আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুনর্জন্ম

I am what I am and that's how I would be. No I am not stubborn. I just want to be myself.

ঘুরেফিরে সেই ছোটবেলার কথাই মনে আসে। চাকরি ছাড়ার পর এটা আরো বেশি হচ্ছে। মেয়েদের যখন খেলতে দেখি, পড়তে দেখি, নিজেদের মধ্যে মারামারি আবার ভাব করতে দেখি তখন চোখ বন্ধ করলেই ঝুপ করে অতীতের পর্দা নেমে আসে, আজকের দিন টা হয়ে যায় আগের দিনগুলো, আমার মেয়েদের ভূমিকায় দেখতে পাই নিজেকে আর নিজের ভূমিকায় দেখি মা-কে। ছোটবেলায় যে আমার কত্তকিছু হতে ইচ্ছে হতো! স্কুলে টীচার যখন শাসন করতো তখন মনে হতো আমি বড় হয়ে টীচার হবো। রোমেনা আপা বলে এক টীচার ছিলেন, তাঁকে নিয়ে আমি একবার স্বপ্নও দেখে ফেলেছিলাম যে আমি টীচার আর উনি শিক্ষার্থী হয়ে আমার হাতে উনি মার খাচ্ছেন।

আমাদের স্কুলে হেঁটে যাওয়া যেত, ঘরের কাছেই। একা একা হেঁটে চলে যেতাম, ফিরতাম একা হেঁটে ছুটির পরে। আজকাল সেসব চিন্তা করা যায়? কোনও আতংক ছাড়াই আমার মা আমাদের এভাবে ছেড়ে দিতেন, এই যূগে তো সেটা চিন্তাই করা যায়না! আমাদের ঘরের সামনে একটা বড় মাঠ ছিল। খেলাধুলা শেষ করে বাইরের নলকূপে হাতমুখ ধুয়ে ঘরে ফিরতাম মাগরীবের সময়, এরপর পড়তে বসার সময়টুকু তে যে কী হতাশ লাগতো! রান্নাঘরের পাশে ডাইনিং রুমে আমরা তিন ভাইবোন পড়তে বসতাম। গলার আওয়াজ শোনা না-গেলে কিচেন থেকে আম্মুর হুংকার কানে আসতো, মাঝে মাঝে পড়ার টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছি কতো!! সেইসময় এশার আযানকে মনে হতো আশীর্বাদের মত, নামায পড়ার উসিলায় যদি একটু সময় পার করা যায়! হুড়াহুড়ি করে নামায পড়তে যেতাম, কিন্তু এতো ধীরে ধীরে পড়তাম যাতে সহজে শেষ না হয়।

সে কী লম্বা লম্বা মুনাজাত করতাম, ভাবলেই এখনও হাসি পায়। পড়া থেকে একটু সময়ও যদি নিজেকে বাঁচানো যায় সেটাও অনেক লাভ। আমার বড়মেয়ের এখন নানান অজুহাত বের হয়ে যায়, ঠিক পড়তে বসার সময়। ওকে বকা দিতে গিয়ে মাঝেমাঝে হেসে ফেলি। নিজের ছোটবেলার কথা এতবেশী মনে পড়ে যায়! সেসময় মনে হতো বাসার সবচেয়ে সুখী মানুষ হলো আম্মু।

কারণ আম্মুর অফিস নেই, পড়া নেই। খালি আমাদের ধরে ধরে খাওয়ানো আর পড়ানো। আর রান্নাবান্না ঘরের কাজ। ইস্‌, খালি মনে হতো কবে যে আমি আম্মু হবো! তাহলে সব নিজের খেয়াল খুশীমত করতে পারবো। আম্মুকে একবার বলেও ফেলেছিলাম সেকথা।

