এরফানের এখন মাত্র পঁচিশ বছর। লম্বা আর সুদর্শন, একমাথা রেশমী চুলের যুবক। ছেলেদের এমন দেবসুন্দর হতে খুব কমেই দেখা যায়। ছয়মাস আগে দাদার আদি বাড়ীতে যখন বেড়াতে গিয়ে ছিল সপরিবারে তখন ও আবিষ্কার করল এই পুরানো পাঠাগারটি। এটি ছিল ওর দাদাজান আবুল হাশেমের ব্যক্তিগত পাঠাগার।
তিনি জীবিত ছিলেন যতদিন ঠিক ততদিন এখানে কারো প্রবেশের নিষেধ ছিল।
সত্যি বলতে কি তাঁর মত বইপোকা এই বংশে আর কেউ ছিল। তিনি বিশ্বের সব নামীদামী বই সংগ্রহ করতেন। শোনা যায় এর জন্য তিনি বেশ মোটা অঙ্কের টাকা তাঁর এই শখের পিছনে ব্যয় করতেন। বইয়ের প্রতি এরফানেরও ঝোঁক আছে।
তবে তা সাধারণ কোনো বিষয়ের উপরের না। ওর পছন্দ গুপ্তবিদ্যার বই।
অলৌকিক শক্তির প্রতি প্রচন্ড কৌতুহল এরফানের। মানুষ ইচ্ছে করলে কি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী হতে পারে? হ্যাঁ, ইচ্ছে থাকলে একটা পথ অবশ্যই বের হবে, এখানে ইচ্ছে শক্তি আর গভীর বিশ্বাসের একটি সংযোগ আছে। এরফান একজন সাধারন মানুষের অপেক্ষায় আরও বলবান হতে চায়।
আলোকে বিশ্বাস করার মত গভীর ভাবে বিশ্বাস করে অন্ধকারকে। এরফান হতে চায় অন্ধকারের সাধক। কত অজানা রহস্য লুকিয়ে আছে আঁধারের মাঝে, যা কিনা চিরচেনা এই পুরানো পৃথিবীর কাছে রহস্যময়। বুদ্ধিতে যার ব্যাখ্যা খোঁজে পাওয়া মুস্কিল। অনেক বছর আগের থেকেই অন্ধকারের রহস্যময় বিদ্যার প্রতি ওর অসামান্য আগ্রহ।
যখন এরফান বোডিঙ্-স্কুলের ছোট কামরায় দুধফেনা ধবধবে শাদা চাদর বিছান বিছানায় শুয়ে থাকত তখন কিশোর এরফান রাতের তারাবিহীন আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবত ঃ আহ্! আমি যদি হতে পারতাম ভ্যাম্পায়ার, তাহলে আমি অন্ধকার রাতের বুক চিরে উড়ে বেড়াতাম! এটা নিশ্চয়ই কিশোর সুলভ কল্পনা ছিল।
কিন্তু বয়সের সঙ্গে সঙ্গে গোপন সাধনা প্রতি ওর মোহ আরও বেড়ে যায়। এরফান দিনের পর দিন প্রতীক্ষা আর সন্ধানে থাকে। কালো বিদ্যার সম্পর্কে নানা বইপত্র জোগাড় করল এরফান। কিন্তু এসব বইতে গুপ্ত কিছু লেখা নেই কেবল মনগড়া কথা ছাড়া।
সভ্য জগতে শয়তানের সাধনা চলে অত্যন্ত গোপনে। এজন্যে এরফান আজও প্রকৃত অন্ধকারের পূজারী বা সাধকের দেখা কিংবা খোঁজ পায়নি।
তবে এরফান ওর সাধনার বিষয়বস্তু অবশ্য পেয়ে গেছে আর তাহল নেকড়ে সাধনা। মানুষ আর নেকড়ের সংমিশ্রণ থেকেই সৃষ্টি হয়েছে ওয়্যার উলফ্ (ডবৎব-ডড়ষভ) বা নেকড়ে মানুষের কাহিনী; যা আজও বাস্তব সত্য বলে বিশ্বাস কোরে অনেক বিশ্বাসীগণ। কারো আবার ব্যাখ্যা অন্যরকম: কিছু কিছু মানুষের অসামান্য আকষর্ণ জন্ম হয়ে যায় নেকড়ের শক্তি আর হিংস্রতার প্রতি; নিজেকে ওরা তখন নেকড়ে ভাবতে শুরু কোরে।
সম্ভবত এই জাতীয় ইচ্ছে থেকেই জন্ম নিয়েছে নেকড়ে সাধনা। অনেক সভ্যদেশেই অত্যন্ত গোপনে লোকচক্ষু আড়ালে চলছে এই অদ্ভুদ নেকড়ে সাধনা। এরফান নিজেকে নেকড়ে মানুষে পরিণত কোরে হতে চায় প্রচন্ড ক্ষমতাশালী। এই সাধনা শয়তান সাধনার মত কষ্টকর নয়। সাধনা নিখুঁত হলে ভরা পূর্ণিমার রাতে নিজেকে পরিণত করতে পারবে নেকড়ে মানুষে।
