মহাজোট সরকারের সাড়ে চার বছরে দেশ পরিচালনায় সরকারের সফলতা-ব্যর্থতার পাশাপাশি বিরোধী দলও চরমভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এ নিয়ে দেশের কারো মনে কোনো প্রকার সন্দেহ নেই। রাষ্ট্র পরিচালনায় সরকারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে বিরোধীদল। বিরোধীদল ক্ষমতাসীন দলকে ক্ষমতার অপব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করে। সঠিক পথে দেশ পরিচালনায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
নিজ দল, দেশ তথা বৃহত্তর কল্যাণের স্বার্থে যেকোনো গণতান্ত্রিক হাতিয়ার ব্যবহারে পিছপা হয় না বিরোধী দল। বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী দল বিএনপি সেই ভূমিকা পালনে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছে। শুধু তাই নয় দলটি গণতান্ত্রিকভাবে এবং যোগ্য নেতৃত্ব সৃষ্টির মাধ্যমে একটি শক্তিশালী ও দায়িত্বশীল ছায়া সরকারের ভূমিকা পালনে চরমভাবে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে বিভিন্ন গণতান্ত্রিক আন্দোলন কর্মসূচি হালে পানি পায়নি। এমনকি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের অদূরদর্শী কোনো কোনো সিদ্ধান্তও পছন্দ হয়নি মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের কাছে।
ফলে জনগণের ন্যায্য কথা কিংবা দাবিগুলোর প্রতিও চরম অবিচার করা হচ্ছে বিরোধী দলের বিজ্ঞোচিত রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দলের সাংগঠনিক দূরদর্শীতার অভাবে। একের পর এক রাজনৈতিক ধাক্কা খাচ্ছে বিএনপি। আন্দোলনের পুরো কর্মকা-ে এক ধরনের স্থবিরতা দেখা দিয়েছে। পুরো দলজুড়ে হতাশা ছড়িয়ে পড়েছে। হামলা-মামলার আতঙ্ক বিরাজ করছে বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ের নেতা থেকে শুরু করে দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মাঝে।
তারা এখন অনেকটা কা-ারিবিহীন নৌকার যাত্রীতে পরিণত হয়েছেন। তাদেরকে সাহস জোগানোর মতো মাঠ কাঁপানো কোনো নেতাই যে মাঠে নেই।
বিএনপির আপোষহীন নেত্রী খ্যাত বেগম খালেদা জিয়া একা আর কতদিক সামাল দিবেন। তাঁর ঘাড়ের ওপরও ঝুলছে কমপক্ষে পাঁচটি মামলা। একদিকে বয়সের ভার অন্যদিকে আবার শারীরিক অসুস্থতার কারণে আন্দোলনকে কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছাতে প্রয়োজনীয় এবং কার্যকরী অ্যাকশনেও যেতে পারছে না দলটি।
ফলে সারাদেশে তৃণমূল নেতাকর্মীদের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। প্রজ্ঞা, সাহস, ও সঠিক দিকনির্দেশনার অভাবে সরকার পতনের আন্দোলন গতি পাচ্ছে না। আবার যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গ ত্যাগ না করার মানসিকতার জন্য সাধারণ মানুষের একটা বিরূপ প্রভাবের বাড়তি চাপ তো রয়েছে দলটির ওপর; যা সামাজিকভাবে তৃণমূল নেতাকর্মীদেরকেও হেয় করছে। ফলে সরকার পতন আন্দোলনে আগের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে না তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। আবার বেগম খালেদা জিয়ার সংলাপ বিমুখতা সাধারণ মানুষকেও হতাশ করেছে।
