নিঃস্বার্থ মন্তব্যকে ধন্যবাদ, সাময়িক ভাবে আমি মন্তব্যে নেই
১.
ইকবাল সাধারণত খুব ভোরে জেগে ওঠে । আজানেরও আগে । মৌরিন ঘুমে থাকতে থাকতে তাকে টেনে নেয় বুকের যতটা কাছাকাছি সম্ভব । তারপর অনেক যত্নের সঙ্গে ঘাড়ের দু'পাশে নাক ঘষে দেয়, জলজ চুমু খায় ।
মৌরিন ঘুমাতে ঘুমাতে সেই আদরটা বিছানা-চা এর মত উপভোগ করে, চোখ বুজে ।
অথচ উহহু শব্দ করে ছদ্মবিরক্তি দেখায়। উদ্দেশ্য হল, ইকবালের ঘোরটা আরেকটু বাড়িয়ে দেয়া । একটু বেশি আদর পাওয়া । ঘুমে অর্ধেক কাদা মেয়েটার পুরোটাই মুখস্ত ইকবালের । সে জানে মৌরিন প্রায়ই বোতাম হারিয়ে সেফটিপিন দিয়ে কাজ সেরে নেয় ।
পাজামার মরা গিট, প্যাচ খাওয়া স্তনবন্ধনীর ফিতে - ইত্যাদি মৌরিনীয় সমস্যা সমাধান করতে করতে পাখি ডাকার শব্দে একটা নতুন দিন শুরু করে ।
ইকবাল আজও জেগেছে ভোরে । জেগে আধা হাত দুরে শুয়ে থেকে মৌরিন কে স্পর্শ করছে না । মৌরিন রূপবতী মেয়ে । তারা ফর্সা মসৃণ পেট, নাভীমূল, আচল সরে যাওয়া সুগোল স্তন - যে কোন পুরুষের জন্য আকর্ষণীয়, কিন্তু ইদানিং ইকবাল খুব বেশি নিস্পৃহ ।
হয়তো মনের দুরত্ব বেড়ে গেলে ভালবাসা শরীর থেকে উড়ে যায় । কিছুদিন রুটিন মাফিক শরীরের কসরত - তার পর না চাইতে একসঙ্গে বসবাস । মৌরিনের ইকবাল কে অসহ্য লাগে খুব বেশি । ইকবাল ভাল ছেলে । কাজ পাগল, মিডিয়াতে দীর্ঘদিন থাকলেও পরিচ্ছন্ন চরিত্রের ।
কখন মেয়েঘটিত কোন বদনাম শোনা যায় নি । তবুও কোথাও যেন দেয়াল বেড়ে উঠছে ।
২.
দুজনের পরিচয় ছাত্রজীবনের শুরুতে । রাজনীতি করতে গিয়ে । মৌরিন সমাজতান্ত্রিক ছাত্র বৃত্তের সঙ্গে কাজ করেছে যখন আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পড়তো ।
ওর ব্যাচের মেয়েদের মধ্যে ও ছিল সবচেয়ে সাহসী এবং স্পষ্টবাদী । সাধারণত স্পষ্টবাদী মেয়েদের বিশ্বপ্রেমিক পুরুষেরা একটু ভয়ই পায় । মৌরিনকেও ভয় পেত ওরা ।
একদিন সকালে তেল গ্যাস বিষয়ে সেমিনার ছিল লাইব্রেরী মিলনায়তনে । সমাজতান্ত্রিক ছাত্র বৃত্তের ।
মৌরিনের সঙ্গে সেদিন পরিচয় হয় ইকবালের । ইকবাল পড়তো জার্নালিজমে । সমবয়সী ।
ভারী গলায় ইকবাল সাম্রাজ্যলোভী শক্তির হাতে কী করে উন্নয়নশীল দেশ বন্দী হয়ে থাকে তার তথ্যউপাত্ত তার উপস্থাপন করেছিল । কী করে সেই তেল গ্যাসের জন্য জাতীয় রাজনীতিকে কুলুষিত করে তা বলেছিল স্পষ্ট ধারালো যুক্তি দিয়ে ।
সুচিন্তিত সেই বক্তৃতাটা শুনে সমবয়সী হওয়া সত্বেও ইকবালের দিকে এক ধরণের শ্রদ্ধা হয় । ইকবাল শুধু যুক্তিশীলই নয় । সে সহৃদয় । কবিতা পড়ে । সাহিত্য পড়ে।
তবে পার্থক্য হলো অন্যরা কবিতা আওড়ায় মেয়ে ভোলানোর জন্য । ইকবাল তেমন কিছুই করেনা । সে দুরত্ব রেখে কাজ করে । কখনোই মৌরিনকে তরল কথায় কোন প্রেমের ইঙ্গিত দেয় নি ।
এটা কখনো যে একটু খারাপ লাগতো না তাও নয় ।
এ কেমন ছেলে । কাজ করতে গিয়ে একা ঘন্টার পর ঘন্টা নানান প্রোগ্রাম নিয়ে দুজনের কথা হয় । কিন্তু তার চোখে তার মেয়েলি আবেদনটা চোখে পড়ে না? সে কী পুরুষ নয়?