লাইক্যান্থ্রপিতে আক্রান্ত রোগীরা পূর্ণিমার রাতে নিজেকে নেকড়ে মানুষে হিসেবে কল্পনা কোরো। পূর্ণিমার ভরা আলোটা যখন তাদের শরীরের উপরে পড়ে তখন এই রোগটা খুব প্রকট ভাবে দেখা দেয়। এই শব্দটি এসেছে গ্রীক শব্দ লাইক্যানথ্রোপস থেকে। এটি আবার লাইকোস আর অ্যানথ্রোপস্ এই দু’টি শব্দ থেকে জন্ম। লাইকোস অর্থ- নেকড়ে; আর অ্যানথ্রোপস অর্থ-মানুষ।
শব্দগত অর্থে নেকড়ে মানুষ কিংবা ওয়্যার উলফ্। এই রোগে আক্রান্ত রোগীদের শরীরে কোনো কোনো সময়ে পরিবর্তন দেখা দেয়; তবে এই পরিবর্তন সাময়িক। পূর্ণিমার সময়ে এই্ রোগটা বাড়াবাড়ি রকম বেড়ে যায়। নিজেকে ওরা তখন হিঃস্র নেকড়ে ভাবতে শুরু কোরে।
কারো কারো ধারণা এমন- শরীরটা সত্যিই সত্যিই বদলে যায়।
গায়ের চামড়া পুরু খসখসে হয়ে যায়, গায়ের লোমগুলো পশুর মত বেড়ে যায়, হাতের আঙ্গুলের নোখও হয়ে যায় শ্বাপদের মত। বদলে যায় মুখের ভিতরে দাঁতের কাঠামো। কুকুরে- দাঁতদুটো আরও লম্বা হয়ে ওঠে।
এই পাগল করার মত রোগটা অদ্ভুদ জানোয়ারটাকে তাড়িয়ে বেড়ায় আর নিষ্ঠুর অমানবিক কাজ করায়। পাগলামীর ঘোরটা কেটে যাবার পর আবার সে স্বাভাবিক মানুষে পরিণত হয়ে যায়।
আবার অনেকের এমনও বলে, আরও এক ধরনের লাইক্যানথ্রপি হয়। এতে শরীরে কোনো পরিবর্তন আসে না, কেবল পাল্টে যায় মনটা। মনের এই পরিবর্তনের কারণে ও নিজেকে একজন নেকড়ে মানুষে হিসেবে ভাবতে শুরু কোরে। সাধারণ মানুষের চে’ আরও শক্তিশালী ভাবতে শুরু কোরে। আচরণ বদলে যায়।
হিংস্র হয়ে ওঠে। মানবিক গুণাবলী উচ্ছন্নে যায়।
গোপন সাধনার প্রতি আকৃষ্ঠ এরফান ভূত-প্রেত আর ডাকিনী চর্চার উপরে সাধারণ কিছু বই কিনেছিল। এখানে শুধু মনগড়া কাহিনী আর পদ্ধতি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। লেখক ছিল একজন কল্পনাবিলাসী।
সে কোনো প্রকৃত শয়তান সাধক ছিল না।
শহরের কোলাহল ছাড়িয়ে নবীনগরে দাদার বাড়ীতে কয়েকটি দিন খুব ভালোই কাটছিল এরফানের। তবে এবার ও একাই এসেছে এখানে।
দুপুরে ওর যখন অলস ঘুম আসছিল না তখন ও নীচতলার ঘরে নেমে আসলো। বাড়ীর পিছনের দিকের পুরানো সিঁড়িটা নেমে গেছে পাতাল ঘরে।
এরফান জানে এখানে কিছু প্রাচীন কামরা আছে। কেউ এখানে সহজে আসে না।
কয়েক দিন আগে এরফান তালাবদ্ধ একটি কামরা আবিষ্কার করল। বাড়ীর আদি কেয়ারটেকার রহিম (যাকে ও রহিম দাদু বলে ডাকে), সে জানাল এটি মরহুম আবুল হাশেমের ব্যক্তিগত পাঠাগার। এরফান পাঠাগার দেখতে চাইলে রহিম হালদার কোনো বাধা দিল না।
কারণ এরফান এই বাড়ীর বড় নাতী। জমিদার আবুল হাশেম বেঁচে থাকলে নিশ্চয়ই বড় নাতীকে মানা করতেন না। তিনি এরফানকে খুব ভালোবাসতেন। ‘চাবিটা বড্ড পুরানো, কোথায় রেখেছি খোঁজতে হবে,’ রহিম হালদারের কন্ঠে হতাশা প্রকাশ পেল। ‘আজ বহুবছর হয়ে গেল ওই ঘর আর খোলা হয় না।
চাবিটা যেন কোথায় রেখেছি?’
