কালের সাক্ষী
প্রথম আলো আর ডেইলী স্টার, এরা বেশী প্রগতিশীলতা ফলাতে গিয়ে বেশ একটা ‘বাঙ্গালী’ আর ‘বাংলাদেশী’ নিয়ে বেশ একটা হযবরলের মধ্যে পড়ে গিয়েছে দেখা গেল। বৃটেনের ইলেকশানে লেবার পার্টি হেরে গেলেও সাউথ এশিয়ান ও মুসলিম অধ্যুষিত বেথনাল গ্রিন অঞ্চল থেকে লেবার টিকিট নিয়ে বাংলাদেশী বংশোদ্ভুদ রুশনারা আলী জিতে গেছেন। এর প্রতিদ্বন্দ্বীরাও ছিলেন প্রায় সবাইই বাংলাদেশী- টরি পার্টির জাকির খান, লিবারাল ডেমক্রেটদের আজমল মাসরুর আর রেসপেক্টের আবজল মিয়া; সবার দেশ সিলেটে, সবার পরিবারই ৬০ থেকে ৯০-এর দশকের মধ্যে ইংল্যান্ডে মাইগ্রেট করেছে। বেথনাল গ্রিনের প্রাক্তন এমপিদ ছিলেন রেসপেক্ট পার্টি থেকে; এবং তিনি আর কেউ নন, অতি সুপরিচিত জর্জ গ্যালওয়ে, যিনি তিরিশ বছরেরও বেশী সময় যাবৎ লেবারদের সাথে থেকে ইরাক যুদ্ধের বিরোধীতা করে ২০০৩-এ পার্টি ছেড়ে যান। ২০০৫-এর ইলেকশানে তিনি তার নতুন রেসপেক্ট পার্টি থেকে বেথনাল গ্রিনে দাড়ান, এবং সেখানকার ইরাক যুদ্ধের প্রত্যক্ষ সমর্থক ইহুদী লেবার প্রার্থী উনা কিং-কে পরাজিত করে এমপি হন।
মজার ব্যাপার হচ্ছে, প্রথম বৃটিশ-বাংলাদেশী এমপি রুশনারা আলী ২০০৫-এর ঐ ইলেকশানে এই উনা কিং-এরই একান্ত সচিব ছিলেন, যদিও রুশনারা পরে বারবার বলেছেন যে তিনি কখনওই যুদ্ধের সমর্থন করেন না।
যাই হোক, চূড়ান্ত অঘটন না ঘটলে যে বেথনাল গ্রিন থেকে একজন বাংলাদেশীই নির্বাচিত হবেন এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ ছিল না। জাকির খান সাহেবের কোন সম্ভাবনা আসলে ছিলই না, আর লিবডেমদের অবস্থা টরিদের মত না হলেও লেবার পার্টিকে হারাবার মত অবস্থা নয়। জর্জ গ্যালওয়ের মত কেউ দাড়ালে সেটা অন্য ব্যাপার হতে পারত, কিন্তু ঐখান থেকে এবার রুশনারার জয়ী হবার সম্ভাবনাই সবচেয়ে বেশী ছিল। তো অবশেষে কোন অঘটন ঘটেনি, রুশনারা আলি জয়ী হয়েছেন।
শুধু সব জায়গাতেই প্রগতিশীলতা ফলাতে গিয়ে, অন্য ভাষায় সর্ব ঘটে কাঠালী কলা করতে গিয়ে, প্রথম আলো ও ডেইলী স্টার একটা দ্বন্দ্বের সুড়সুড়ির জন্ম দিয়েছে।
বৃটিশ ইলেকশানের খবর জানতে প্রথম আলো বা ডেইলী স্টারের ওয়েবসাইটে যাওয়ার কোন কারন নাই। তবু দেশের হালহকিকত বুঝতে সেখানে প্রায়ই যাওয়া হয়। আজও সন্ধ্যার দিকে গিয়ে দেখা গেল ডেইলী স্টারের হোমপেজে বড় খবর, বৃটেনের প্রথম বাংলাদেশী এমপি রুশনারা। খুব ভালো কথা, বিবিসির ওয়েবসাইট থেকে একথা কিছুক্ষণ আগেই জেনেছি।
আরও কিছুক্ষণ পর, মানে একঘন্টার কম সময় পর ডেইলী স্টারের পেজে গিয়ে এক চমক, আরে! একটু আগে না দেখলাম যে লেখা প্রথম বাংলাদেশী এমপি? এবার গিয়ে দেখলাম সেখানে বাংলাদেশী মুছে ‘বাঙ্গালী’ এমপি লেখা হয়েছে।
রাত পোহাবার আগেই বিডিনিউজ, প্রগতিশীলদের খাতার নতুন রেজিস্ট্রেশান, এরাও দেখলাম সারা সন্ধ্যা রাত ‘বাংলাদেশী’ লিখে গভীর রাতে এসে ‘বাংলাদেশী’ মুছে ‘বাঙ্গালী’ লিখে দিয়েছে।
