সে এক পাথর আছে কেবলই লাবণ্য ধরে ...
আমি তোমাকে প্রথম দেখি , লাবণ্য ; ২০ শে নভেম্বর ১৯৯৭ সালে , বিকেল ৪ টা ১৫ মিনিটে ।
সে দিনটার কথা এখনো মনে আছে , যেন দাগ কেটে বসে গেছে অনুষঙ্গে । আমি চাইলেও যেন আকে ভোলার সাধ্য আমার নেই । অথবা ভুলতে কি চাই ? মনে হয় না ।
সেদিন রবিবার ছিল , বাবা বললেন মোড়ের ফার্মেসী থেকে ওষুধ আনতে , বুকের ব্যাথাটা বেড়ে গিয়েছিল হঠাৎ ।
আমি কলেজ থেকে ফিরে আড্ডাতে যাওয়ার উপায় খুঁজছিলাম - ভালো লাগছিলো না একগাদা কথা ভাবতে ।
আমি বাসা খেকে বের হলাম । দেখি আমাদের সামনের দোতলা সাদা বাড়িটার রেলিং ধরে একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে ।
আমি "প্রথম দর্শনে প্রেম" জাতীয় কোন দার্শনিক তত্ত্বে কখনোই বিশ্বাসী ছিলাম না । কিন্তু বিশ্বাস কর লাবণ্য , তোমাকে প্রথমবার দেখার পর আমি সম্পূর্ণ অনুভূতিশূণ্য হয়ে গিয়েছিলাম ।
আমার মনে হচ্ছিল , যেন পৃথিবীতে কেউ নেই , থাকবার অধিকারও নেই কারো শুধু তুমি ছাড়া । তুমি আনমনা হতে তাকিয়ে ছিলে দূরে , আমার ইচ্ছা করছিল আমি সময়কে ঐ জায়গায় দাঁড় করিয়ে দিই , শত সহস্র বছর কেটে যাক .. আমি চাইছিলাম। আমি ভুলে গিয়েছিলাম গতকাল কলেজে মার খেয়েছি বাবুভাইদের হাতে , ভুলে গিয়েছিলাম আমার বুক পকেটে দুটি ময়লা দশ টাকার নোট , আমার একমাত্র টিউশনিটা বন্ধ হয়ে গেছে , ভুলে গিয়েছিলাম বাবার জন্য ওষুধ কিনতে হবে ... আমার মনে ছিল না কিছুই ।
আজো চোখ বন্ধ করলেই দেখি , তুমি সেভাবেই দাঁড়িয়ে ।
লাবণ্য , জানো সেই রাতে আমার জ্বর এসেছিল ।
সারারাত কি এক অসহ্য যন্ত্রণায় কেটেছে , জানিনা এমন কেন হয় । এখনও জানিনা । প্রেম - ভালোবাসা আমার কাছে বরাবরই সস্তা মনে হত , এখনও হয় । কিন্তু আমি কিছুতেই অস্বীকার করতে পারিনা সেই অনুভূতিকে , সেই রাতটিকে ।
আমি তোমাকে চিনিনা , জানিনা তুমি কে , কোথায় পড়ো .. কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার মনে হয়েছিল এসব জানার কোন প্রয়োজনও আদৌ আমার নেই , আমার এটাও একবার মনে হয়নি তুমি কোন রাজকন্য আর আমি রাজপুত্র্র ... আমার শুধু মনে হচ্ছিল যদি আর একটিবার ঐ চোখজোড়া দেখতে পারতাম - ব্যাস , আর কিছু চাই না ।
তারপরদিন সকাল খেকে আমার জীবনটা নতুন করে শুরু হল । আগে নিজের জন্য বাঁচতাম ., তোমার জন্য বাঁচতে শুরু করলাম ।
আগে আড্ডার মধ্যমণি হয়ে বসে থাকতাম , এখন মন পড়ে থাকে বাসায় । বন্ধুরা প্রথমে চিন্তিত হল , এরপর বিরক্ত হয়ে গেল । সস্তা নেভী সিগারেটের নীলচে ধোঁয়ায় শ্বাস নিতে নিতে আমি ভাবতাম তোমার কথা ।