মৌরিন নারী স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে । ইকবালও । বেগম রোকেয়ার অনুষ্ঠান হচ্ছিলো টিএসসিতে।
মৌরিন বেগম রোকেয়ার বিষয়ে বোর্ডে আলোচনা করেছিল । তার বিশাল অবদান যাতে নারীদের পাথেয় হয় এটাই আলোচ্য বিষয়।
অনুষ্ঠান শেষে ইকবাল বলে উঠলো,
-- দেখ মৌরিন, রোকেয়া অবদান ঠিক আছে কিন্তু তার অবদানের পিছনে যে অসম্ভব গুণের উদার মনের একজন স্বামীর ভুমিকা ছিল সবাই একবারও কেন বলেনা । প্রয়ই দেখি নারী স্বাধীনতা আর পুরুষ বিদ্বেষী মনোভাব সমার্থক । যেন পুরুষদের ভিলেন করলেই নারী মুক্তিটা পোক্ত হয় ।
-- হম্ম । কিন্তু স্বামী সহায়তা পেলেই কী রোকেয়া হওয়া যায়? রোকেয়ার চিন্তার গভীরতা, নারী জাগরণে ভূমিকা সমসমায়িক সবার চেয়ে আলাদা । তার অবরোধবাসিনী,মতিচুর পড়লে পরিস্কার বোঝা যায় ।
একে অন্য ভাবে দেখ । রবীঠাকুরের সাহিত্যে তার আত্মীয়,সহকর্মী বা বন্ধুদের অনেক অবদান রয়েছে, সে ধার করেছে লালন, গগন হরকরা থেকে, কিন্তু ইতিহাস সেই জটিলতায় না গিয়ে কিন্তু রবীন্দ্রনাথকেই কৃতিত্ব দেয় ।
অন্যদের আলাদা করে মনে রাখে না কিন্তু অন্যরা ছোটও হয় না । বরং রবীঠাকুরের ভিতর দিয়ে অন্যরা মুল্যায়িত হয় ।
-- ইতিহাসের কথা বলছো? আমি তো মনে করি ইতিহাসের গোড়ার সমস্যা সেটা রাজা উজির এবং সেলিব্রিটিদের গুনগান । তাদের পিছনের অনেক কাহিনী লিপিবদ্ধ হয় না । পরীক্ষার খাতায় এক প্যারাগ্রাফে বাংলাদেশের কথা বলার মত সংক্ষেপ করতে গিয়ে এটা হয়ে ওঠে নি ।
যখন ইতিহাস লিপিবদ্ধ হওয়া শুরু হয় তখন প্রযুক্তি উন্নত ছিল না । স্টোরেজ ব্যবস্থা ছিল জটিল । এখন ইতিহাসে মিলিয়ন পাতার ডিটেইল রাখতে মানা কোথায়? অথচ এখনো ইতিহাসবেত্তার শর্টকাটে সেলিব্রিটির গুনগান দিয়েই কাজ সেরে ফেলে ।
৩.
