আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডায়রি কথন

মিড টার্মের বন্ধটা যে একেবারে হানিমুন হয়ে যাবে তা কে ভাবতে পেরেছিল? এমনকি ভার্সিটিতে ভর্তির সময়ও কি সে ভাবতে পেরেছিল যে দুবছরের মাথায় তারই ভার্সিটির এক উঠতি জনপ্রিয় শিক্ষককে তার স্বামী হিসেবে পেয়ে যাবে ?? আজ থেকে দু বছর আগের কথা মনে পরে গেল রমার। কিভাবে প্রথম কথা হয় সেই মানুষটির সাথে যে আজকে তার স্বামী। ভর্তির প্রায় ৩ কি ৪ মাস পর হঠাতই দেখা হয় তার স্কুল জীবনের বন্ধু কিশোরের সাথে। দেখার সময় তো রমা চিন্তেই পারে নি। চিনবেই বা কি করে, কিশোর তো ৭ বছর আগেই ওই স্কুল ছেড়ে অন্য স্কুলে চলে গিয়েছিল।

তবু কিশোরই চিনেছে রমাকে। কথা হল। ৭ বছরের জমানো কথা তো আর সহজে শেষ হবার নয়। কিন্তু কথা যে থামাতেই হবে। স্যার চলে এসেছেন।

“ কি ব্যপার রমা, ক্লাস করবে না?” মোলায়েম গলায় কথাটা বললেন তমাল স্যার। আজকে আর সেই মানুষ তমাল স্যার নেই। সে আজ তমাল। নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিশোরকে যেতে হল। সে তো অন্য ডিপার্টমেন্টে।

“তোমার নাম্বারটা দেবে, রমা?” বলল কিশোর। “আমার? আচ্ছা নাও। ” কাল কুচকুচে একটা বড় রকমের ডায়রী বের করল কিশোর, বেশ পুরানো যদিও। বেশ পুরানো। “ডায়রি লেখ তুমি?” বলল রমা।

“কিভাবে বুঝলে?” কিশোর। “বা রে। নইলে ২০১৩ তে এসে ২০০৭ এর ডায়রি ব্যবহার করবে কোন পাগল?” “তা ঠিক ধরেছ। হুম, তোমার চিন্তাশক্তি খুবই ধারাল দেখছি। আশাকরি তোমাকে শীঘ্রই কিছু এসাইনমেন্ট দিতে পারব।

জটিল সব ধাঁধাঁ। শার্লকেরও সাধ্য নেই জট ছাড়ায়। ” নাম্বার নিয়ে চলে যায় কিশোর। ক্লাসে ঢুকে রমা। কয়েক মিনিট দেরি হলেও এটেন্ডেন্স দিয়ে দেন তমাল স্যার।

ঐদিন রাতেই একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসে। ফোন ধরল রমা, “কে? কিশোর?” “না, আমি তমাল বলছিলাম। ” “কোন তমাল ? ” “তোমাদের টিচার। ” “ও স্যার, আপনি, এত রাতে?” “কেন খোঁজ খবর নিতে পারিনা?” “না না, তা নয়, মানে আপনি নাম্বার পেলেন কিভাবে আমি তো ভাবেই পাচ্ছি না। এই আরকি, একটু চমকে গেছিলাম।

” “কিশোরকে চেন?” “হ্যাঁ। ও তো আমার ফ্রেন্ড। ” “ওর কাছ থেকেই চেয়ে নিলাম। ” “ ওহ, তাই বলুন। ” ওভাবেই কথা শুরু।

আজ ১০ মিনিট, কাল ২০, পরে ২৫। এভাবে যেতে যেতে দুবছরের মাথায় বিয়ের প্রস্তাবই চলে আসে বাসায়। দুপক্ষই রাজি, তো আর কি লাগে, মিড টার্ম শুরু হতেই ধুম ধাম আয়োজন। আজ বিয়ে, পরদিন দুজনেই কক্সবাজার। অবশ্য এর মাঝখানে বেশ কয়েকদিন যে শর্মা হাউসে আর সিনাপ্লেক্সে যায় নি তা নয়, কিন্তু আজ তো স্বামী স্ত্রী হিসেবে ঘুরছে, আগে ঐ ফিলিংসটা ছিল না।