চাবি খোঁজার জন্য তার পুরো একদিন লাগল। নবীনগরের পুরানো বাড়ী আর জমির দেখাশোনা করে আসছে রহিম হালদার দাদার আমল থেকে। অত্যন্ত বিশ্বাসী একজন তিনি এরফানের দাদার।
চাবি দিয়ে সে-ঘরের দরজা খোলার পর ঘরভর্তি পুরানো ভ্যাপসা গন্ধ বদ্ধ ঘর থেকে মুক্তি পেয়ে যেনো ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কে জানে কত বছর এই ঘরে আলো প্রবেশ করেনি।
সারি সারি আলমারি ভর্তি বই দেখে এরফানের চোখ কপালে উঠল। একসঙ্গে এতগুলো বইয়ের সংগ্রহ আগে কখনও দেখেনি ও। বই দেখতে দেখতে আর ঘাঁটাঘাটি কোরে একটা বুক সেলফের উপর ওর চোখজোড়া যেন চুম্বকের মত আটকে গেল। চোখজোড়া বরফের মত জমে গেল জমকালো চামড়ার বাঁধাই পুরানো একটি বই দেখে। ঘষা কাঁচের ঘের থাকায় ধূলোবালি ভিতরের বইগুলোর কোনো ক্ষতি করতে পারেনি।
কোনো বই ঘূণপোকা-ও খায়নি।
সত্যিকার অর্থে এটা কোনো সাধারণ বই ছিল না। পাকা চামড়া দিয়ে বাাঁধান হাতে লেখা একটি অতি পুরানো পান্ডুলিপি। এটা লেখা হয়েছে কেবল নেকড়ে সাধনার উপরে। অসম্ভব অধীর আÍহারা হয়ে পড়লো প্রথমে এরফান গোপন সাধনার উপরে লেখা এই পান্ডুলিপি পেয়ে।
একটি চেয়ার টেনে পাঠাগারে বসেই পড়তে শুরু করল এরফান। কবরের মত নীরবতা নেমে আসলো তখন পুরোটা কামরা জুড়ে। এরফান এখন অন্য এক জগতে যেন প্রবেশ কোরেছে।
প্রশ্ন জাগল মনে, দাদুর সংগ্রহে এই বই কেন এল? আর কিভাবেই বা এলো?
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল এরফান, ও এখন নেকড়ে সাধনা করবে। দেখা যাক না শেষ পযর্ন্ত কি ঘটে।
অলৌকিক শক্তি ওর চাই। যেমন করেই হোক। সাধারণ একজন মানুষের মত বেঁচে থাকার মূল্য কি আছে?