ইকবালের একটি কথা মৌরিনের ভাল লাগে । সেটা হলো আমাদের সমাজে নারীরা যতই আধুনিক হোক তাদের ভেতরে পশ্চাদপদতা বাড়ছে ।
সবচেয়ে বেশি উন্নতি দরকার উচ্চশিক্ষিতদের । ইকবাল বলছিল
-- আধুনিক মেয়েরা স্বাবলম্বী হয়েছে সবচেয়ে কম।
-- কীরকম? মৌরিন পাল্টা প্রশ্ন করেছিল ।
-- ধরো যে মেয়েটা গার্মেন্টসে কাজ করছে, সেলাই করছে, ইট ভাঙছে সে অমসৃণ পথে নেমে রুক্ষপ্রতিদ্বন্দিতায় নিজেকে প্রস্তুত করেছে । সে রাতে একা বাসে বাড়ি ফিরতে জানে ।
যদি কোন ছেলে তাকে উত্তক্ত করে তাকে সরাসরি জবাব দিতে জানে ।
আর তোমার ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল মিতু ফারজানাকে দেখ । একটি উচ্চ শিক্ষিত বরের সংসারে শিশুপালন করে জীবন কাটালেই সে সন্তুষ্ট হবে। তাদের পেশাটাও ঠিক করে দেবে তার স্বামীর পরিবার । হয় ব্যাঙ্কে যাবে অথবা স্কুল মাস্টারী ।
খারাপ ভাবে বললেও এরা পরাধীন গৃহপালিত বধুই । শুধু একটু ভাল মোড়কে ।
মৌরিন না করতে পারে নি । সে জানে নারী স্বাধীনতার বিষয়টি স্পষ্ট না অনেকের কাছে । শুধু বাংলাদেশেই না উন্নত দেশেও হয় তারা বোঝে না বা পুরুষেরা বুঝতে দেয় না ।
কেউ কেউ পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দেয়াকেই সাফল্য মনে করে । বাইক চালানো বা গাড়ি চালানো অথবা জিন্সের প্যান্টে , শর্টচুলেই যেন সাম্য ।
--ইকবাল তোমার কথাগুলো অনেক ছেলেই বলে । ছেলেরাও কথায় তুবড়ি ফোটায় । মুখে বলবে শিক্ষিত মেয়ে চাই, মন ভাল ।
কিন্তু কয়টা ছেলে রেসিস্ট না? বিয়ে বলো প্রেম বরো কয়টা ছেলে ফর্সা ধবল অল্পবয়সী মেয়েদের বউ হিসেবে চায়না? বাস্তবের অজুহাত দিয়ে নিজেদের চরিত্রে ঢাকা তাদের স্বভাবর ।
ইকবাল হাসে । সেও মেয়েদের প্রতি একধরনের সন্দেহবাতিক ছিল । মৌরিনের বুদ্ধিমত্তা তার ভাল লাগে । সে বুঝতে থাকে মৌরিন ছাড়া সে সম্পুর্ন নয় ।
৪.
ইকবালের সঙ্গে লিভ টুগেদার করার ঘটনাটা ঘুব ঘনিষ্টরা জানে । ইকবালের পরিবারে বোনের বিয়ে বাকি । তারা বিবাহ বিরোধী নয় । বিয়ে করতে প্রস্তুতি লাগবে কিছু । টাকা পয়সাও তেমন জমে নি ।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে লিভি টুগেদার কতটা উপযুক্ত সেটা নিয়ে দুজনের কথা হয়েছে অনেকবার ।
--- দেখ কালচার সমাজকে অনেক কিছু নির্ধারণ করে দেয় । পুরোটা যে সঠিক তাও না । আবার একাধিক স্তরে কিন্তু আস্তে হোক ধীরে হোক অন্য কালচারের অসমোসিস হয়ে পরিবর্তন হতেই থাকে ।
লিভ টুগেদার এখনো প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা পায় নি ।
কিন্তু রিক্সায়, বেবিট্যাক্সিতে প্রায় জনসমক্ষে শারীরিক মিলন হতে দেখা যায় । বাড়ছে । এখন সবাই একে মেনে নিচ্ছে ।
পার্কে,লাইব্রেরীর পিছনে সর্বত্র উন্মুক্ত যৌনতার ছড়া ছড়ি । বছরের পর বছর ধরে এই যে লুকোচুরির অসাধু আচরণ চলে, লাম্পট্ট চলে তার চেয়ে উন্নত দেশের লিভ টুগেদার অনেকটা স্বচ্ছ ।
---বিয়ের একটা অন্যরকম সুবিধা খেয়াল করেছে, ইকবাল । যোগ করে মৌরিন,
সবার কাছে বিয়ের আগের কমিটমেন্টগুলো খুব হালকা । যত পার বহুগামী হও । মানা নেই । এক ছেলে একই সঙ্গে অনেকের সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক রাখতে কোন সমস্যা মনে করছে না কারণ ভালবাসা যেন যৌনতার রাফ খাতা ।
যত পার কর, করে মুছে ফেল । বিয়ের পর ঠিক হয়ে গেলেই হলো ।
৫.