এদিকে ৯ আগস্ট ঈদের পূর্বে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দল জামায়াত ১৩ ও ১৪ আগস্ট হরতালের ঘোষণা দেয়। এতে করে সাধারণ মানুষ, সরকার ও বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ ঈদ-পরবর্তী সরকারবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের নামে ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের ভয়ে বেশ আতঙ্কে ছিল। এমতাবস্থায়, ঈদ-পরবর্তী গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কঠোর কর্মসূচি আশা করেছিল তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, সরকারের মেয়াদ আছে মাত্র দুই থেকে তিন মাস। এখন কঠোর আন্দোলনে না গেলে দল ইমেজ সংকটে পড়বে।
অথচ ওই অনুষ্ঠানে নরম ও সাদামাটা কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। এতে সারাদেশে বিএনপির অসংখ্য নেতাকর্মী হতাশ। অন্যদিকে, বিদেশি দাতা সংস্থা ও উন্নয়ন সহযোগীদের পক্ষ থেকেও হরতালসহ কঠোর আন্দোলনের কর্মসূচি না দেওয়ার ব্যাপারে অনুরোধ করা হয়েছে। সব কিছু মিলিয়ে আন্দোলন-কর্মসূচি নিয়ে ঘরে-বাইরে ব্যাপক চাপের মুখে রয়েছে বিএনপি।
সাম্প্রতিক রাজনীতিতে হট ইস্যু হেফাজতে ইসলামের রাজনীতি।
অরাজনৈতিক সংগঠনের নামে বিএনপি-জামায়াতের পৃষ্ঠপোষকতায় হেফাজত মূলতঃ রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করে দেশে-বিদেশে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনায় ওঠে আসে। সর্বশেষ গত ৫ মে মধ্যরাতে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের অবস্থান কর্মসূচিতে বল প্রয়োগ করে তুলে দেওয়া ও বিপুলসংখ্যক প্রাণহানির অভিযোগে বিক্ষোভ সমাবেশের ডাক দেয় বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট। কিন্তু সমাবেশের অনুমতি না দেওয়ায় গত ১৩ মে তারা সমাবেশও করতে পারেনি। এরপর আবার ১৫ মে সমাবেশের ঘোষণা দেয় ১৮ দলীয় জোট। পুলিশ অনুমতি না দেওয়ায় সেই সমাবেশও করতে পারেনি তারা।
এর প্রতিবাদে ১৯ মে রোববার দেশব্যাপী সকাল-সন্ধ্যা হরতাল কর্মসূচির ঘোষণা দেয় বিএনপি। কিন্তু ঘোষণার ৭ ঘণ্টার মাথায় বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের দিকে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের সম্ভাব্য দুর্যোগ বিবেচনায় নিয়ে দেশব্যাপী হরতাল প্রত্যাহার করে নেয় বিএনপি। ওই দিনই সন্ধ্যায় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া হরতাল প্রত্যাহারের এ নির্দেশ দিলে তা প্রত্যাহার করা হয়। ১৫ মে সন্ধ্যায় নয়াপল্টনের বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে জরুরি সংবাদ সম্মেলনে মহাসেনের কারণে সম্ভাব্য ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কথা বিবেচনায় রেখে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্দেশে এ হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানান তাঁর উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু। এর আগে, ১৪ মে রাতে সমাবেশের অনুমতি না দিলে কঠোর কর্মসূচি দেওয়া হবে বলে বিএনপির পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়।
নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন, আটক নেতাদের মুক্তি, হেফাজতে ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযানের প্রতিবাদে ১৮ দল বিএনপি কার্যালয়ের সামনে এই সমাবেশ ডেকেছিল। এর আগে একই দাবিতে গত ১৩ মে তারা সমাবেশ ডাকে। কিন্তু পুলিশ অনুমতি না দেওয়ায় ওই দিন তা স্থগিত ঘোষণা করে বিএনপি। সমাবেশের অনুমতি না পাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাতে দলের কয়েকজন নেতাকে গুলশানের কার্যালয়ে ডেকে তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, ঢাকা মহানগর সদস্য সচিব আবদুস সালাম ওই বৈঠকে ছিলেন।