বেশী বকম বকমে যাব না, অনেক রাত হয়েছে, ঘুমাতে হবে। শুধু, আবেগ, রাগ, ক্রোধ, যাই হোক না কেন, সেগুলার কোন একটার বশবর্তী হয়ে কয়েকটা কথা বলতে চাই।
রুশনারা আলী কতটুকু ভালো বাংলা বলেন জানি না, তাও ওনাকে বাঙ্গালী বললে নিশ্চয়ই কোন দোষ নেই।
কিন্তু এই রুশনারা আলীর জন্ম ১৯৭৫ সালে সিলেটের বিশ্বনাথে, ১৯৮২ সালে সাত বছর বয়সে মা বাবার সাথে ইংল্যান্ডে মাইগ্রেট করেন। অতএব ইনি যে বাংলাদেশী সে ব্যাপারে কোন ইতিহাসবিদ বা প্রত্নতত্তবিদের ক্লিয়ারেন্সের প্রয়োজন নেই। ইনি জাতিগত ভাবে, অফিসিয়ালি বা যাই হোক না কেন, বাংলাদেশী হিসেবেই পরিচিত হবেন। ইনি বাঙ্গালী এতে কোন ভুলের অবকাশ নেই। সাদ্দাম হোসেন যে তিক্রিতি এতে কোন ভুল নেই।
গোল্ডা মেয়ার, আয়ালেত জুরার, এনারা জার্মান ইয়েক্কে। হাফেজ আল আসাদ একজন আলাওয়াইট। এগুলোকে কেউ অস্বীকার করে না। কিন্তু সাদ্দামের পরিচয় সাদ্দাম একজন ইরাকী। গোল্ডা মেয়ার আর আয়ালেত জুরার হলেন ইসরায়েলী, হাফেজ আল আসাদ একজন সিরীয়।
জীবদ্দশায় যদি নায়িকা আয়ালেত জুরার কখনও মাউন্ট এভারেস্টের আগায় চড়ে বসেন, তাহলে একটি সুস্থ মস্তিষ্কসম্পন্ন ও ফালতু/চিকন রাজনীতি থেকে মুক্ত পত্রিকা খবর করবে, একজন ইসরায়েলী নারী পর্বতে চড়েছেন; একজন ইয়েক্কে নারী পর্বতে চড়েছেন, এই কথা হেডলাইনে লিখে মানুষের ভুরু কূচকে দেয়ার আপ্রাণ ও হাস্যকর চেষ্টা করবে না।
ডেইলী স্টার স্বাধীনতা দিবসের দিন পত্রিকার সাথে বাংলাদেশের মিনি ফ্ল্যাগ বিলি করেছে, স্ট্যান্ড সহ। এসব হিপক্রিসির কোন মানে হয় না। বাংলাদেশী হিসেবে নিজেকে পরিচয় দিতে এত কুন্ঠা বোধ করলে স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবস পালন করার কোন দরকার নেই। আর ঐসব পালন করতে হলে, লাল সবুজের পতাকা নিয়ে নাচানাচি করতে হলে নিজের বাংলাদেশী পরিচয়কে সমুন্নত রাখতে হবে, সবচেয়ে উপরে তুলে ধরতে হবে।
বাংলাদেশী ও বাঙ্গালী, এরকম আরও অনেক ইস্যুতে মানুষের মাঝে দ্বন্দ্ব ও বিভাজন সৃষ্টি করা, হতে পারে এগুলো তাদের ব্যবসা, কিংবা ব্যার্থ বাম রাজনৈতিক জীবনের পরিহাস, কিন্তু এগুলো মূলত হিপক্রিসির নামান্তর। মানবসন্তানদের মাঝে দুটি স্পষ্ট ভাগ রয়েছে। একদল ভালো, আরেক দল খারাপ। প্রথম আলো ও ডেইলী স্টারের ঐরকম কাজ গুলো এক বাক্যে খারাপ ও ক্ষতিকারক।
এই লেখার ফলে রিডারদের প্রতিক্রিয়া কি হবে বলতে পারছি না।
একদল প্রথম আলো ডেইলী স্টারকে হিপক্রিট হিসেবে স্বীকার করবে। একদল সরাসরি আমাকে হিপক্রিট বলবে। আর অতি ক্ষিপ্ত কিছু মানুষ, যাদের জন্য বাংলা ব্লগগুলো এখনও বেরসিক হয়ে যায়নি ও কখনও যাবে না, তারা প্রথম আলো আর আমাকে, দুই পক্ষকেই হিপক্রিট বলবে। যাই হোক, এতকিছু ভেবে লিখিনি। রিডার রিঅ্যাকশান কি হবে সবাই সেটা মাথায় রেখে লিখতে থাকলে পৃথিবীর ইতিহাস আজ অন্য রকম হত।
আর কেউ যখন সেরকম শুরু করেননি, আমারই বা কি ঠ্যাকা?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।