লিভ টুগেদার হলেও সেখানে তাদের কমিটমেন্টের কোন অভাব নেই । বেতন থেকে শুরু করে প্রতিদিনকার সমস্ত ঘটনা শেয়ার করে দুজন । এভাবেই চলে আসছিল ।
কিন্তু এখন খেয়াল করছে শুরুর দিকে দুজনের যে আন্তরিকতা ছিল সেটা যেন নেই । দুজন প্রায়ই একসঙ্গে থাকে । এক বিছানায় তাবে আগের মত তীব্র আকর্ষণ যেন হারিয়ে গেছে । হয়তো খুব কাছা কাছি আসার কারণেই কিনা কে জানে । মৌরিনও টের পায় সে ইকবালকে আগের মত সহ্য করতে পারে না ।
ইকবাল চ্যানেল ওয়াইতে কাজ করতে গিয়ে বার বণিতাদের উপর কভারিং করছিল । বানিয়াশান্তাতে থাকতে হতো সপ্তাহের পর সপ্তাহ । বিষয়টা মৌরিনের ভাল লাগে নি ।
--- তোমার বারবণিতাদের প্রজেক্টটা যে ভাবে এগোচ্ছে মনে হচ্ছে তোমার মধ্যে আগের মত আদর্শগুলো কাজ করছে না ।
--- মানে?
--- সস্তা যে বিষয়গুলো প্রাইভেট মিডিয়াগুলো সুরসুড়ি দিয়ে পয়সা বানায় তাদের দুটো হলো ধর্ষণ এবং পতিতাবৃত্তি ।
এগুলো লাইসেন্সপ্রাপ্ত যৌন মার্কেটিং ।
বাজারের নোংরা পত্রিকা ভাল পয়সা বানায় । আর একই জিনিসের একটু ভদ্র কাজ হলো টিভি চ্যানেলগুলো । মন্ত্রীদের যেন কাজ নেই - টকশোতে পতিতা বৃত্তি নিয়ে বললে আদর্শ সমাজ ,পরিচ্ছন্ন সমাজ নির্মানে আমাদের কর্তব্যের কত কিছু শুনি। দেখেছো টিভিচ্যানেলের তিনটিতেই পতিতাবৃত্তির উপর নাটক হচ্ছে ।
এমন ভাবে উপস্থাপিত হচ্ছে যেন গাজার বিরোধী প্রোগ্রামে গাজা সেবনের বিস্তারিত বলে গাজারুদের উপকার করা হচ্ছে । ভদ্ররূপী পুরুষ গুলো সুযোগ পেলেই পতিতাদের নিয়ে রগরগে আলোচনা করে । ভিকারাস প্লেজার পায় বেশ । খেয়াল করলে টোনটা ধরা পড়ে - এ চায়ের সঙ্গে মুড়ি চানাচুরের মত রসিয়ে গল্প করে নিজেদের অতৃপ্ত দেহের ইচ্ছা পুর্ণ করতে ।
---মৌরিন ।
হতে পারে । তবে তুমি কিন্তু মোটা দাগে বানিয়াশান্তার প্রজেক্ট কে দেখছো । তুমি মনে হচ্ছে কোথাও মানসিক ভাবে অসুস্থ হয়ে সন্দেহ ব্যাধিতে ভুগছো । কথা বেশি দুর এগোয় না । গম্ভীর হয়ে টেবিলে ফিরে যায় ইকবাল ।
মৌরিন সেকেন্ড সেক্স বইটার শেষ পাতাগুলো পড়তে থাকে ।
৬.