তুমি কলেজ থেকে ফেরার সময় হলে এলোমেলো হাঁটতাম রাস্তায় , তোমাদের রেলিং এর দিকে তাকাতে তাকাতে ব্যাথা হয়ে যেত চোখ ।
পাড়ার বন্ধুরা মাঝে মাঝেই তোমাকে নিয়ে আসত আড্ডায় । প্রাণপণে চেষ্টা করতাম প্রসঙ্গ বদলাবার , চেষ্টা্ করতাম প্রমাণ করতে তোমার নাক বোঁচা , যাতে কেউ তোমায় নিয়ে না ভাবে ।
যেন তুমি আমার ব্যক্তিগত কোন বকুল ।
আমি জীবনে ক্লাসনোট ছাড়া কিছুই লিখিনি , আমি তোমার জণ্য একটা চিঠি লিখে ফেললাম ।
লিখলাম , ছিঁড়লাম । লিখলাম , ছিঁড়লাম । আবারও লিখলাম । যতবার পড়ি , মনে হয় সস্তা বাংলা নাটক , আবারও ছিঁড়ি । কিছুতেই বোঝাতে পারিনা যা বলতে চাই ।
আমার এত দুঃসাহস ছিলোনা আমি তোমার মা কে গিয়ে বলবো অন্য ছেলেদের মত 'আন্টি, বাজারটা করে দিই' , অথবা তোমাদের দারোয়ানের কাছে তোমার অজানা তথ্য উদ্ধার করে নিয়ে আসব । আমি কিছুই জানতামনা তোমার । তোমার প্রিয় মুভিস্টার কে , তোমার প্রিয় রং , প্রিয় গান , কিছুইনা ... শুধু পাড়ার ছেলেদের কাছে জেনেছিলাম তিনটি শ্রেষ্ঠ অক্ষর ..
লাবণ্য । তোমার নাম ।
এরচেয়ে সুন্দর , এরচেয়ে প্রিয় কোন নাম থাকতে পারে পৃথিবীতে , আমার জানা ছিল না ।
খাতায় কোনদিন কিছু লিখিনি । কি দারূন আগহে লিখে ফেলেছিলাম তোমার নাম হাজারবার । আবার লজ্জা পেতাম নিজেই সেসব দেখে ।
তোমাদের লাল রংয়ের গাড়িটা , তোমাদের সাদা রেলিং দেয়া বারান্দা , তোমার জানালার পাশে নীল রংকরা টবটা - আমার এত প্রিয় কোন জিনিস পৃথিবীতে ছিল না আর । আমি ভালোবাসতাম তোমাকে দেখতে ।
তোমার ক্লান্ত চোখজোড়া ..... যেন দু'ফোটা বর্ষা ।
আমি কলেজে যাওয়া ছেড়ে দিলাম । বাসায় আমাকে নিয়ে আলোচনা শুরু হল । আমি কি গাঁজা ধরেছি ? আমি কি পুলিশের ভয়ে লুকিয়ে আছি ? আমি কি পরীক্ষায় ফেল করেছি ?
আমি জানতাম না এসব প্রশ্নের উত্তরে । আমার মন আবিষ্ট হয়ে থাকত দেয়ালের ঘড়িটার দিকে ।
কখন তিনটা বাজবে ? তুমি আসবে ... ভাগ্য ভালো হলে বারান্দায় দু'মিনিট ।
এক দুটি মিনিটই আমার চাওয়া ।
আমি জানি আমি মোঃ মুহিন ইসলাম , আমি সেকেন্ডহ্যান্ড শার্ট পরি , নেভী সিগারেট খাই আর বখাটে ছেলেদের সাথে আড্ডা দিয়ে সময় কাটাই , আমার বাবা অসুস্থ , পকেটে সাইত্রিশ টাকা আছে আমাকে মাস চালাতে হবে , আমি দেখতেও মোটেই সুপুরুষ না ; আমার কখনোই এ দুঃসাহস হবে না তোমার সামনে গিয়ে তোমাকে বলব তুমি পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ জলপ্রপাত , বলব আমার ভালোলাগে যখন তুমি আকাশের দিকে তাকিয়ে মেঘ খুঁজে বেড়াও ... আমাকে একটু মেঘ এনে দেবে ?