অলৌকিক শক্তি নিজের বশে এলে এরফান প্রতিশোধ নিতে পারবে। এক টুকরো নিষ্ঠুর হাসিতে ভরে উঠল ওর গোটা সুন্দর চেহারায়। এই পৃথিবীর কিছু কিছু মানুষকে এরফান খুব ঘৃণা কোরে।
এরফান বড় হয়েছে বোডিঙ্-স্কুলে। বাবা মার প্রকৃত ভালোবাসা কি তা ও জানে না। সৎ মা এরফানকে কোনো দিনই আপন কোরে ভালোবাসেনি। সবার সামনে এমন আচরণ করত যে লেখাপড়া করিয়ে বুকের মানিককে মানুষের মত মানুষ করার আশায় বোডিঙ্-স্কুলে রেখেছে। আর নিজের ছেলেটা খুবই ছোট ওকে পাঠাবে পরে।
অবশ্য ওকে কখন পাঠান হয়নি। যদিও বাবার দ্বিতীয় পক্ষে কোনো সন্তান না হলেও; রাহেলা মানে এরফানের সৎ মার পূর্বের পক্ষের একটি ছেলে আছে। এই মহিলা ওর জীবনটাকে দূর্বিসহ্য কোরে তোলেছে।
আর কাকে ও ঘৃণা কোরে? বাবাকে? আর কাকে যেন? সৎ ভাই পাবলুকে? এই বেচারা একটা বোকারাম। কারণ সৎ ভাই এরফানকে খুব ভালোবাসে।
নাহ্ ! এরফান ওকে কিছু করবে না। আর কাকে ও ঘৃণা কোরে? এখন মনে পড়ছে না। পরে আস্তে আস্তে সব মনে পড়বে। কাউকে সে ছাড়বে না। পান্ডুলিপি পাবার চার বছর পর আবার নবীনগরের জমিদার বাড়ীতে ফিরে এল এরফান।
সেদিনে ছিল পূর্ণিমা।
আজকের রাত্রে ওর সাধনা পূর্ণ করবে। বিশাল জমিদার বাড়ীর পিছনে জঙ্গল। ছোটখাটো পাহাড়ও আছে সেখানে। আগের থেকেই একটা নির্জন খোলা জায়গা বেছে রেখেছে এরফান।
পূর্ণিমা রাত্রের প্রথম প্রহরে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে যেতে হবে ওখানে, তৈরী করতে হবে, ভেজষ অষুধ। পান্ডুলিপির বর্ণনা অনুযায়ী গোপন অষুধ বানাবার সব ফর্মূলা সংগ্রহ কোরেছে ভীষণ কাঠকয়লা পুরিয়ে। এতসব কষ্টের ভিতরে শিখতে হল নেকড়ে সাধনার মন্ত্র। মনের মাঝে একটা প্রশ্ন জাগল ওর। এই লেখা যার, সে কে ছিল?
তথ্যটা অজানা রয়ে যায় এরফানের।
আবার সন্দেহ হয় ওর মরহুম দাদাজানের নয়তো? কারণ হাতের লেখার সঙ্গে অনেক মিল খোঁজে পাওয়া যায়। একদিন এরফান চিন্তা করল ওর দাদাজানের কবরটা খুঁড়ে দেখবে। যদি তিনি নেকড়ে সাধনা বা কোনো শয়তানের সাধনা করে থাকেন। তাহলে নিশ্চয়ই কিছু একটার আলামত পাওয়া যাবে কবরে।
এরফান কথায় কথায় একদিন রহিম হালদারকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, আমার দাদু যখন মারা যায় তখন তাঁর বয়স কত ছিল?’
‘ষাটের মত হবে,’ মনে কোরে বলল রহিম হালদার।
‘আমার স্পষ্ট মনে আছে। তাঁকে এই নবীনগরের সবাই ভালোবাসত। ’
এরফান আবারও প্রশ্ন করল, ‘আমার দাদু কিভাবে মারা যায়?’
রহিম হালদার খানিকক্ষণের জন্য কেমন যেন থতমত খেয়ে গেল। সারা সারামুখে যেন এক আকাশ ফ্যাকাসে মেঘ ছড়িয়ে পড়ল। বাড়ীর পিছনের কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ।
তারপর নিজেকে সামলে নিল। পুরো কবরস্থানটা তখন বিকালের ম্লাণ রূপালী আলোছায়ায় অপ্রাকৃত দেখাচ্ছিল।
‘আমি অল্প শিক্ষিত সাধারণ মানুষ,’ বলছে রহিম হালদার। ‘তোমার দাদাজানের কি জটিল রোগ হয়েছিল সেটা আমি জানি না। ডাক্তার অদ্ভুদ এক রোগের নাম বলেছিল আমার ঠিক আমার মনে নেই।
তোমার দাদাজান পূর্ণিমার রাতে খুব অস্থির আচরণ করতেন। গভীর রাতে উলঙ্গ হয়ে জঙ্গলে ছুটে যেতেন। পশুদের মত আচরণ করতেন। তাঁর উপর পাগলামী ভর কোরেছিল। একদিন আমি তার ঘরে ঢুকে দেখি তিনি পুরোপুরি পাগল হয়ে গেছেন আর খুবই ভয় পেয়েছেন।
এক ইবলিশের কাছে সে তার আত্মা বিক্রি করে ছিলেন। তুমি তোমার দাদুর লাশ দেখনি। তোমার বাবা-মা দেখেছে। আমিই তাদের খবর দিয়ে আনি। সবাই বলে মরার আগে তিনি প্রচন্ড ভয় পেয়ে ছিলেন।
’
‘তোমার মা’ শব্দ দুটো আঘাত করল এরফানকে। তবে রহিম হালদারকে বোঝতে না-দিয়ে বলল, ‘আমি তখন বোডিঙ্-স্কুলে ছিলাম। ’
‘জানি, কত যেন বয়স ছিল তখন তোমার?’