মৌরিন এবং ইকবাল দুজন মেহের পুরে এসেছে । কবি সিরাজ-ই-মুনিমের বিষয়ে কভারেজ করতে । মেহেরপুরের অখ্যাত গ্রামের এই কবি এখন মিডিয়াতে হটকেক । আবৃত্তিকার জয়ীতা চৌধুরী মেহেরপুর পৌরসভা লাইব্রেরী থেকে কবি সিরাজের একটি লাইনোটাইপে মুদ্রিত কবিতার বই যোগাড় করেছিলেন ।
নাম "আরাধ্য" ।
তিনি তার কবিতা পড়ে মুগ্ধ হয়ে যান এব তার কবিতার এলবামে তিনটি কবিতা নির্বাচন করেন । গতমাসে ঘটে যায় অঘটন । জয়ীতা চৌধুরীর "পরশপাথর"কবিতাটি বাজারে অসম্ভব জনপ্রিয়তা পায় । প্রায় পাঁচ লক্ষ সিডি এবং ক্যাসেট বেরিয়েছে,ঘরে ঘর বাজছে
...
আলো জ্বেলে দেখেছি আরাধ্য কে ।
চকমকি পাথরের মত তার ধ্যান রত তাকে
দুহাতে আমাকে বলে ভালবাসি, অথচ কখনো
অস্হির নয়, যেন আমৃত্যু দুজনেই দুজনার জন্য
আরাধ্যের জন্য জীবন প্রতিসরিত হয়
সুখের বুনটে,তার দৃষ্টির স্বচ্ছ তন্তুতে
..
মানুষের পছন্দ বোঝা মুশকিল । কবিতাটি বাংলা একাডেমীর শ্রেষ্ঠ আবৃত্তিযোগ্য কাব্যের পুরস্কার পেয়ে সবার কৌতুহলের বিষয় করছে কবি সিরাজকে । কেউ দেখেনি তাকে । কবি সম্মন্ধে আলোচনায় কবি নির্মলেন্দু চ্যাটার্জি বলেছেন,
-- জীবনানন্দের পর এত সহজ রোম্যান্টিসিজম কবি সিরাজের কবিতাতেই দেখা মেলে । সময়, অধুনা সহ একাধিক প্রকাশক বইমেলার জন্য তাকে বুকিংদিয়ে রাখতে আগ্রহী ।
কিন্তু কবি সিরাজের কাছে যাওয়ার উপায় নেই । এমন কি মেহেরপুর বাসীর কাছেও সে অজ্ঞাত । এমন একজন কবিকে সম্মানিত করা দরকার ।
মৌরিন এবং ইকবাল যে তথ্য পেয়েছে যে মেহের পুর থেকে প্রায় দশ মাইল দুরে সিন্দুরকপাল গ্রামে থাকেন এই কবি । পেশায় কলেজ শিক্ষক ।
তাও পুরো সময় দেন না ।
সিন্দুরকপাল এক কথায় অজো পাড়া গাঁ । সেখানে সন্ধার পর আলো থাকে না । যোগাযোগ ব্যবস্থা যা তা । গরমের দিনে ভাঙা মুড়ির টিনে করে যেতে হয় ।
ঘন্টাখানেক সময় লাগে । কিন্তু নাড়িভুড়ি বের হয়ে যায় । ইট দেয়া রাস্তা । শরীর কে অল্পতেই ক্লান্ত করে দেয় ।
গ্রামের ব্যাটারীর চার্জের একটা দোকান আছে ।
একটা খাবারের দোকান - সোনারবাংলা মিষ্টান্ন ভান্ডার । সেখানে এসে বাস এসে নামিয়ে দিলে । মৌরিন এবং ইকবাল নেমে গেল ।
রিক্সায় যখন সিন্দুরকপাল কলেজে পৌছুল তখন দুপুর একটা । একজন দেখিয়ে দিলো সিরাজ সাহেব কে ।
তিনি বললেন
--- আপনারা কে চিনলাম না তো?