স্বামী ঘুমাচ্ছে। আর ঐসময় হোটেলের বারান্দায় বসে সাগরসৈকতের মনোরম রূপ দেখতে দেখতে ভাবছিল রমা। আর কত কি যে ভাবছে, তার ইয়ত্তা নেই। মাঝে মাঝে লজ্জায় রাঙ্গাও হয়ে উঠছিল। এমন সময় কলিংবেলটা বেজে ওঠে।

নিতান্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠল রমা। হোটেলের বয় এসেছে। রমার নামে একটা পার্সেল এসেছে কুরিয়ারে। পার্সেলটা নিয়ে ঘরে ঢুকেই আবার বারান্দায় এসে বসে রমা। পার্সেলটা খুলতেই একটা ডায়রি।

তাও আবার পুরানো। “কেউ দুষ্টুমি করল নাকি? কিন্তু ডায়রিটাও তো পরিচিত মনে হচ্ছে। ” ভাবছে রমা। হঠাতই মনে পরে গেল। ২০০৭ সালের ডায়রি।

কিশোরের হাতে অমন একটা ছিল যেদিন প্রথম কিশোরের সাথে কথা হয়। আচ্ছা, কি হল কিশোর ছেলেটার? ওর সাথে শেষ দেখা হয় আজ থেকে দের বছর আগে। শর্মা হাউসে তমালের সাথে ঘুরতে গেছিলো রমা। কথা হল। তমালও কথা বলে কিশোরের সাথে।

“তুমি না থাকলে তো আজ এ পর্যায়ে আস্তেই পারতাম না। ” “আমার কাজ আছে। ” বলে চলে গেল কিশোর। ঐ শেষ দেখা। ডায়রিটা পড়তে শুরু করল রমা।

কিন্তু একি ?? কিসব লেখা আছে এতে? ২৮-০১-২০০৯: আজ বহুদিন পর রমা কে স্বপ্নে দেখলাম। বুঝলাম, ওকে ছাড়া আমার চলবে না। ১৮.০৯.২০০৯: আজ ফেসবুকে অনেক পুরানো বন্ধুদের খুজে পেলাম। ঐ রমার ঐ স্বপ্নের উসিলাতেই বলা যায়। ২১.০৯.২০০৯: আজকের ঈদটা আমার জন্য ঈদই বটে।

আজকে এক বন্ধুর ওয়ালে রমার একটা ছবি দেখলাম। গ্রুপ ছবি। ২৩.০৯.২০০৯:ঐ ফ্রেন্ডদের সাথে যোগাযোগ হয়েছে। ওদের মাধ্যমে রমার সাথে যোগাযোগের প্ল্যান করছি। ১৪.০৭.২০১০:আজ সংবরধনা ছিল।

আজ রমা কে দেখলাম। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না। এত বছর পর........................... ডায়রির পাতা জুড়ে শুধু রমা আর রমা। রমা আর কবিতা। তার মদ্ধে আবার প্রতিটা কবিতাই রমাকে নিয়ে লেখা।

পড়তে থাকে রমা। ২৮.১২.২০১২: আজ রমাকে দেখলাম ভার্সিটিতে। আমার আজ থাকার কথা ছিল না। আমার ভর্তির কাজ আগেই শেষ। তাও আজ শুধু ওকে দেখার জন্যই আসলাম।

২১.০৪.২০১৩:আজ রমাকে চতুর্থবারের মতন দেখলাম। ২৫.০৪.২০১৩:আজ রমার সাথে প্রথম কথা বললাম। বছরের পর বছর আমাকে সাহস সঞ্চয় করতে হয়েছে আজকের দিনের জন্য। কিন্তু যখন ওর টিচার নাম্বারটা চাইল তখন দিতে মন চায়নি। কি করব? একে তো সিনিয়র, আবার সুপার্ব গ্রেড নিয়ে ঢুকেছে টিচার হয়ে।

দিতে না করার পরেও জোর করে ধরলে আমি কি করতে পারি?? কিন্তু ওর রমার নাম্বারের কি দরকার? কাজটা কি ঠিক হল? পস্তাতে হবে না তো? যাই হোক, ওকে খুব শীঘ্রই বলে দেব মনের কথাগুলো। ২৮.০৫.২০১৩:এ কি হল? আমার একটা ভুলের জন্য আমি আজ এখানে? গুজব শুনলেও পাত্তা দেই নি। জানতাম, ও অমন না। পড়াশোনায় ডুবে থাকা মেয়ে। তাই আমিও আর জোড় নিয়ে কিছু বলিনি।