‘পনের। ’
‘আমার ঠিক মনে নেই এখন,’ বলল রহিম হালদার। ‘তবে তোমাকে একটি কথা মনে করিয়ে দিতে হবে।
আশা করি কথাটার তুমি গুরুত্ব দিবে। ’
এরফান বদ্ধ চোখে কয়েক পলক চেয়ে থাকার পর বলল, ‘রহিম দাদা তুমি বল, আমি মন দিয়ে শুনব। ’
‘আজ ভরা পূর্ণিমার,’ শুকনো মুখে বলছে রহিম হালদার। ‘আজ তোমার দাদুর মৃত্যুদিবসও। তোমার বাবা-মা বিদেশে আছে বলে এই দিনটা অন্যান্য দিনের মতই সাধারণ মনে হচ্ছে।
এখান থেকে মাইল পাঁচেক দূরে আমার এক বন্ধুর বাড়ী আছে। আজকের রাতটুকু আমরা ওখানেই কাটাব। তোমার দাদুর জন্ম আর মৃত্যু দুটোই ছিল ভরা পূর্ণিমার রাতে। বিশেষ এক কারণে মৃত্যু দিবসে এই পুরো জমিদার বাড়ীতে কেউ থাকতে পারবে না। আমিও থাকব না।
তাই তুমি একা এই বাড়ীতে কি করবে? তোমাকে আমার সঙ্গে আসতে হবে। বছরের এমন একটি দিনে এই বাড়ীটি ফাঁকা রাখতে হয়। ’
এরফান আশ্চর্য হল!
‘কিন্তু কেন?’ প্রশ্ন করল এরফান।
‘আমি বলতে পারব না,’ আড়াচোখে পারিবারিক কবরস্থানের দিকে তাকাল রহিম হালদার। ‘শুধু এটুকু জানি আমার নিষেধ আছে।
’
‘কিসের নিষেধ?’
‘আজ রাতে এখানে থাকা যাবে না,’ কঠিন স্বরে বলল রহিম হালদার। ‘আমি এর বেশী কিছু বলতে পারব না। ’
‘তোমার কথার মাথামুন্ডু কিছু বুঝতে পারছি না আমি,’ হতাশবোধ করল এরফান। ‘আজ আমার দাদাজানের মৃত্যুদিবস। অথচ আমার বাড়ীতে রাত কাটাতে পারব না।
তোমার সঙ্গে পাঁচ মাইল দূরে এক অচেনা লোকের বাড়ীতে আমার রাত কাটাতে হবে। তুমি আমার সঙ্গে রসিকতা করছ না তো। ’
‘না,’ দৃঢ় কন্ঠস্বরে বলল রহিম হালদার। ‘আমার খুব একটা রসবোধ নেই তা তুমি জানো। তাছাড়া তোমাকে আমি আজেবাজে কথা তো বলতে পারি না।
প্রকৃত কারণ কি আমি তোমাকে ঠিক ব্যাখ্যা করে বুঝাতে পারব না। কিছু কিছু অমীমাংসিত রহস্য আছে যা চিরকাল থেকে যায়। তোমার দাদাজানের জন্ম আর মৃত্যু ছিল ভরা পূর্ণিমার রাতে। এমন এক ঘটনা ঘটবে আজরাত্রে যা প্রতি বছরই ঘটে। কেউ রেহাই পায় না এই নিয়তির হাত থেকে।
আমি বছরের এই দিনে বাড়ী ছেড়ে দূরে চলে যাই। বুনো জন্তুর থাবায় আমি পড়তে চাই না। ’
‘বুনো জন্তু?’ বোঝতে না-পারার ভঙ্গিতে সরু চোখে তাকাল এরফান।
‘হ্যাঁ,’ বলর রহিম হালদার।
‘কি সেটা।
’ আবারও প্রশ্ন করল এরফান।