চেহারা পোড় ঘা খাওয়া । বয়সের ছাপ কিন্তু । কবি কবি মনে হলো না । বরং পরিশ্রমী শ্রমিকের মতো কথা তার।
--- কবি সিরাজ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে চাই, বললেন মৌরিন
--- বলেন ।
আমাকে কবি না বললেই খুশী হবো । শুধু সিরাজ বলেন ।
আমার নাম সিরাজ তালুকদার । কিন্তু বই ছাপার সময় প্রেসের মালিক একে সিরাজ ই মুনিম বানিয়েছেন । হাতে খুব সময় হবে না ।
আপনারা অপেক্ষা করতে পারবেন।
পরিচয় পর্বে সিরাজ ই মুনিম কে ভাবলেশ হীন মনে হলো । মৌরিন আগ বাড়িয়ে শুরু করলো, আমরা সময় নেব না । আপনি কি জানেন যে আপনার লেখা কবিতা ঢাকা সহ সারাদেশের পাঠকদের খুব আলোড়িত করেছে ।
বিশেষত: আরাধ্যের প্রতি আপনার প্রেম, আনেকটা বনলতা যেমন জীবনানন্দ দাসের, অথব নীরা সুনীল এবং নির্মলেন্দুর ।
সিরাজ সাহেব । কিছু মনে করবেন যদি প্রশ্ন করি
---এই আরাধ্য কি কল্পণা না বাস্তবের কেউ?
--- আরাধ্য বাস্তব! আমি কবিতা লিখি না । মনের ভাব বলি ।
--- সেই আরাধ্যের সঙ্গে কী করে পরিচয় । কাব্যে তার অনুপ্রেরণা কোথা থেকে ।
--- আরাধ্যের আসল নাম আলম আরা । আমি প্রথম কবিতা লিখি যখন তার সাথে যখন প্রথম দেখা । আমি তখন স্কুল পাশ করে কলেজের ছাত্র । সাইকেল চালাতাম । বাউন্ডুলে ছিলাম ।
জানেন, বলে মুখের দিকে তাকালেন, সাইকেলে করে সুনামগঞ্জ থেকে ময়মনসিংহ পাড়ি দিয়েছি । যশোর থেকে বাগের হাট । তখন একটা গ্রামের মেলায় আলম আরার সঙ্গে সাথে পরিচয় । কবিতা লিখেছিলাম মাঠে বসেই ।
..
অচিন গ্রামে অচিনতর জোনাক
বনের পাখী উড়ছে যেমন জোনাক তুমি ওড়ো
মন ভরেছে রঙের বাদল, বৃষ্টি তুমি ধরো
পাতা বাহার গাছের তলে একটু বাসর গড়ো ।
..
আলম আরা আমার দিকে ফিরে চায় নি । জানেন তো সুন্দরী মেয়ে হলে যা হয় । তাই তাকে আরাধ্য নামটা দিলাম । মানে যাকে পেতে আরাধনা লাগে । গ্রামার ঠিক কিনা জানি না ।
একটু থামলেন । পানি খেয়ে ফেরত আসলেন । আচ্ছা আমি যে এত কিছু বলছি আপনারা এগুলো কোথায় ছাপবেন?
যা হোক । আরাধ্য নিয়ে কুড়িটি কবিতা লিখেছিলাম তখন । তাকে প্রতিদিন পাঠাতাম তার এক দুর সম্পর্কের বোনের হাত দিয়ে ।
একদিন ধরা পড়ে গেলাম । বলা চলে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়া হলো। আমার বাবার কাছে নালিশ এসেছিল । তাকে পেলাম স্ত্রী হিসাবে ।
-- আচ্ছা তার মানে আরাধ্য আপনার স্ত্রী ।
কিন্তু তাহলে তো তার সমস্ত দখলে পেয়েছেনই । এরপর যে এত কবিতা সবই তো আরাধ্য নামে ।
--- না আরাধ্য কে পাইনি । এ বড় ইতিহাস । বলে থামলেন ।
আচ্ছা স্বামী স্ত্রী হলেও কতজন একে অন্যকে পায় বলুন তো?
--- কঠিন প্রশ্ন ,দার্শনিক প্রশ্নে মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে লাগলাম মৌরিন আর আমি ।
৭.