প্রশ্ন হচ্ছে জনগণের প্রকৃত চাহিদা ও দাবি পূরণ করা শুধু কি কোনো নিছক অনুমতির উপর নির্ভরশীল? এটি কি কোনো একটি শক্তিশালী গণতান্ত্রিক দলের অতিমাত্রায় দায়িত্বশীলতার পরিচায়ক নাকি আপোষকামিতার ছাপ? বিএনপি জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আহ্বানে সাড়া দিয়ে হরতাল প্রত্যাহার করে আলোচনার পাল্টা প্রস্তাব দেন। প্রধানমন্ত্রীও যেকোনো বিষয়ে, যেকোনো স্থানে সংলাপে বসার আহ্বান জানালেন। বিএনপি নেতারা জেল থেকে ছাড়া পেতে থাকলেন। এমনই পরিস্থিতিতে হেফাজতের ঢাকা অবরোধের আগের দিন ৪ মে সমাবেশ থেকে খালেদা জিয়া সংলাপ প্রস্তাব প্রায় নাকচ করে দিয়ে তত্ত্বাবধায়কের দাবি মানতে সরকারকে ৪৮ ঘণ্টার আলটিমেটাম দিলেন। বিএনপি নেত্রী এখানেই থামলেন না।
পরদিন হেফাজতকে ঢাকায় যেমন সরকার অবাধ প্রবেশাধিকার দিল তেমনি তারা ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠল। পল্টন-মতিঝিল আগুনে পুড়ল। গরিব দোকানদাররা রিক্ত-নিঃস্ব হলো। পবিত্র কোরআন পর্যন্ত রক্ষা পেল না দাবানল থেকে! হেফাজত নেতা আল্লামা শফী মঞ্চে এলেন না। অথচ তার ডাকে গ্রামীণ সরল অল্প বয়সী মাদ্রাসা ছাত্রদের ডেকে এনে অনিশ্চয়তার মুখে ঠেলে দেওয়া হলো।
বিএনপি নেত্রী তার নেতাকর্মী আর ঢাকাবাসীকে হেফাজতের পাশে থাকার আহ্বান জানান; অথচ সমাবেশস্থলে তাদের আদৌ উপস্থিতিই ছিল না। ডান নয়, বাম নয় সোজা পথে হাঁটা বিএনপি এমনিতেই একাত্তরের কলঙ্কের ঢোল জামায়াতকে নিয়ে যেখানে ডানে মোড় নিতেই থাকল সেখানে হেফাজতের দায়ও কাঁধে তুলে নিল। হেফাজত তাদের ওপর নামা দমননীতির প্রতিবাদে হরতাল দিল না। অথচ দুই দিনের আরেকটি গণবিরোধী হরতাল দিল বিএনপি জোট! কার পরামর্শে বিএনপি নেত্রী এভাবে হেফাজতের পাশে নামতে বললেন। আসলে ‘অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে’ সরকারবিরোধী আন্দোলনে রাজনৈতিকভাবে ফায়দা হাসিলের যে কৌশল নিয়ে গত কমাস ধরে এগুচ্ছিল বিএনপি, তা এখন দলটির জন্য অনেকটাই বুমেরাং হয়েছে।
দৃশ্যে-অদৃশ্যে অবস্থা এতটাই বেগতিক যে, দশম জাতীয় নির্বাচনের দু’মাস আগে দলটির মূল দাবি তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল ইস্যুটি বলতে গেলে তাদের বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এ ইস্যুতে সরকারকে প্রভাবিত করা যাবে, সামনের দিনগুলোতে আদৌ দলটি জোরালো এমন কোনো কর্মসূচি দিতে পারবে কিনা, দলটির সাংগঠনিক সেই সামর্থ্যরে বিষয়টিও এখন জোরালোভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ। খোদ বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নির্দেশও এখন উপেক্ষিত হচ্ছে প্রকাশ্যে। এসব কারণে দলটির ‘তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনর্বহাল’ দাবির চেয়ে সারাদেশে গণমানুষের মুখে মুখে স্থান পাচ্ছে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার, জামায়াত-শিবিরের তা-ব, শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের দাবি এবং সর্বশেষ হেফাজতে ইসলামের ব্যর্থ আন্দোলনের বিষয়গুলো। একইসঙ্গে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে বিএনপির আন্দোলনের ইস্যুগুলোও।
এছাড়াও হেফাজতে ইসলামের সব দাবির সঙ্গে একমত পোষণ না করেও তাদের কৌশলী সমর্থন, তাদের পাশে দাঁড়ানোর ঘোষণা দিয়ে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করার কারণেও দলটি এখন বিপাকে রয়েছে। হেফাজতের ঘাড়ে বন্দুক রেখে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার যে চেষ্টা ছিল দলটির, তাও হয়ে পড়েছে প্রকাশ্য। সবমিলিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর বিএনপি এখন রাজনৈতিকভাবে নিশানাহীন গন্তব্যে হাঁটছে। এসব কারণে বর্তমানে চরম এক নাজুক সময় পার করছে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতার স্বাদভোগ করা এ রাজনৈতিক দলটি।