‘আমি ঠিকমত দেখিনি,’ বলছে রহিম হালদার। ‘তাই সঠিক বলতে পারব না। তবে কুকুরের মত, বিশাল দেহ আর খুব হিংস্র। আমি একবার জোছনা রাত্রে কয়েক মূর্হুতের জন্যে দেখেছিলাম।
আমার মনে হয়েছিল ওই কুকুরের মত জন্তুটা এই কবরস্থানে ঢুকে গিয়েছিল। ওর বসবাস এখানেই।
আচমকা থেমে যায় রহিম হালদার, ‘যাই রাতের রান্নাটা ছেড়ে ফেলি। ’
‘আমি কোথাও যাব না,’ সিদ্ধান্ত জানাল এরফান।
রহিম হালদার বদ্ধ চোখে তাকাল এরফানের দিকে।
এক টুকরো ঠান্ডা আতঙ্ক মুছে গেল তার মুখ থেকে। তারপর বোঝাতে না পারার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল এপাশ ওপাশ। ‘তাহলে আমাকে তোমার কথা দিতে হবে তুমি ঘরের ভিতরে থাকবে,’ বলল রহিম হালদার। ‘নীচে যাবে না তুমি। জন্তুটা খুব হিঃস্র।
তোমাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো কোরে ফেলবে। ’
এরফান বলল, ‘তাহলে বন্দুকটা পরিস্কার কোরে তো ভালো কাজই করেছি। পূর্ণিমা রাতে শিকার করাটা আমি খুব উপভোগ করব। ’
‘ভুলেও এই কাজ করতে যেও না,’ আঁতকে উঠল রহিম হালদার। ‘উপরের ঘরেই তুমি সবচে’ নিরাপদ থাকবে।
আমি তিনবছর আগে একবার ছাদ থেকে ওটাকে গুলি কোরে ছিলাম। একসময় আমার শিকারে খুব হাত ছিল। তোমার দাদাজানের সঙ্গে আমি শিকার করতাম। আমি জানি আমার নিশানা কখন ব্যর্থ হয় না। দুটো গুলিতে একটা প্রাপ্ত বয়স্ক ষাঁড় মরে যাওয়ার কথা।
অথচ ওটার কোনো আঁচড় লাগেনি। আমার কথা মন দিয়ে শোনো। আজকের রাতটুকু আমার সঙ্গে অন্যত্র কাটাও। ’ এরফান ওর সিদ্ধান্তে অটল থাকল।
পড়ত্ব বিকালের ধূসর আলোছায়ায় বিশাল আঙ্গিনায় একা এরফান।
আশেপাশে আমজামকাঁঠাল গাছগুলো সারিবদ্ধ হয়ে গর্বিত ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে। গাছের ঘন পাতা আর ডালপালার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে হালকা রূপালী রশ্মি মত বিকালের আলো চুইয়ে চুইয়ে পড়ছে অবাক যাদুর মত এরফানের গায়ে। হঠাৎ কোরে পাখিদের কল-কাকলি থেমে গেলে গা ছমছমে নীরবতা নেমে আসলো চারিদিকে।
একটা সম্ভাবনা উঁকি দিল এরফানের মনে, কুকুরের আকৃতির বিশাল এক জন্তু দেখা যায় ভরা পূর্ণিমার রাত্রে। দাদাজানের পাঠাগারের পাওয়া গেছে নেকড়ে সাধনার উপর হাতে লেখা পান্ডুলিপি।
তাহলে? এরফান মনে মনে ভেবে রাখলÑ আজ রাত্রে দেখতে হবে আসলে জন্তুটা কি?