কবি সিরাজ কে বেশি চাচাছোলা মনে হয়েছিল । কিন্তু তার আতিথেয়তায় মুগ্ধ হতে হলো । তিনি জোর করে ধরে নিয়ে গেলেন তার বাড়ির দিকে । কলেজ থেকে পায়ে হেটে পনের মিনিটের পথ ।
মাঝ পথে থেমে একটা চিতল মাছ কিনে নিলেন । তার পর হাটতে হাটতে বলতে লাগলেন, বিয়ের পর তিরিশ বছর কেটেছে । আমি হয়তো একটু উন্মাদই । মাথা খারাপও হতে পারে । আবার শুনেছি মাথা খারাপরাই আসলে কবিতা লেখে ।
প্রতি সপ্তাহে আমি তার জন্য একটি কবিতা লিখেছি । শীত বর্ষায় । তাকে দেয়ার জন্য। বিশ্বাস করেন এতে কোন ভাব নেই । হৃদয় থেকে লিখি ।
--- তা আপনার স্ত্রী মানে আরাধ্য কি কবিতা পড়ে?
বাড়ির খুব কাছা কাছি এসে পৌছেছি
--- হ্যা, একটু থামলেন । ও কবিতা পছন্দ করে । অনেক বেশিই করে । প্রেমের কবিতার বয়স থাকে । থাকে না?
--- জ্বী
--- আলম আরা আমার কবিতা শোনে আমার গলায়, বলে তুমি এগুলো আমার জন্য লিখো আর যাই কর ।
বই ছাপাবে এক শর্ত ।
--- কিন্তু জানেন তাকে বুঝতে পারিনা । আমি আর মৌরিন চুপ থাকি । মানুষকে পাওয়া বা বুঝতে পারার বাতিক কবিদের থাকেই। লোকটি কথা একটু বেশিও বলছে মনে হয় ।
সে কি বুঝতে পেরেছে আমরা কেন এসেছি ? বানিয়ে কথা বলছে?
--- শোনেন,প্রথম যে কবিতার বই বের হয় । তার প্রথম কবিতাটা মনে আছে স্পষ্ট
জাতিস্মর
আরাধ্য বসে থাকে
উচু আকাশের কোনে , মেঘ হয়ে
যেন আরাধ্য নিজেই জলের বাষ্প ।
কচি পাতার মত সেই হাসি
মেঘের নাড়ায় কেদে দেবে ।
আচ্ছা একটা প্রশ্ন করি ।
--- প্রতি সপ্তাহে কি গুণে কবিতা লেখেন?
--- হ্যা, আসলে লিখি ।
আমাদের ভাল বাসার সেতু ঐ কবিতা । কিছু কবিতা আছে যেগুলো একটু বেশি কাছের কথা বার্তা । আলম আরা বলেছে ছাপাতে । কিন্তু লজ্জায় ছাপাইনি । যেমন
...তোমার দেহকে মনে হয় আরাধ্য,
মন্দির বা মসজিদ কারো
প্রার্থনায় হাটুমুড়ে যদি একবার
সেই অচিন সুরঙ্গে ধ্যানরত ঋষির মুখ দেখি
তবে তোমাকেই করে দিয়ে জায়নামাজ
সেজদা দেব ভালবাসার ধর্মে ।
...