কিন্তু আজ যখন বলার সিদ্ধান্ত নিলাম, তখন কিনা রমা ঐ তমালের সাথে শর্মা হাউসে?? আমি না থাকলে ওরা এই অবস্থায় আস্তে পারত না? সবই আমার কল্যাণে? আমার ভালবাসার প্রতি উপহাস? ঐ তমাল আমার আত্মাকে চুরি করেছে। কিন্তু কি করতে পারি আমি?? কি আছে আমার?? ওর মত গ্রেড? ভার্সিটির টিচারের ভাব? স্মারটনেস? কি নিয়ে দাড়াতাম আমি? আমি তো কেবল আমাকে তৈরি করে নেবার মতন সময় নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই??? কেন???? ২৫.০৪.২০১৫:কাল তমার বিয়ে। পড়তে লাগল রমা। কিন্তু আর তো লেখা নেই।

উলটাতে উলটাতে একেবারে শেষ পৃষ্ঠায় কিছু লেখা। ২৬.০৪.২০১৫: আমি কি করব?? আমি এমন এক মানুষ যে কিনা নিজের কথা বলতে পারে না। মানুষ হিসেবে তার কন কমতি নেই। কিন্তু ব্যক্তি হিসেবে এই আমি আজ এমন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে যেখানে আমার কিছু বলার ক্ষমতা নেই। আমার হাহাকার শোনার কেউ নেই।

আমার হাহাকার শুধুই কাগজে কলমে কিছু দাগাদাগি। আর মানুষের কাছে কিছু সময়ের উপভোগের বিষয় । এর বেশি কিছু নয়। যখন স্কুল ছেড়ে আসতে হল তখন যে কষ্ট পেয়েছিলাম, তার ফল কি ছিল?? ঐ ডায়রিটাতে আর লিখতে পারিনি। আর আজ?? এই একটা ফল ছাড়া আর কিছুই তো দেখছি না।

আমি তো সাধারন মানুষ। ইচ্ছেগুলোকে প্রতিবন্ধকতার কোদাল দিয়ে বার বার কবর দিয়ে দেই। এর বেশি আমি আর কি করতে পারি। আমার তো আর তাজমহল গড়বার সাধ্য নেই। তাই ডায়রি পালটাই।

এটাই আমার আত্মহত্যা, বা ফিরে আসা, যাই বলা হোক না কেন। নিজেকে কেমন যেন উপন্যাসের নায়িকা মনে হতে লাগল রমার। কিন্তু বিরক্তিও যে বধ হয়নি তাও নয়। এরকম ছাইপাশ নিজের কাছে রাখার কন মানেই হয় না। কখন আবার তমাল কি ভেবে বসে কে জানে? বারান্দা দিয়ে ছুঁড়ে ডায়রিটা ফেলে দিল রমা।

এবার সে নিশ্চিন্ত। আরেকবার কিশোরকে সামনে পেলে দেখে নিতে হবে। আচ্ছা, তমালকে দিয়ে থ্রেট দেয়ালে কেমন হয়? ভাবতে লাগল রমা। (ঐতিহাসিক গবেষণাপত্র থেকে জানা যায়, রমার আর থ্রেট দেয়ার দরকার পরেনি। কারন ঐ কিশোর বালকের মুখ আর কখনো রমা ভাবীর সামনে পড়েনি।

) শেষ বিকেলের রোদে সাগরের তীরে বসে আছে কিশোর। যদিও আজ সে আর কিশোর নেই, যুবক। হাতের ডায়রিটা উলটে পালটে পড়লো কিছুক্ষণ। আজ ডায়রির ঠিক ৩ বছর পূর্ণ হচ্ছে। কলম নিয়ে লিখল কিশোর, ২৬.০৮.২০১৮: আজ রমার ছেলে হয়েছে।

লিখে পাশে রেখে দিল। তাকাল তার পাশে বসা সঙ্গীর দিকে। সেই তার একমাত্র সঙ্গী, তার নিজেরই ধূসর ছায়া মাত্র। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।