আমাকে একদিন দুপুরে ঘুম পাড়ানোর সময় জিজ্ঞেস করলেন “বড় হয়ে তুমি কী হবে?” আমি বলে ফেললাম আমি আম্মু হবো। মজার ব্যাপার হচ্ছে এখন আমার ছোটমেয়ে তার খেলার পুতুলদের আম্মু হয়ে খেলে। ঘুম থেকে উঠিয়ে পুতুল-বেবীদের ফ্রেশ করানো, নাস্তা খাওয়ানো, স্কুলে পাঠানো-সব করে নিজে নিজে। পুতুল-বেবীরাও খুব দুষ্টু, খেতে চায়না, বমি করে দেয়, প্যান্টে হিসু করে দেয়! তখন সে তার বাচ্চাগুলোকে বকাও দিচ্ছে ঠিক আমার দেয়া বকাগুলো নকল করে। আড়াই বছরের মেয়ে রীতিমত গিন্নির মত সংসার সামলাচ্ছে! বড়মেয়ে স্কুলে চলে গেলে ছোটটার এই একা একা খেলা দেখে আমি অবাক হয়ে যাই।

মাঝেমাঝে মেয়েরা নিজেরা নিজেরা ভাবি-খালাম্মা খেলে। একজন ভাবি হলে অন্যজন খালাম্মা। আমাকে দাওয়াত দেয় ওদের বানানো নাস্তা খাওয়ার জন্য। জিজ্ঞেস করি আমি “ভাবি আপনার সাহেব কোথায়?” তখন আবার সাহেবকে ফোন করে বলা হয় “শোন আসার সময় ডিম আর মাখন নিয়ে এসো তো!” ছোটটা আবার তার সাহেবকে ফোন করে বলে তার জন্য চকলেট আর আইসক্রীম নিয়ে আসতে। আমার ছোটবেলায় ওশিন বলে একটা জাপানী নাটক দেখাতো বিটিভিতে।

সেটা দেখে খুব সখ হলো বড় হলে আমার একটা বিউটি পার্লার থাকবে। আম্মুর লম্বা চুলে মাঝে মাঝে এক্সপেরিমেন্ট করতাম। ফলাফল আম্মুর চুলের বারোটা বাজতো। কিন্তু আম্মুকে কখনও মানা করতে দেখিনি। সেদিন আমার দুই মেয়ে দুইটা চিরুনি নিয়ে একিভাবে আমার চুল ছিঁড়ে যাচ্ছিল দেখে আম্মু খুব রেগে গেলেন।

“তুমি ওদের মানা করছোনা কেন, কী আশ্চর্য!!” আমি আম্মুকে বললাম “কী করে মানা করি? আমার আম্মু তো আমাকে বাধা দেয়নি কখনও!!” “তাই বলে ওরা এভাবে আমার মেয়ের চুল নষ্ট করবে?” আম্মু রাগে গজগজ করতে থাকেন। আমি হাসি। ছোটবেলায় আমার আরো কতকিছু যে করতে ইচ্ছে করতো! রান্নাবান্নার প্রতি খুব আগ্রহ ছিল আমার (কারণ আমি বেজায় পেটুক আর মোটকী ছিলাম)। কোতোয়ালীর সাধুর দোকানের রসগোল্লা আর মেডিকেলের ডিলাক্সের সিংগারার রেসিপি জানার ভীষণ কৌতুহলে একদিন সিদ্ধান্ত নিলাম বড় হয়ে ঐ দোকানগুলোতে চাকরি করতে হবে যাতে ওদের মত করে বানাতে পারি আর বাসায় বসেই খেতে পারি। আমার বড়মেয়েও খুব ভোজনাগ্রহী আমার মত।

আমাকে অবাক করে দিয়ে সে একদিন বললো চল আম্মু নান্দো’স এর কিচেনে গিয়ে দেখে আসি তো, ওরা কিভাবে চিকেন রান্না করে!! এখন বাচ্চাদের খুব বড় হওয়ার সখ। দেখি খুব জলদিই ওরা বড়দের নকল করে সবকিছুতেই। আমার কিন্তু উল্টা সখ হচ্ছে ইদানিং। বাচ্চা হয়ে যেতে ইচ্ছে হয় ভীষণ!! ওদের খেলনা পুতুলগুলোর জায়গায় যদি টুপ করে চলে যেতে পারতাম!! বড় হওয়া আর ভাল্লাগেনা। ওদের দেখে দেখে ছোটবেলার কথা মনে পড়ে আর বুঝি বড় হওয়া মোটেও মজার নয়।

আম্মু হলেই যে দুনিয়ার যত আনন্দ-ফুর্তি নিজের হাতে, এই কথাটা একেবারেই ঠিক নয়। হবেনা। আমি আর খেলবোনা!! আমি আবার ছোট হতে চাই!!!!

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।