তিনি হাতের পাঞ্জা থেকে একটা খাতা বের করলেন । অনেক অনেক কবিতা । কিছু কবিতা বেশ, গোছানো লেখা । কাটাকুটি নেই । কবি বললেন আরাধ্য আমার সংসার আগলে রেখেছে মমতায় ।
আমাকে বলে আমি নাকি অনেক বড় কবি । হা হা হা , বলে প্রথম বারের মত হাসলেন ।
--- আমরা কি আপনার আরাধ্য কে দেখতে পারবো? যে মানুষটি এতটা প্রেরণার উৎস তার ছবি তুলে দেখালে সবাই শ্রদ্ধায় অবনত হবে।
--- আমি খবরের কাগজ পছন্দ করি কম । আপনাদের খবরের কাগজ বলে বলিনি ।
বলেছি ঘনিষ্ট বন্ধু হিসাবে । ঘরে আসুন । মাছ দিয়ে খাবেন । আলম আরার প্রিয় মাছ গজার মাছ । একটা অনুরোধ কোন ছবি বা গল্প প্রকাশ করবেন না
---ঠিক আছে তুলবো না ।
আমি আর মৌরিন বাড়িতে ঢুকলাম। কবির বাসায় গ্রামের বাসা হলেও বেশ গোছানো । মাটির লেপা ঘর । মোটা দেয়াল । একটা পাখা ঝুলছে ।
কাঠের আলমারীতে বই সাজানো । অধিকাংশই পুরনো সাহিত্যের বই ।
একটা বিড়াল ঘরের কোনায় । কবিদের হয়তো বিড়াল পছন্দ থাকে । অথবা বিড়ালদের কবি পছন্দ ।
দেয়ালে খেয়াল হলো একটি বিয়ের ছবি । বহু পুরনো লালচে হয়ে ঝলসে গেছে । একটি খুব কম বয়সের মেয়ের সঙ্গে কবির আগের বয়সের ছবি । দেখলাম ।
আরাধ্যের চেহারা আসলেই সেই কালের সুচিত্রা সেনের মত।
ঝাপসা ছবিতে হাসিটা স্পষ্ট না কিন্তু বোঝা যায় বড় মিষ্টি ।
৮.
অনেক ক্ষন বসে থাকার পর চা এল । একটি হুইল চেয়ার ঠেলে ঢুকলো কাজের ছেলে । ঢুকেই চেয়ারে বসা একটি মহিলা । মাথায় কাপড় ।
একটু চমকে উঠেছি । মাংসের চাকার মত ঝুলছে তার গালের চামড়া । নিস্তব্ধ, অর্ধমৃত । চোখে তাকানো যায় না । অনেক দুর্বল একটা কণ্ঠ ভেসে আসলো,
--- আগে জানায়ে আসতেন ।
উনি তো বেখেয়াল মাছ এনেছে । ঢাকার লোকজন কি মাছ পছন্দ করে? একটা মুরগী জবাই দিলেও না হয় হতো । আমি তো নড়তে পারি কম ।
এই উনি আমাকে পচিশ বছর ধরে বাচায়ে রেখেছে । আমি বেশি কথা বললে কষ্ট হয় ।
আপনারা খেয়ে বিশ্রাম নেন । সালাম ।
কবি বললেন, দেখলেন তো, আমাকে কেমন দোষ দিল । আচ্ছা আপনারা মাছ খান না?
জানেন আলম আরার জন্য তেমন কিছুই করতে পারি নি । ওই কবিতা লেখা ছাড়া ।
প্রায় পচিশ বছরে ধরে সে হুইল চেয়ারে । আমি তো ঘুরে বেড়াই । কবিতা লিখি । টাকা পয়সা
তেমন ছিলনা । হঠাৎ একটা জ্বর আসলো তার পর থেকে সে নিস্তেজ হয়ে গেল ।
শুধু আঙুল নাড়তে পারে আর থেমে থেমে কথা বলে অল্প । ও অনেক সুন্দরী মেয়ে ছিল । কত টাকা পয়সা ওয়ালা জায়গাও ওর কত প্রস্তাব এসেছিল । হয়তো ওরকম কোথাও থাকলে আজকে এমন হতো না ।
ওর চিকিতসার জন্য আমি কিছুই করতে পারি নি ।
বলে সিরাজ সাহেব হাউ হাউ করে দুই হাত দিয়ে চোখ ধরে কেঁদে ফেললেন ।
৯.
মৌরিন আর ইকবাল ফেরার পথে দুজন দুজনের হাত শক্ত করে ধরে থাকলো। অনেক দিন পর তারা যেন ফিরে পাচ্ছে নেই আগের তীব্র প্রেম, আবেগ, সখ্যতা । যেন কখনই তারা দুরে ছিল না । ইকবালের মনে হতে লাগলো মৌরিন তার আরাধ্য।
ঢাকায় এসে সবাইকে জানিয়ে দিল তাদের সিদ্ধান্ত - তারা বিয়ে করতে যাচ্ছে পরের মাসের তিন তারিখ ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।