আজ সেই ভরা পূর্ণিমা, যে রাতকে এরফান বেছে নিয়েছে। অমর নেকড়ে আÍাকে আজ রাতে আহবান জানাবে ওকে শিষ্য করার জন্য। যাতে কোরে প্রতি পূর্ণিমার রাত্রে এরফানও পরিণত হতে পারে নেকড়ে মানুষে।
এরফান এমন কথা শোনেছে যে নেকড়ের কামড় খেলেও আবার কেউ কেউ ওয়্যার উলফ্ বা নেকড়ে মানুষে পরিণত হতে পারে।
দাদুর কবরের উপর চোখ রাখতে হবে।
রহস্যে সমাধান করতে হবে।
কেন, শুধুমাত্র তাঁর মৃত্যুবার্ষিকীতে একটা রহস্যময় জন্তু বের হয় পূর্ণিমার রাত্রে? মস্ত থালার মত চাঁদ উঠেছে আকাশে। সারা আকাশ জুড়ে রূপালী আলোর জোয়ার । কাঁচের মত পরিস্কার আকাশে তারা’রা হারিয়ে গেছে, তাদের আর দেখা পাওয়া যায় না। পুরো অঞ্চলটা মরে পড়ে আছে।
চারিদিক কবরস্থানের মত নীরব।
রহিম হালদার রান্না কোরেই চ’লে গেছে বন্ধুর বাড়ীর উদ্দেশে। আজ হয়তো যেতো না। কিন্তু বন্ধুর স্ত্রীর শরীর খুব অসুস্থ। বন্ধুকে কথা দিয়েছে তাড়াতাড়ি চলে আসবে।
এরফানকে যাবার আগে বার বার নিষেধ করে গেছে নীচে না যাবার জন্যে। রাত ন’টার আগে রহিম হালদারকে এই এলাকা ছাড়তে হবে। রাত বারোটা পূর্ণ হলেই বের হয়ে আসবে ওই কুকুরের মত জন্তুটা। বছরের এমন একটি অশুভ পূর্ণিমার রাত্রে কেউ না কেউ মরবেই এই অঞ্চলে, ওই বুনো জন্তুটার হাতে। এরফানের কথা বার বার ভাবছে রহিম হালদার।
শহুরের শিক্ষিত ছেলেরা একটু বেশী সচেতন নিজের সম্পর্কে। এরা একটু বেশী একরোখা। কোনো শোনা কথা ওরা বিশ্বাস করতে চায় না সহজে, যতক্ষণ না ব্যাপারটা নিজের চোখে দেখবে ততক্ষণ তাদের কিছুতেই বিশ্বাস করানো সম্ভব না। কিন্তু এভাবে এসে পড়ায় বার বার মনটা কেমন জানি খচ্খচ্ করছে রহিম হালদারের। ফিরে যেতে মন চাইছে।
নিঝুম জমিদার বাড়ীতে একা এরফান।
দোতলার ব্যালকনিতে চেয়ার পেতে বসে চোখ রাখছে পারিবারিক কবরস্থানের দিকে। যদি আচমকা কোনো জন্তু বের হয়ে আসে তাহলে এখান থেকে বসেই সহজে দেখা যাবে। অসহ্য অস্বস্তিকর সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। রাত্রি যত অল্প অল্প কোরে বাড়ছে ততই একটু একটু কোরে চাঁদের আলোর জোছনার উজ্জ্বলতা বাড়ছে।
শিকারী ঈগলের মত টানটান সজাগ এরফান। ওর ভিতরে অসম্ভব ধৈর্য আছে। মনে মনে আওড়াছে নেকড়ের-আÍা আহবানের মন্ত্র। একশ তেরো বার পরিস্কার বিশুদ্ধ কন্ঠে পড়তে হবে এই মন্ত্র।
হালকা কুয়াশার চাদর যেন জড়িয়ে আছে কবরস্থানে।
এত ঘন কুয়াশা তো ছিল না!
দূরে কোথাও বহুক্ষণ ধরে ডাকছিল উল্টোস্বরে একপাল কুকুর, আচমকা ওদের গলা কেউ চেপে ধরেছে যেন। কুকুরের ডাক এখন আর শোনা যাচ্ছে না। বোধহয় এই তল্লাটের সব কুকুর ভেগে গেছে। বাগানের সমস্ত ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কখন যে থেমে গেছে জানতেও পারেনি এরফান। হঠাৎ কোরে অজানা শীতল বাতাসের স্পর্শে ব্যালকনীতে চেয়ার পেতে বসে থাকা শরীরটা শিহরিত হয়ে উঠল।
সরসর কোরে গায়ের সব লোম খাড়া হয়ে উঠল।
তবে নিজেকে সামলে নিতে বেশী সময় লাগল না এরফানের।
শয়তান সাধকদের এভাবে ভয় পেলে কি চলে?