আমার দিনগুলি কেটে যেতে থাকল স্বপ্নের মত .. কেমন যেন এক ঘোরে আমি হাঁটতে থাকলাম মাইলের পর মাইল । যে বৃষ্টিকে কখনোই বিরক্তি ছাড়া কিছু মনে হয়নি , তাকে প্রিয় লাগতে থাকল হঠাৎ , প্রিয় লাগতে লাগল গান , পাখি আর ভাঙ্গা জানালায় রোদের উৎসব ।
আর সেদিন .. সেই দিনটি ....... যা আমি কখনোই ভুলব না ।
আমার জীবনের স্মরণীয়তম দিন , লাবণ্য ।
আমি দেখছিলাম তুমি কলেজ থেকে আসলে রোজকার মত । হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে নামলে , যা কখনোই করো না । সারা বিশ্বব্রম্মান্ড ছেড়ে সোজা আমার দিকে আসতে থাকলে .... ।
আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম ।
"আপনাম নাম মুহিন ?"
আমার গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছিল না । এই সেই একজোড়া চোখ যার প্রার্থনার আমি সমর্পিত , এই সেই চোথ । আমার সামনে , আমার এত কাছে ?
"জ্বি" , নিজের গলা নিজেই ঠিকমত শুনতে পেলাম না , গলা শুকিয়ে কাঠ ।
"এটা আপনি লিখেছেন ?" .. তোমার হাতে আমার সেই চিঠি ।
আমি বিস্ময়ে পাথর হয়ে গেলাম ।
আমি জানিনা সেই চিঠি কিভাবে আসল তোমার হাতে । হয়তো কোন বন্ধু পেয়েছিল খাতার মাঝে , পাঠিয়ে দিয়েছিল তোমার ঠিকানায় মজা দেখার জন্য । আমার মনে হল কেউ আমাকে বিবস্ত্র করে দাঁড় করিয়ে রেখেছে তোমার সামনে ।
" কথা বলছেন না কেন , এটা আপনার লেখা ?"
আমি কি বলব ? আমার দু চোখ ভরে জল । আমি কি বলব তোমাকে লাবণ্য ? কি বলব ?
"জি..জ্বি"
তুমি রেগে গিয়েছিলে ।
তোমার নাক ঘামছিল বৈশাখের গরমে । আমি দেখতে পাচ্ছিলাম স্পষ্ট , তোমার চোখে রাগ ।
চোখের সামনে ছিঁড়ে ফেললে তুমি আমার ভালোবাসাকে । ছড়িয়ে দিলে রাস্তায় ।
নাহয় আমি সুন্দর করে লিখতে পারিনি , নাহয় আমার হাতের লেখা ভালো না , অজস্র বানান ভুল ।
নাহয় আমার বহিঃপ্রকাশ নাটকের ডায়ালগের চেয়েও সস্তা ; তবুও তুমি বল ... কাজটা কি ঠিক ছিল ?
কালো পিচের রাস্তায় শিউলিফুলের মত পড়ে রইল আমার চিঠি , আমার প্রথম চিঠি ।
"ছোটলোক"
কি সুন্দর করেই না উপসংহার দিয়ে গেলে তুমি । যেন একটিমাত্র শব্দে জানিয়ে গেলে , আমি কত সামান্য , কত ছোট তোমার তুলনায় । আমার জন্য স্বপ্ন দেখা অন্যায় , জানিয়ে গেলে তুমি । কেন লাবণ্য ? আমি কি খুব বেশি কিছু চেয়েছিলাম ? খুব বেশি কিছু ?? কেন এমন করেছিলে সেদিন তুমি ?
আমি জনৈক মুহিন , বাংলা কলেজের বখে যাওয়া বেকার ছাত্র , যার জীবনে একবার ভালোবাসা এসেছিল ।
এই আমার ভালোবাসা , আমার একমাত্র , একমাত্র অসমাপ্ত গল্প ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।