওয়া ভুলে রাত দিন এক করে টানা পাঁচদিন খেটে সবগুলো উপকরণ যোগার করি।

এমনকী সেই পোস্তগোলা শ্মসানে গিয়ে মৃত মৃত কুমারী মেয়ের পাঁজরের হাঁড়, স্বর্ণকারের দোকান থেকে একগাদা টাকা খরচ করে স্বর্ণের গুড়ো ছাড়াও কবিরাজি, হেকিমি এবং ইউনানী ওষুধের দোকান থেকে বাকী উপকরণগুলো যোগার করতে হয়েছে। নির্জন স্থানে এই জাদুটি পরীক্ষার জন্য বলা হয়েছে। তাই অনেক ভাবনা-চিন্তা করে সবকিছু পোটলা বেঁধে রাত একটু গভীর হতেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের দিকে রওনা হই। নির্জন জায়গা দেখে বসে পড়ি। এর পর একটি মোমবাতি জ্বালিয়ে বইয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী এক একটি স্তর পার হতে থাকি।

আধঘন্টার মধ্যেই সবকিছু শেষ হয়ে যায়। এবার চুপচাপ বসে থাকার জন্য নির্দেশ দেওয়া আছে। বসে থাকতে থাকতে বোধহয় মশার কামড় উপেক্ষা করেও ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। হঠাৎ একটি কন্ঠস্বরে ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ খুলে শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।

মোমের আলোয় আকৃষ্ট হয়ে দুটি পুলিশ এদিকেই আসছে। এখন তাদের কী ব্যখ্যা দেবো এই মানুষের হাড়গোড় আর আদ্ভুতসব উপকরণের! আমি কাঠ হয়ে বসে কুল কুল করে ঘামতে থাকি। কিন্তু আদ্ভুত ব্যপার হচ্ছে একেবারে কাছে এসেও পুলিশ দুটি আমাকে দেখতে পায়না। -মনে হয় কোনো গাঞ্জাখোরের কান্ড। আমগোরে দেইখা পলাইছে।

নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে অন্যদিকে চলে যায় পুলিশ দুটো। তাহলে! তাহলে কী আমি সত্যি আদৃশ্য হয়ে গেছি!! এ যে একেবারে অবিশ্বাস্য! সেই থেকে শুরু। আজো আমি অদৃশ্য। সুক্ষ শরীর নিয়ে ঢাকা শহরের অলিগলি তোলপাড় করে মজনুকে খুঁজছি। মাঝারি উচ্চতা, গায়ের রং উজ্জ্বল শ্যামলা, উপরের পাটির একটি দাঁত ভাঙ্গা।

কেউ তার দেখা পেলে জানাবেন। আমি মানুষ হতে চাই, রক্ত মাংসের অতি সাধারণ একজন মানুষ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।