সাধক হতে হলে হৃদয়টাকে বানাতে হবে পাথরের চে’ শক্ত। কালোবিদ্যায় আবেগের কোনো স্থান নেই। কারণ আবেগ হচ্ছে বড় দূর্বলতা।
দূর্বল ব্যক্তি কালো বিদ্যার চর্চা করতে পারে না। এরফান কবরস্থানের দিকে তাকিয়ে অস্থির হয়ে উঠল।
কবরস্থানকে ঘিরে থাকা হালকা কুয়াশাটা পরিণত হয়েছে ঘন ছাই রঙের কুয়াশায়। আঠার মত আটকে গেল ওর একজোড়া চোখ ওখানে। ওর মন কেন জানি বলছে আজ একটা কিছু ঘটবে।
ভালো কিংবা মন্দ। কিছু একটা ঘটার সময় হয়ে এসেছে এখন। একসময় ভরা পূর্ণিমার উজ্জ্বল জোছনায় এরফান দেখতে পের ওটাকে। চেয়ার ছেড়ে লাফিয়ে উঠল ও। ঝুঁকে তাকার নীচে।
স্পষ্ট দেখতে পেল বিশাল নেকড়েটাকে। উওেজনায় লাফিয়ে উঠল ওর হৃৎপিন্ডটা। তাহলে ওর ধারণাই সঠিক। ওর দাদু গোপনে নেকড়ে সাধনা করত। কারণ নেকড়েটা বেরই হয়েছে ওর দাদু আবুল হাশেমের কবর ছেড়ে।
বছরের এই মৃত্যুর দিনে তাহলে তিনি বের হোন পূর্ণিমার গভীর রাত্রে। এরফান দ্রুত সিঁড়ি ভেঙ্গে নীচের তলায় নেমে এল। নেকড়ের এক কামড়ে সেও আজীবনের জন্যে পরিণত হ’তে পারে নেকড়ে মানুষে। তাহলেই পূর্ণ হবে ওর সাধনা। ওই তো শোনা যাচ্ছে স্নায়ু ছেঁড়া নেকড়ের ডাক।
রক্ত জল করা গর্জন!
দৌঁড়ে এল খোলা আঙ্গিনায় এরফান। নেকড়েটার সামনে দাঁড়িয়ে হাঁপাতে লাগল। হড়হড় কোরে এরফান বলছে, ‘আমি তোমারি মত নেকড়ে সাধক হয়েছি দাদু। আমি নেকড়ে মন্ত্র জানি। আমি এবার তোমারি মত নেকড়ে হতে চাই।
আমার পায়ে ছোট এক কামড় দাও, যাতে কোরে আমি আগামী পূর্ণিমার রাত্রে পরিণত হতে পারি নেকড়ে মানুষে। আমি পূর্ণ করতে চাই আমার সাধনা। কই এস? আমার কাছে এস?’
বিশাল ধূসর প্রাণীটার ভয়ঙ্কর অশুভ নীল চোখজোড়া ঠিকরে বের হয়ে আসতে চাইছে যেন। আগুনের মত গনগন কোরে জ্বলছে সে চোখ। চাঁদের উজ্জ্বল আলোতে ধারাল দাঁতের বীভৎস সারি দেখে শিহরিত হল এরফান।
হ্যাঁ, টানটান অশুভ ধূসর শরীরটা ঝাঁপ দিল শূন্যে! না, পা লক্ষ্য কোরে নয়। ওর গলা লক্ষ্য কোরে। ‘না,দাদু না!’ গলা চিরে আতঙ্কময় আর্তনাদ বের হয়ে এল এরফানের। বিশাল ধূসর শরীরটার ভার সহ্য করতে না পেরে লুটিয়ে পড়ল এরফান আঙ্গিনার ঘাসের উপর। নেকড়েটা ওর গলা কামড়ে ধরেছে।
এক ঝটকায় ছিঁড়ে ফেলেছে কণ্ঠনালী। ফিনকি দিয়ে রক্ত আর গরম বাতাস ছুটল।
এরফানের চোখের সামনে ভরা পূর্ণিমার উজ্জ্বল রূপালী জোছনা এবার কালিগোলা অন্ধকারে পরিণত হল। মরার আগে বোঝতে পারল এরফান ওর মৃত্যু হয়েছে আর অপূর্ণ রইল ওর নেকড়ে সাধনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।