শরিক জামায়াতের সঙ্গেও বিএনপির সম্পর্ক সবসময় ভালো যাচ্ছে না।
জামায়াতকে বিএনপি জোট থেকে সরিয়ে নিতে সরকার তৎপরতা ও ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে বলেও বিএনপি চেয়ারপারসন বিভিন্ন সময় অভিযোগ করেন। বিষয়টি বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে চলতে থাকে। এছাড়া, বিএনপির পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়Ñ জামায়াত নিজস্ব কর্মসূচি সফল করতে যে পরিমাণ তৎপরতা চালায়, জোটের কর্মসূচির ব্যাপারে তা দেখায় না। এ নিয়েও তাদের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব দেখা দেয়। এছাড়া, সাম্প্রতিক সময়ে নাস্তিক ব্লগারদের বিচারসহ নির্দিষ্ট ১৩টি দাবিতে হেফাজতের ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ঘোষণার পরই একে স্বাগত জানায় বিএনপি।
জানা গেছে, সম্পূর্ণ নিজেদের প্রচেষ্টায় হেফাজতে ইসলাম দেশীয় রাজনীতিতে একটি শক্ত ভিতের ওপর দাঁড়িয়ে গেলে ও ব্যাপক আলোচিত হলে সংগঠনটির ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠে সুবিধাভোগী বিএনপি। দলীয় হাইকমান্ডের নির্দেশে দলের বেশকজন প্রভাবশালী সিনিয়র নেতা নিজেদের পক্ষ থেকে হেফাজতে ইসলামের নেতৃত্বের সঙ্গে যোগাযোগ গড়ে তোলেন। তাদের বোঝাতে সক্ষম হন, বিএনপি ও তার জোট ১৮ দল তাদের কর্মসূচিকে সমর্থন করে। দাবিগুলোর সঙ্গেও একমত। এ ব্যাপারে দেশের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে তাদের প্রতি বিএনপির পূর্ণ সমর্থন আছে।
শুধু তাই নয়, বিএনপি হেফাজতের যেকোনো কর্মসূচিতে প্রয়োজনীয় সাহায্য-সহযোগিতা দিতেও প্রস্তুত।
সরকারের মেয়াদ আর মাত্র দু’তিনমাস বাকি থাকলেও আন্দোলনে আগের মতো হুমড়ি খেয়ে পড়ছে না তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। গত ১৯ আগস্ট রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে কঠোর কর্মসূচি আশা করেছিল তৃণমূলের নেতাকর্মীরা। তাদের মতে, এখন কঠোর আন্দোলনে না গেলে দল ইমেজ সংকটে পড়বে। অথচ ওই অনুষ্ঠানে নরম ও সাদামাটা কর্মসূচি ঘোষণা করেন বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া।
এতে সারাদেশের বিএনপির নেতাকর্মীরা হতাশ। ওইদিন সরকারকে বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দল ঈদুল আযহা পর্যন্ত ডেটলাইন বেধে দিয়েছে। সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক বিল সংবিধানে সন্নিবেশিত করতে এই সময় দেয়া হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ১৮দল বিভাগীয় শহর রাজশাহী, বরিশাল, খুলনা, রংপুর, সিলেট এবং একমাত্র জেলা নরসিংদীতে সমাবেশ করবে। ঈদুল আযহার পর চট্রগ্রামে ও ঢাকায় সমাবশে করা হবে।
তবে কোনো তারিখ নির্ধারণ করা হয়নি এখনও। প্রতিটি সমাবেশে বক্তব্য রাখবেন বিরোধী দলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া ও ১৮ দলের শীর্ষ এবং স্থানীয় নেতারা। ঘোষিত কর্মসূচির ভেতরে সরকারের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা হবে। সেক্ষেত্রে কর্মসূচি পরবর্তিত হতে পারে। সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল এসব কর্মসূচি ঘোষণা করে বলেন, ১৮ দল গণতন্ত্রে বিশ্বাসী একটি জোট।
তারা শান্তি চায়। নিয়মতান্ত্রিকভাবে আন্দোলন করতে চায়। সরকার দেশে যে রাজনৈতিক সংকটের সৃষ্টি করেছে, নির্দলীয় সরকার পুনর্বহাল ছাড়া এর সমাধান হবে না বলে মন্তব্য করেন তিনি। তিনি বলেন, এ লক্ষ্যে ১৮ দলীয় জোট আবারও সরকারকে সময় দিচ্ছে। তাই আবার জনগণের কাছে যেতে এসব কর্মসূচি দেয়া হয়েছে।
১৮ দলীয় জোট আশা করে এ সময়ের মধ্যে সরকারের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে। সরকার রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করেছেন, তার গভীরতা উপলব্ধি করে সমাধানের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। ১৮ দলীয় জোট নির্দলীয় সরকার ছাড়া কোনো নির্বাচনে অংশ নেবে না বলে সরকারকে স্পষ্ট করে জানিয়ে দেন। কোনো দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে দেশের জনগণও সে নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করবে বলে মনে করেন তিনি। নরম কর্মসূচি বিদেশিদের চাপে দিচ্ছেন কিনা জানতে চাইলে ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব বলেন, বিদেশি চাপ আসবে কেনো।
১৮ দল এসব কিছুতে বিশ্বাস করেনা। ১৮ দল একটি গণতান্ত্রিক জোট। এই জোট দেশে অনিশ্চিত ও অস্থিতিশীল পরিবেশ চায় না বলে সরকারকে আরও সময় দিতে শান্তিপূর্ণ এ কর্মসূচি দেয়া হয়েছে। সরকার এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করছে, যাতে দেশে একটি অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। এরকম কিছু হলে এর দায়ভার সরকারের ওপর বর্তাবে বলে হুঁশিয়ারি দেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
জামায়াত ইস্যুতে দ্বিধাগ্রস্ত বিএনপি
বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক দলÑবাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে নিয়েও মহাবিপাকে রয়েছে বিএনপি। যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত জামায়াতও রাজনৈতিক ময়দানে বর্তমানে বেশ কঠিন সময় পার করছে। জোটভুক্ত দলটিকে সমর্থন দেয়া, না দেয়া নিয়েও বিএনপির ভিতরে-বাইরে নানা মত আছে। কেউ জামায়াতমুক্ত বিএনপির পক্ষে রয়েছে। আবার দলের প্রভাবশালী একটি অংশ জামায়াতকে জোটভুক্ত রাখার পক্ষে জোরালো ভূমিকা রেখে চলেছে।
এতে করে জামায়াত ইস্যুতেও দোটানায় পড়েছে বিএনপি। ফলে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে বিএনপি তাদের অবস্থান জনসম্মুখে পরিস্কার করতে ব্যর্থ হয়েছে। এটি দলের অভ্যন্তরে ও ভোটের রাজনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। এ কারণে ১৮ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতও জোটভুক্ত আন্দোলন-সংগ্রামে তেমন সক্রিয় নয় বরং নিষ্ক্রিয়ই রয়েছে।
সাংগঠনিক ও কূটনৈতিক ব্যর্থতায় দিশেহারা বিএনপি
রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে বিপদাপন্ন সময় পার করছে বিএনপি।
সাংগঠনিক দুর্বলতা, অভ্যন্তরীণ কোন্দল, সুবিধাবাদ, সময়োপযোগী সঠিক রাজনৈতিক কৌশল ও সিদ্ধান্তের অভাবে দলের আজ এ অবস্থা। তারপর আবার বেগম জিয়া ছাড়া জিয়া পরিবারের সকল সদস্য দেশের বাইরে অবস্থান করছেন। বেগম জিয়া এবং তার পরিবারের সদস্যদের ওপর নানারকম মামলার খড়গ ঝুলছে। বিএনপিতে বিভিন্ন দলছুট সুবিধাবাদী রাজনীতিক ব্যক্তির সংখ্যা বেশি হওয়ায় নীতি-আদর্শহীন দলে পরিণত হয়েছে বৃহৎ এ দলটি। দলের অভ্যন্তরেই রয়েছে নানা দল-উপদলীয় কোন্দল-দ্বন্দ্ব, সন্দেহ, বিশ্বাস-অবিশ্বাসের টানাপোড়েন।
অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে সংস্কারপন্থী ও সরকারপন্থী-সুবিধাভোগের অপবাদও। ফলে কেউ কাউকে বিশ্বাস করতে পারে না; দলে নেই কোনো চেইন অব কমান্ড। সব মিলিয়ে যেন এক প্রকার স্থবিরতা নেমে এসেছে বিএনপিতে। ফলে এক সময়ের ক্ষমতাসীন এই দলটি ক্রমেই যেন জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। জনপ্রিয়তা বাড়ানোর কৌশলের অভাব থাকলেও ক্ষমতায় যাওয়ার অদম্য ইচ্ছার ঘাটতি নেই দলটির।
নানা সংকটে পড়ে আন্দোলন কর্মসূচি জোরদার করতে না পেরে বিদেশিদের সঙ্গে এক প্রকার আঁতাত করতেই যেন ব্যস্ত হয়ে পড়ছে এই বৃহৎ দলটি। ক্ষমতার রাজনীতির দৌড়ে তাদের রাজনীতি এখন কূটনৈতিকনির্ভর হয়ে পড়েছে। নেতৃত্বশূন্যতা, দক্ষ ও দূরদর্শী সঠিক
সিদ্ধান্তের অভাবে এক্ষেত্রেও ব্যর্থ হচ্ছে দলটি। ফলে চরম হতাশ হয়ে পড়েছে দলের নেতা-কর্মীরা। এদিকে মামলার বেড়াজালে আবদ্ধ বিএনপি।
সারাদেশে বিএনপির অসংখ্য নেতা-কর্মীর নামে একাধিক মামলা রয়েছে। তাদের অনেকেই গ্রেফতার আতঙ্কে পালিয়ে বেড়াচ্ছে। আবার অনেকে নতুন মামলায় আক্রান্ত হওয়ার ভয়ে আন্দোলন-সংগ্রামে নিষ্ক্রিয় রয়েছে। জানা যায়, দলের স্থায়ী কমিটির ১৯ সদস্যের মধ্যে ৪ জন বাদে সকলের নামে একাধিক মামলা রয়েছে। দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার নামেও আছে পাঁচটি মামলা।
খালেদা জিয়ার দুই পুত্র তারেক রহমান ও আরাফাত রহমান কোকো মামলার ভয়ে দেশে আসতেই সাহস করছেন না। পাশাপাশি দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ বিএনপির শীর্ষ ও মাঝারি পর্যায়ের কোনো নেতাই মামলার ভয়ে রাজপথের রাজনীতিতে সক্রিয় নেই। ফলে ঝিঁমিয়ে পড়েছে বিএনপির নেতা-কর্মী ও সমর্থকরা। খালেদা জিয়ার নির্দেশ সত্ত্বেও বিএনপির আন্দোলন-সংগ্রামে রাজপথ ফাঁকা। এতে স্বয়ং দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াই উদ্বিগ্ন-হতাশ।
ফলে দিশেহারা হয়ে পড়েছে বিএনপি। তারেক জিয়ার রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ এখনো অনিশ্চিত। কবে তিনি দেশে ফিরবেন, আদৌ ফিরতে পারবেন কিনা, রাজনীতিতে তার অবস্থান কি হবে, তা নির্ভর করছে বিএনপির রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর। বেগম জিয়ার শারীরিক অসুস্থতা, বয়স, তার ওপর রাজনৈতিকচাপসহ নানারকম রাজনৈতিক দুর্যোগের মধ্যেই তিনি বসবাস করছেন। বিএনপি এখনো সুসংগঠিত নয়।
দলের নেতাদের মধ্যে বিভাজন, বাহাস, অনৈক্য, সুবিধাবাদ সুস্পষ্ট। সরকারের অব্যাহত চাপের মুখে দলের অনেক নেতা সরকারের সঙ্গে নানা ধরনের গোপন আপসকামিতার মধ্যে আছেন। এরকম অবস্থায় বিএনপিকে রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের পথে আনতে অতীতের যেসব ভুলপথ তাদের ক্ষমতাচ্যুত করেছিল সেসব বিবেচনায় নিতে হচ্ছে। বিশেষত তারেক জিয়ার কারণে চীন ও ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের যে ফাঁটল তৈরি হয়েছিল, তা মেরামত করা ছাড়া এ দুর্যোগ থেকে রেহাই পাবার কোনো উপায় নেই। বিএনপি এখন সে কারণেই অনেক বেশি বিদেশমুখী পথে হাঁটছে।
বিএনপি যে
অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়েও কূটনৈতিক নির্ভর হয়ে পড়ে তা উইকিলিকসে প্রকাশিত তথ্যেও ধরা পড়ে। সেখানে বলা হয়, ‘দুর্নীতিগ্রস্ত বড় ছেলে তারেক রহমানকে রক্ষা করাই খালেদা জিয়ার সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ব্যর্থতা। ’
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।